স্বপ্নের পথে বিভ্রম: নিউজিল্যান্ডে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের কঠিন কঠিন বাস্তবতা
প্রকাশিত : ২০:৩৭, ২ ডিসেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ২০:৪০, ২ ডিসেম্বর ২০২৫
বাংলাদেশের অসংখ্য শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা, উন্নত জীবনযাত্রা এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশায় আজ দূর প্রবাসে পা বাড়াচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ঝলমলে প্রচার, ভিসা এজেন্টদের লোভনীয় প্রতিশ্রুতি, এবং বিদেশে থাকা কিছু পরিচিতজনের অসম্পূর্ণ অভিজ্ঞতা দেখে তাঁদের অনেকের মনে একটি চিরচেনা স্বপ্ন গড়ে ওঠে—নিউজিল্যান্ডে নামলেই মিলবে পার্টটাইম কাজ, কয়েক বছরের মধ্যে সুগম হবে স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার পথ, আর সেখানে জীবনযাত্রার ব্যয় বাংলাদেশে তুলনায় হয়তো সামলানো যাবে সহজেই।
কিন্তু বাস্তবতা তাদের সেই প্রত্যাশার চেয়ে বহু কঠিন, তীব্র, এবং প্রায়শই মানসিক ধাক্কাস্বরূপ। সম্প্রতি বাংলাদেশ–নিউজিল্যান্ড ফ্রেন্ডশিপ সোসাইটি (বিএনজেডএফএস) যে সমীক্ষা পরিচালনা করেছে এবং এ নিয়ে যে সেমিনারের আয়োজন করেছে, তাতে উঠে এসেছে এক ভিন্ন বাস্তবতার ছবি। সমীক্ষায় দেখা যায়, নিউজিল্যান্ডে যেতে আগ্রহী তরুণদের অধিকাংশই দেশে যে ধারণা নিয়ে বের হন, বিদেশে এসে তার সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই।
তাঁরা মনে করেছিলেন পড়াশোনার পাশাপাশি দ্রুতই কাজ পাওয়া যাবে এবং পড়াশোনা শেষের পর পেশাগত চাকরির সুযোগ হাতের নাগালে থাকবে। কিন্তু নিউজিল্যান্ডে এসে তাঁরা সম্মুখীন হন অতিমাত্রায় ব্যয়বহুল বাসস্থান, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের বাড়তি দাম এবং তার চাইতেও কঠিন কর্মসংস্থানের বাস্তবতার।বিশেষ করে পারিবারিক সঞ্চয়, ঋণ কিংবা সম্পদ বিক্রি করে বিদেশগামী বাংলদেশি মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের জন্য এই বৈষম্যপূর্ণ বাস্তবতা হয়ে ওঠে অত্যন্ত তীব্র।
বিএনজেডএফএস-এর সমীক্ষায় দেখা গেছে, শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ আসার পর প্রথম ছয় মাসের মধ্যে কোনো না কোনো কাজ পেলেও, সে কাজ তাঁদের পেশাগত যোগ্যতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। রেস্তোরাঁ, সুপারশপ কিংবা অন্যান্য শ্রমনির্ভর খাতে কাজ করতে হচ্ছে বেশিরভাগকে, যেটি তাঁদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বিজনেস বা ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে পড়তে আসা শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এই সংকট আরও প্রকট; বিপরীতে প্রযুক্তিনির্ভর ক্ষেত্র, বিশেষত তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা তুলনামূলক দ্রুত কাজ পাচ্ছেন।
এই অসম অভিজ্ঞতা নবাগতদের আত্মবিশ্বাসকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। অনেকেই সঙ্গী নিয়ে এসেছেন, কিন্তু পরিবারে দ্বিতীয় উপার্জনকারী কাজ না পাওয়ায় পুরো খরচের চাপ শিক্ষার্থীর কাঁধেই পড়ে। এতে তাঁদের মানসিক বিপর্যয়, পারিবারিক দুশ্চিন্তা এবং আর্থিক অনিশ্চয়তা বেড়ে যায় বহুগুণে।
বাংলাদেশে অবস্থানকালে তাঁরা যে তথ্যের উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেন, তার অনেকটাই অসম্পূর্ণ কিংবা বিভ্রান্তিকর। রাজধানী ও অন্যান্য শহরে গজিয়ে ওঠা অসংখ্য এজেন্সি ছাত্র-ছাত্রীদের বিদেশে পাঠানোর ব্যবসাকে লাভজনক করতে নানা অতিরঞ্জিত প্রতিশ্রুতি দেয়। বাংলাদেশের পরিবারগুলো তাঁদের সামর্থ্যের শেষ বিন্দু পর্যন্ত গিয়ে সন্তানের স্বপ্নে বিনিয়োগ করেন, কিন্তু বাস্তবে সে স্বপ্নের ভিতটি দাঁড়িয়ে থাকে ভ্রান্ত তথ্যের ওপর। ফলে বিদেশে এসে যখন দেখা যায় যে প্রাপ্ত আয়ে জীবনধারণই কঠিন, পড়াশোনার খরচ তো দূরের কথা—তখন পরিবারের চাপ শিক্ষার্থীর মনে আরো ভারী ছাপ ফেলে।
বিএনজেডএফএস-এর জরিপে উঠে আসে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের সংকটের কথাও। দূরদেশে ভাষা, সংস্কৃতি ও পরিবেশে মানিয়ে নেওয়া একটি কঠিন প্রক্রিয়া। তার ওপর যখন কাজের অভাব, উচ্চ ব্যয়, পারিবারিক চাপ এবং একাকীত্ব যুক্ত হয়, তখন অনেকেই হতাশা, ডিপ্রেশন কিংবা উদ্বেগে ভুগতে শুরু করেন। কেউ কেউ পরিবারের সঙ্গে বাস্তব পরিস্থিতি শেয়ার করতে সংকোচবোধ করেন, এবং একা একাই আশঙ্কা ও চাপ বহন করতে থাকেন। সমীক্ষায় উল্লেখ আছে, অনেকেই জানেন না কোন প্রতিষ্ঠান বা কমিউনিটিতে সাহায্যের জন্য যেতে হবে। ফলে সংকট নীরবে, ধীরে ধীরে গভীরতর হয়।
নিউজিল্যান্ডের বাস্তবতা বোঝার অভাব কেবল ব্যক্তিগত বিপর্যয় তৈরি করে না, বরং সামগ্রিকভাবে একটি পরিবারকে আর্থিকভাবে দুর্বল করে ফেলে। যে পরিবার তাঁদের সন্তানের বিদেশ যাওয়ার জন্য সঞ্চয়, বিক্রি করা সম্পদ বা ঋণের ওপর নির্ভর করেছেন, তাঁরা প্রবাসে সন্তানের ব্যর্থতার আশঙ্কায় আরও ভেঙে পড়েন। সন্তানও মনে করেন, পরিবারকে হতাশ না করার দায়িত্বও তাঁরই। এই চক্রে শিক্ষার্থীর মানসিক চাপ বহুগুণ বৃদ্ধি পায়।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে—বাস্তব তথ্যের ভিত্তিতে বিদেশগমনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ। আর এখানে কমিউনিটি সংগঠনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ–নিউজিল্যান্ড ফ্রেন্ডশিপ সোসাইটি (বিএনজেডএফএস) ইতোমধ্যে এসব সমস্যার গভীরে গিয়ে গবেষণা, আলোচনা এবং সমাধানের পথে উদ্যোগ নিয়েছে। তাদের গবেষণা শাখা সিএমআরডি তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে সমস্যার মূল কারণ বের করছে; নতুন আগন্তুকদের জন্য সেমিনার, কর্মশালা ও পরামর্শদান কার্যক্রম চালাচ্ছে। তারা বারবার সতর্ক করছে—এজেন্ট বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রচার নয়, বরং নিরপেক্ষ তথ্য ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
বিএনজেডএফএস পরামর্শ দিয়েছে যে বিদেশে যাওয়ার আগে শিক্ষার্থীদের উচিত বাস্তবধর্মী তথ্য জানা, নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করা, ভিসা এজেন্টদের অতি-প্রলোভন এড়িয়ে চলা এবং কমিউনিটি প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে নিউজিল্যান্ডের বাস্তব জীবনযাত্রা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নেওয়া। একইসঙ্গে, বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোরও উচিত বিদেশগামী শিক্ষার্থীদের জন্য বাস্তবতা-বিষয়ক পরামর্শমূলক সেমিনার চালু করা এবং অসাধু ভিসা এজেন্টদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া।
নিউজিল্যান্ডের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের তথ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে আরও স্বচ্ছ হতে হবে—কোন বিষয়ে প্রকৃত চাকরির সুযোগ কতটা, কোন ক্ষেত্রে কঠিন প্রতিযোগিতা আছে, এবং পড়াশোনা শেষে পেশাগত পথ কতটা মসৃণ হতে পারে। পাশাপাশি, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা এবং কর্মপরামর্শ পাওয়াকে সহজ করে তুলতে হবে।
শেষপর্যন্ত সবচেয়ে বড় বিষয় হলো—স্বপ্ন দেখা কখনো ভুল নয়, কিন্তু সেই স্বপ্নের সঙ্গে বাস্তবতার সেতু তৈরি করতে হবে সতর্কতা, গবেষণা এবং নির্ভরযোগ্য তথ্য দিয়ে। বিদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত একটি পরিবারকে যেমন পরিবর্তন করে, তেমনি ব্যর্থতা পুরো পরিবারকে আর্থিক ও মানসিক সংকটে ঠেলে দিতে পারে। তাই তথ্যের সত্যতা যাচাই করা, বিভ্রান্তি দূর করা, এবং বিএনজেডএফএস-এর মতো বিশ্বস্ত সংগঠনের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
বাংলাদেশ–নিউজিল্যান্ড ফ্রেন্ডশিপ সোসাইটি (বিএনজেডএফএস) যে আলো ফেলেছে এই বাস্তবতার উপর, তা আগামী দিনের সিদ্ধান্তপ্রার্থীদের জন্য সতর্কসংকেত। প্রবাসের পথ কঠিন হতে পারে, কিন্তু প্রস্তুতি থাকলে সেই পথই আবার সাফল্যের দুয়ার খুলে দেয়। দায়িত্ব কেবল ব্যক্তির নয়, পরিবার, কমিউনিটি এবং রাষ্ট্র—সবাইকে মিলেই তৈরি করতে হবে নিরাপদ, গবেষণানির্ভর ও টেকসই অভিবাসনের পথ।
এমআর//
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।










