ঢাকা, বুধবার   ০৯ জুলাই ২০২৫

রাষ্ট্রীয় পুশ ইন প্রকল্পে ভারতীয় বুদ্ধিজীবীদের আপত্তি

রহমত আলী লস্কর।। পেশাজীবি, গুয়াহাটি, আসাম

প্রকাশিত : ১৮:৫৬, ৮ জুলাই ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি যে তথাকথিত ‘পুশ-ইন’ অভিযান পরিচালনা করছে — অর্থাৎ সন্দেহভাজন ‘বিদেশি’ তকমা দিয়ে বহু দরিদ্র মুসলমান নাগরিককে জোর করে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার যে প্রক্রিয়া — তা শুধু আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সরাসরি লঙ্ঘন নয়, বরং ভারতের নিজস্ব সংবিধান, ইতিহাস ও বিবেকের বিরুদ্ধেও এক নির্মম আঘাত।

ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে রাতের আঁধারে বাসা থেকে তুলে নেওয়া হয় বহু মুসলমানকে, যাঁদের অনেকের হাতেই ছিল ভোটার কার্ড, আধার কিংবা পৈত্রিক নাগরিকত্বের কাগজ। তাঁদের সীমান্তে নিয়ে গিয়ে বন্দুক ঠেকিয়ে কাদামাটি আর জলের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের দিকে হাঁটতে বাধ্য করা হয়। বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও স্থানীয় মানুষ এসব অপমানিত মানুষকে নিজেদের বলে মানতে অস্বীকৃতি জানালে তাঁরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, রাষ্ট্রহীন এক অবস্থায়।

এই নির্মম চিত্র যেন শুধু কয়েকটি ঘটনার পরিসর নয়, বরং একটি সুসংগঠিত রাজনৈতিক প্রকল্পের বহিঃপ্রকাশ। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এনআরসি ও সিএএ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নাগরিকত্বের সংজ্ঞা থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে মুসলমানদের বাদ দেওয়ার যে কর্মকৌশল গৃহীত হয়েছিল, তারই একটি পরিণত রূপ এই পুশ-ইন। আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা গর্বভরে ঘোষণা দেন — তিনশোরও বেশি ‘বিদেশি’ মুসলিমকে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়েছে, এবং এই অভিযান আরও চলবে।

কিন্তু যাদের তাড়ানো হচ্ছে, তাঁরা কারা? হাজেরা খাতুন নামে ষাট ছুঁই ছুঁই এক প্রতিবন্ধী নারী, যার পিতা-পিতামহর নাগরিকত্ব নথি থাকা সত্ত্বেও তাঁকে রাতের আঁধারে বাংলাদেশ সীমান্তে নামিয়ে দেওয়া হয়। যখন বাংলাদেশ তাঁকে নিতে অস্বীকৃতি জানায়, তখন সেই বৃদ্ধাকে আবার টেনে নিয়ে আসে ভারত — যেন তাঁকে নিয়ে দ্বিপাক্ষিক রাজনৈতিক এক টানাটানি চলছে, অথচ তিনি নিজে কেউ নন। মিছমা খাতুনের বয়স বাহাত্তর। জন্ম ভারতে, বেড়ে উঠেছেন ভারতে, বিয়ে করেছেন ভারতে, অথচ তাকে যখন বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছিল — তিনি তখন বিজিবি সদস্যের পা জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, আমাকে আমার দেশে পাঠাও, তোমাদের দেশে ঢুকতে দিও না। পুশ ইনে ব্যর্থ হয়ে বিএসএফ তাকে গুম করেছে বলে ভারতের গণমাধ্যমেই খবর প্রকাশিত হয়েছে। আরও অনেক মর্মান্তিক খবর আছে পুশ-ইন ঘিরে। শিশুসহ একটি পরিবারকে ফেনী নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছে — যেন পাপ ঢাকতে জলই আশ্রয়।

এই নিপীড়নের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে সোচ্চার খোদ ভারতের বিবেকবান নাগরিক সমাজ। বুকারজয়ী লেখিকা অরুন্ধতী রায় এই পদক্ষেপকে সরাসরি নাৎসি জার্মানির ‘ন্যুরেমবার্গ আইন’-এর সঙ্গে তুলনা করেছেন, যেভাবে ইহুদিদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। তিনি সতর্ক করেছেন — মোদী সরকার সংকট থেকে দৃষ্টি সরাতে ‘ঘৃণার রাজনীতি’ বেছে নিয়েছে, যার শিকার হচ্ছে মুসলমানরা। রায়ের মতে, এই সবকিছু আসলে রাষ্ট্রীয় মদদে রাষ্ট্রহীনতা তৈরির প্রকল্প — যার গায়ে উন্নয়নের মুখোশ লাগানো হলেও ভেতরে কেবল ঘৃণা ও বৈষম্যের জাল।

অরুন্ধতী একা নন। ইতিহাসবিদ রোমিলা থাপার, সমাজবিজ্ঞানী অশীষ নন্দী, অধ্যাপক নন্দিনী সুন্দর, অধিকারকর্মী হর্ষ মন্দার, চিকিৎসক বিনায়ক সেন, কবি আঞ্জুম রাজা, পশ্চিমবঙ্গের মানবাধিকার নেতা কিরীটি রায় — সকলেই এই পুশ-ইনের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে অনেকে মনে করেন, এই ঘটনা শুধু সংখ্যালঘুদের নয় — ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকেই অস্বীকার করার নামান্তর।

বিশিষ্ট নাগরিকদের এক যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এনআরসি ও সিএএ কার্যক্রম ভারতের আত্মার বিরুদ্ধাচরণ। এই আইনের মাধ্যমে শুধু ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্বের প্রশ্ন নির্ধারণ করা হচ্ছে, যা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর বিরোধী। নন্দিনী সুন্দর যেমন সতর্ক করেছেন, একবার যদি রাষ্ট্র ধর্ম দেখে নাগরিক নির্ধারণ করতে শুরু করে, তাহলে একে একে দলিত, আদিবাসী, নারী, দলহীন গরিব — সবাই সেই নথির ফাঁদে পড়ে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়বে।

মানবাধিকারকর্মী হর্ষ মন্দার এই বৈষম্যমূলক আইন প্রণয়নের প্রতিবাদে নাগরিক অবাধ্যতার পথ বেছে নেন। তিনি ঘোষণা দেন, তিনি নিজেকে সরকারি রেকর্ডে মুসলমান হিসেবে নথিভুক্ত করবেন এবং কোনও পরিচয়পত্র না দিয়ে বন্দিশিবিরে যেতে প্রস্তুত থাকবেন — যেন সরকার তাকে একটি “পরীক্ষা” হিসেবে দেখে। তাঁর এই অবস্থান শুধু আইনি নয়, নৈতিক বলেই তরুণদের মনে গভীর রেখাপাত করেছে।

এইসব কণ্ঠস্বর এখন বলছে — ভারতের ‘পুশ-ইন’ প্রকল্প শুধু প্রতিবেশী দেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করছে না, দেশের ভেতরেই একটি চরম মানবাধিকার সংকট সৃষ্টি করছে। ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব নির্ধারণ, গণতান্ত্রিক সংলাপ ও ন্যায়বিচার প্রক্রিয়া এড়িয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার জোরে মানুষ তাড়িয়ে দেওয়া — এগুলো কেবল মুসলমানদের নয়, ভারতীয় রাষ্ট্রের নিজস্ব আত্মপরিচয়ের উপর এক গভীর প্রশ্নচিহ্ন হয়ে উঠেছে।

ভারতের যে বহুত্ববাদী চেতনা একদিন দেশটির অহংকার ছিল, আজ সেই বহুত্বই প্রশ্নবিদ্ধ। ধর্ম, জাতি, ভাষা ও সংস্কৃতির বৈচিত্র্যকে ভালোবাসার বদলে ভয় ও সন্দেহের চোখে দেখার এই প্রবণতা ভারতের আত্মার পরিপন্থী। এই দেশ গড়ে উঠেছিল একসঙ্গে থাকার চুক্তিতে — সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা মানে দখল নয়, বরং দায়িত্ব।

যাঁদের ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, তাঁরা কেউ বিদেশি নন। তাঁদের শিকড় এই মাটিতেই। তাঁদের নামের পাশে ‘বিদেশি’ তকমা বসিয়ে যেভাবে রাতে অন্ধকারে সীমান্তের দিকে হাঁটতে বাধ্য করা হচ্ছে, তা কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আচরণ হতে পারে না। রাষ্ট্র যখন নাগরিকের দিকে বন্দুক তোলে, তখন নাগরিক শুধু দেশচ্যুত হয় না — দেশটাই নিজের ভিত্তি হারাতে থাকে।

এই মুহূর্তে ভারত একটি গভীর বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক সংকটে আছে। রাষ্ট্র তার সংবিধানকে উপেক্ষা করে এক অন্ধ প্রভুত্ববাদে অবতীর্ণ হয়েছে — যার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একমাত্র প্রতিরোধশক্তি হলো দেশের সেই বিবেকবান নাগরিকরা, যাঁরা এখনো বিশ্বাস করেন মানবিকতা, সমতা আর সংবিধানের নৈতিক আদর্শে।

তাঁরাই মনে করিয়ে দিচ্ছেন — এই ভারত হিন্দুত্ববাদী আধিপত্যের দেশ নয়, এটি হাজারো ধর্ম, ভাষা ও জাতিসত্তার এক সম্মিলিত সুর। এই দেশের আত্মা নিপীড়নের নয়, প্রতিরোধের। তাই পুশ-ইন প্রকল্পের বিরুদ্ধে ভারত থেকেই উঠে আসা প্রতিবাদই এখন এশিয়ার বৃহত্তম গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখার একমাত্র আশার আলো।

এসএস//


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি