ঢাকা, শনিবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

শাহবাগ আন্দোলনের নেতাদের হালচাল

প্রকাশিত : ১৪:৪৬, ৯ জুন ২০১৮

Ekushey Television Ltd.

শাহবাগ আন্দোলনের জন্ম একটি মাহেন্দ্রক্ষণে, কাদের মোল্লা উপাখ্যানে। এই সময়ে কিছু তরুণ নেতার জন্ম হয়। তারা ইতিহাসে বেঁচে থাকবেন কি-না জানি না, তবে এই ধরণের নেতাদের রাজনৈতিক জন্ম দেয় কালের রসায়ন। সময় তার প্রয়োজনে কিছু মানুষের জন্ম দেয়। সেসব মানুষের মাঝে কেউ কেউ মহাকালে টিকে যায়, কেউ কেউ হারিয়ে যায় অমানিশার ঘোর অন্ধকারে।

খুব বেশি বড় নেতাদের সঙ্গে তুলনা করলে ইতিহাসের পরিমিতবোধের সীমালঙ্ঘন করা হয়। তবুও বুঝার জন্যে আমি তুলনা ব্যবহার করবো। যেমন ইয়াসির আরাফাতের জন্ম। গোটা পৃথিবীতে তো বটেই, এমনকি খোদ ফিলিস্তিনেও প্রয়াত আরাফাতের চেয়ে জ্ঞানে-গুণে-ক্যালিবারে আরও উত্তম বহু মানুষের জন্ম হয়েছে। কালের নিয়মে তারা আবার বিলীনও হয়ে গেছেন। কেউ কেউ মহাকালে আঁচড়ও দিয়ে গেছেন। ইতিহাস কিন্তু সবারে মনে রাখে না, সবারে ধরেও রাখে না। ইতিহাস তাকেই মনে রাখে যিনি ইতিহাসের হক পূরণ করেন।

ইতিহাসের নিয়মেই ইতিহাসের প্রাকৃতিক নির্বাচন হলেন ইয়াসির আরাফাত। কারণ তিনি এমন একটি সময়ে জন্ম নিলেন এবং তিনি সময়ের ভাষা যাঁরা বুঝেন তাঁদের সহযাত্রী হলেন। তারপর ধীরে ধীরে সারা ফিলিস্তিনিদের সাড়ে তিন হাজার বছরের কষ্ট নিজের ভিতরে ধারণ করলেন, বিশেষ করে ১৯৪৭ সালে ফিলিস্তিনে ইসরায়েল রাষ্ট্রের জবর দখলের পর ফিলিস্তিনিদের কষ্টের ইতিহাসকে ধারণ করলেন মনেপ্রানে। জনাব আরাফাতকে ইতিহাস নির্বাচন করে দিলেন আর তিনি নিজেই নিজেকে আর ফিলিস্তিনি ইন্তিফাদা আন্দোলনকে এগিয়ে নিলেন, হলেন প্যালেস্টাইন লিবারেশন ওরগানাইজেশন-পিএলও-র প্রাণ পুরুষ। সত্য হলো, ১৯৪৭ সালে ফিলিস্তিনে ইসরায়েল রাষ্ট্রের জবর দখল প্রতিষ্ঠা না হলে ব্যক্তি আরাফাতের জন্ম হলেও ইতিহাসের নেতা ইয়াসির আরাফাতের জন্ম হতো না।

একটি জাতির প্রতিদিনের সব কর্মকাণ্ডই ইতিহাস নয়। ইতিহাস হলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, সেই বহমান কালের বাঁক, যেখান থেকে একটি জাতির গতিপথ পরিবর্তন হয়ে যায়। বিংশ শতকের শেষ ভাগ থেকে বাঙালি জাতির ইতিহাসের গতিপথের মোটামুটি একটি ধারা আমরা লক্ষ্য করি। আর তা হলো, প্রতি দুই যুগ পর জাতির জেগে উঠা। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ স্বাধীন হলো এবং ভাগ হলো সিন্ধুসভ্যতার পাঁচ হাজার বছরের পুরোনো জনপদ।

এক মায়ের শরীর কেটে মানব সভ্যতার সব অর্জনকে পাশ কেটে জন্ম হলো দুটি রাষ্ট্রের, ভারত আর পাকিস্তান। ইতিহাসের কষ্টিপাথর দেখে তখনই বলে দেওয়া সম্ভব ছিলো পাকিস্তান রাষ্ট্রটি টিকবে না। টিকার কথাও নয়। প্রায় বারশ’ মাইল দূরত্বের দুটি রাষ্ট্র; যাদের ভাষা সংস্কৃতি প্রথা বিশ্বাস ও মূল্যবোধের কোন মিল নেই তারা শুধু ধর্মের উপর ভর করে টিকতে পারেনা। হলোও ঠিক তাই। দুই যুগ পর বাঙালী জেগে উঠলো। ঊনসত্তরে থেকে একাত্তর বাঙালী জাতির আধুনিক ইতিহাসের উত্তুঙ্গ সময়। একাত্তরে স্বাধীনতার মহাকাব্য। স্বাধীনতার প্রশ্নে বাঙালী অনেক চড়া মূল্য দিলো কিন্তু ছাড় দিলোনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীর কোন রাষ্ট্র স্বাধীনতার জন্য এতো কম সময়ে এত বেশি রক্ত দেয়নি, করেনি এত বড় ত্যাগ। নয় মাসে প্রায় ত্রিশ লক্ষ মানুষের আত্মদান, দুই লক্ষ নারীর সম্মান আর এক কোটির অধিক লোকের বাস্তুহারার ইতিহাসের বিনিময়ে বাঙালী তার মুক্তির মূল্য দিলো। এটি সম্ভবত মিশরে ইহুদি জাতির দাসজীবন থেকে মুক্তির আর এক্সোডাসের বিনিময়মূল্য থেকে অনেক অনেক গুণ বেশি।   

 স্বাধীনতার পর পঁচাত্তরে হলো বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক বিপর্যয়। ষড়যন্ত্রের বলি হয়ে রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বটবৃক্ষের পতন হলো। একটি বড়বৃক্ষের পতন হলে রাষ্ট্রের ভুমি কেঁপে উঠে। তারপর রাষ্ট্র ভুল পথে চলতে থাকে প্রায় চব্বিশ বছর। আমরা দেখলাম প্রায় দুইযুগ পর আবারো নব্বইতে জাতি স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে জেগে উঠলো। সেই ঘুমন্ত জাতি জেগে উঠার সময়ে ইতিহাস যাঁদের প্রাকৃতিক নির্বাচন করলো তাঁরাই জাতিকে পরের দুই যুগ নেতৃত্ব দিলো, আজো অনেকটা দিচ্ছেন।

নব্বইয়ের প্রায় দুই যুগ পর জাতি স্বমহিমায় ২০১৩ সালে আবারো জেগে উঠলো রায়ের পর যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার অনামিকা ও মধ্যমা দুই আঙ্গুল তুলে বিজয় প্রদর্শনের ধৃষ্টতা দেখানোর পর। এবার ইতিহাস প্রাকৃতিক নির্বাচন করলো শাহবাগের কিছু তরুণকে। তাদের এক অংশের নেতা ইমরান এইচ সরকার। জাতি জেগে উঠে জাতির ইতিহাসের রসায়নে। নেতা নির্বাচিত হয় প্রাকৃতিক নির্বাচনে। মানে এই ইমরান সরকারদের মতো ছেলেপেলেরা না থাকলেও জাতি কিন্তু ঠিকই জেগে উঠতো। এই ধরণের ন্যায়ভিত্তিক আন্দোলন আসলে জেগে উঠে মাটি ভেদ করে স্বত:স্ফূর্তভাবে, যেমন উপযুক্ত পরিবেশ পেলে অনিবার্যভাবে ভেদ করে উঠে অঙ্গুরিত উদ্ভিদের বীজ।

ইতিহাস প্রাকৃতিক নির্বাচন করে ছেড়ে দেয়। জাতিকে এবং নেতাকে এরপর ইতিহাসের সত্য ধরে ধরে খনি শ্রমিকের মতো পাথর কেটে কেটে এগিয়ে যেতে হয়। কিন্তু শাহবাগের ইমরান সরকাররা বিজয়ের পর কি করলেন!

প্রথমত: তারা নিজেরাই বিভিন্ন দলে উপদলে বিক্ষিপ্ত হয়ে ফিল্ডি ল্যাঙ্গুয়েজে আক্রমণ পাল্টা আক্রমণে লেগে রইলেন। দ্বিতীয়ত: তারা সরকারের সমালোচনা আর প্রতিক্রিয়াশীল বিরোধিতার পার্থক্য ভুলে গেলেন। তারা ক্রমাগত সরকার বিরোধিতা আর মিথ্যাচারেও রত রইলেন। তারা ভুলে গেলেন কোথায় মূলত তাদের সেইফ জোন। যে আওয়ামীলীগ ছাড়া অন্য কোনো দলের ক্ষমতায়নে সমগ্র বাংলাদেশের এক বর্গইঞ্চি জায়গা তাদের জন্যও নিরাপদ নয়, প্রতিদিন সেই আওয়ামী লীগের নামে সত্য মিথ্যা এবং বানোয়াট সংবাদ দিতে থাকলেন।

আমরা কেইস টু কেইস সব বলবোনা। শুধু নমুনা হিসেবে কোটা আন্দোলন নিয়েই বলবো। নীতিগত আর বিশ্বাসগতভাবে কোটা আন্দোলনকে আমরা সমর্থন করেছিলাম এবং এখনো করি। কিন্তু কোটা আন্দোলনে তারা কি করলেন! তারা নানান অপপ্রচারের গুজব রটালেন, মিথ্যা মৃত্যুর গুজব রটালেন, এমনকি ছাত্রলীগের ৬৯ বছরের ইতিহাসে বহু অপবাদ বদনামের অভিযোগ থাকলেও কেউ যা দিতে পারেনি সেই রগকাটার গুজবও রটালেন।

সুফিয়া কামাল হলে ছাত্রলীগের এক নারীনেত্রীকে গুজবের উপর ভর করে চরম লাঞ্ছিত করালেন।

প্রকৃতি নির্বাচন করলেও প্রকৃতি কোনো মিথ্যা আর খলনায়ককে ধরে রাখে না। সত্যের উপর না থাকলে ইতিহাস সবারেই স্রোতে ভাসিয়ে দেয়। বাঙালির ইতিহাসের সত্য হলো, এদেশে মিথ্যা আর গুজবের উপর  ভর করে রাজনীতি করে পাকিস্তানি ভাবধারার প্রতিক্রিয়াশীলরা। আর বাঙালির ভাবধারা হলো সত্য--সেই বড়ু চণ্ডীদাসের ` সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই`। কথা হলো অন্যায়, অসত্য আর জুলুমের প্রতিরোধে বর্তমানে রাষ্ট্র যেখানে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগের বহু নিবেদিতপ্রাণ নেতাকর্মীদেরই ছাড়তেছেনা, সেখানে আপনি কোন রসগোল্লা যে প্রতিদিন একটি করে সরকার বিরোধী সত্যকে মিথ্যা দিয়ে মোড়ানো উদ্ভট উস্কানি দিবেন, আর সরকার আপনাকে কিছুই করবে না!

তবে আমার মনে হলো রাষ্ট্র এবারও ইমরান সাহেবকে ফেভার দিলো। মিথ্যার বেসাতি করে তিনি যখন হারিয়ে যাচ্ছিলেন তখন সরকার তাকে আবার জীবিত আর প্রাসঙ্গিক করে দিল। কোনো রাজনীতি বা আন্দোলন যখন সত্যের উপর থাকে না, মানুষের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে থাকে না, তখন তা এমনিতেই হারিয়ে যায়। আর তাই গ্রেফতার থেকে থেকে তিনি লাভবান হবেন। রাজনীতিবিদের প্রথম সার্টিফিকেট হলো জেল। জেল হলো রাজনীতির সবচেয়ে বড় পাঠশালা।

গত শতাব্দীতে পৃথিবীর বেশিরভাগ দরকারী রাজনৈতিক নেতার জন্ম হয়েছে জেলে জেলে। এমনকি বহু দার্শনিকেরও জন্ম হয়েছে জেলে জেলে। রাষ্ট্রকে ধন্যবাদ যে তাকে জেলে নিয়ে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠার সুযোগ না দেওয়ার জন্য, অন্তত এই প্রতিক্রিয়াশীল মন নিয়ে রাজনীতি করার সময়। তবে সবচেয়ে ভালো হতো যদি তাকে উপেক্ষা করা যেতো। যিনি প্রতিক্রিয়াশীল আর গুজব নির্ভর হয়ে যাচ্ছেন তাকে কনসেনট্রেশনে রেখে প্রাসঙ্গিক রাখার দরকার নেই। শাহবাগ আন্দোলনের সেই ইমরানকে আমরা মনে রাখবো। তার হালের প্রতিক্রীয়াশীল রূপও আমরা মনে রাখবো। জনপ্রিয়তা বিক্রি করে সমৃদ্ধির আশায় মন্ত্রীর কন্যাকে বিয়ে করার সেই রূপও আমরা মনে রাখবো।

আমরা আবারো সবারে মনে রাখতে বলবো, সমালোচনা মানে বিরোধিতা নয়। সমালোচনা মানে প্রতিক্রিয়াশীলতাও নয়। গঠনমূলক সমালোচনা হলো রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকের সবচেয়ে বড় পরামর্শ। কিন্তু আপনার সমালোচনায় যদি আইএসআইয়ের উপকার হয়, যদি মোসাদ উজ্জীবিত হয়, যদি স্বাধীনতা ও রাষ্ট্র বিরোধীরা হয় উৎফুল্ল ও বেনিফিসিয়ারী, তবে আমরা বসে থাকতে পারিনা। এই রাষ্ট্র আমাদের। এই রাষ্ট্র আমাদের খাওয়ায়, পরায়, নিরাপত্তা দেয়, আলো বাতাস জল দেয়। এখানে কোন ষড়যন্ত্র হলে আমরা কাউকেই ছেড়ে কথা বলতে পারিনা। যে রাষ্ট্র, যে রাজনৈতিক দর্শন আমাদের নিরাপত্তা দেয়, যে চেতনার সীমানা প্রাচীর ধ্বসে পড়লে আমরা নিজেরাই বিপন্ন ও উদাও হয়ে যাবো সে দর্শনকে আমাদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

০৭.০৬.২০১৮


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি