ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪

‘সরকারি কর্মকর্তারা হাসপাতালে চিকিৎসা নিলে অব্যবস্থাপনা কেটে যাবে’

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ২৩:০৭, ৪ অক্টোবর ২০২০ | আপডেট: ২৩:০৮, ৪ অক্টোবর ২০২০

সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ করলে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা প্রায় পুরোটাই কেটে যাবে বলে মনে করেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

শনিবার রাতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরাম আয়োজিত এক ওয়েবিনারে তারা এই মত জানান। অনুষ্ঠানে আলোচনার বিষয় ছিলো- ‘কিভাবে জনগণের মধ্যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা যায়।’

ওয়েবিনারে আলোচক অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির সিনিয়র পাবলিক হেলথ স্পেশালিষ্ট ড. হালিদা আখতার, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত জেমস পি গ্রান্ট (জেপিজি) স্কুল অব পাবলিক হেলথে কর্মরত অধ্যাপক ড. মালবিকা সরকার, হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. লেলিন চৌধুরী। কম্বোডিয়ার রজধানী নমপেন থেকে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বিশ্ব ব্যাংকের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা বিষয়ক কর্মকর্তা ডা. জিয়াউদ্দিন হায়দার।

ডা. লেলিন বলেন, দেশের দরিদ্র, মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তদের জন্য আলাদা আলাদা স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা করা উচিত। উচ্চবিত্তরা দেশের বাইরে চিকিৎসা নিলে নিশ্চিতভাবেই দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নত হবে না। তাই একটি আইন করা উচিত যে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী পরিষদের সব সদস্য, সব সংসদ সদস্য, যুগ্ম সচিবের উপরের সব কর্মকর্তাবৃন্দ অসুস্থ হলে দেশেই চিকিৎসা নিতে হবে। যদি কোন মেডিক্যাল বোর্ড সার্টিফাই করে তবেই তারা বিদেশে যেতে পারবেন। এভাবে দেশের হাসপাতালগুলোয় তারা চিকিৎসা গ্রহণ করলে অব্যবস্থাপনাগুলো সব ঠিক হয়ে যাবে।

নব্বইয়ের দশকে মালয়েশিয়ার মাহাথির সরকার এই ব্যবস্থা নেয়ায় দেশটির স্বাস্থ্য ব্যবস্থা রাতারাতি বদলে যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। আইন দ্বারা জবাবদিহিতার আওতায় আনলেই কমিটমেন্ট ঠিক হয় -যোগ করেন তিনি।

তিনি বলেন, যিনি চিকিৎসা দেবেন তার শারীরিক এবং মানসিকভাবে সুস্থ থাকবার ব্যবস্থাও রাষ্ট্রকেও করতে হবে। নিরাপত্তা সংকটে ভোগা মানুষ কাউকে স্বাস্থ্যসেবা দিতে পারবে না। স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন করতে হবে, যেখানে যিনি চিকিৎসা নেবেন তার সুরক্ষার ব্যবস্থা থাকবে, যিনি চিকিৎসা দেবেন তার সুরক্ষার ব্যবস্থা থাকবে, যে ব্যবস্থাপনা  হাসপাতালের মাধ্যমে চিকিৎসা দেয়া হবে তারও সুরক্ষার ব্যবস্থা থাকতে হবে। কেউ যদি মনে করে কোন হাসপাতালে তার স্বাস্থ্য অধিকার লংঘিত হয়েছে, তাকে যথাযথ চিকিৎসা দেয়নি বা তার সাথে প্রতারণা করা হয়েছে, তাহলে তার অভিযোগ দায়েরের জন্য সহজ একটি জায়গা থাকতে হবে। অভিযোগ দায়েরের ৭-১৫ কর্মদিবসের মধ্যে অভিযোগকারী এবং অভিযুক্তের উপস্থিতিতে ফয়সালা করতে হবে, আইনের আওতায় আনতে হবে। অভিযোগকারী মিথ্যা অভিযোগ দিলে তাকেও আইনের আওতায় আনতে হবে। এভাবে জবাবদিহিতার জায়গাগুলো সুনির্দিষ্ট করে একটি স্বাস্থ্যনীতি করা যেতে পারে যার প্রধান লক্ষ্য থাকবে মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা।

ড. হালিদা আখতার বলেন, প্রত্যন্ত অঞ্চলে মানুষ হাসপাতাল বা চিকিৎসকদের উপর আস্থা হারালে পল্লী চিকিৎসক বা তার নীচের স্তরেও চলে যায়। অন্যদিকে ধনীরা দেশ ছেড়ে বিদেশে চিকিৎসা নিতে যায়। এগুলো সবই আস্থাহীনতার দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি মানুষের বহিঃপ্রকাশ। যুদ্ধ করে গড়া বাংলাদেশে মানুষকে সুস্থ জীবনদানে দায়িত্বশীলদের কোন কমিটমেন্ট নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

তিনি বলেন, হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসকের সংখ্যা অপ্রতুল। চিকিৎসকের কাজ নার্সকে দিয়ে, নার্সের কাজ অন্য কাউকে দিয়ে করালে আশানুরূপ ফল পাওয়া যাবে না। গ্রামাঞ্চল চিকিৎসা সেবায় বিশেষ নজর দিতেও মত প্রকাশ করেন তিনি। তিনি বলেন, পার্বত্য অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবার মান ভালো নয়। স্বাস্থ্যসেবায় অব্যবস্থাপনা দূর করতে জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ এবং দ্রুত শাস্তি প্রদান করতে হবে। যার জন্য প্রয়োজন আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নৈতিক শিক্ষার উপরও গুরুত্বারোপ করেন ড. হালিদা।

ড. মালবিকা বলেন, প্রধানমন্ত্রীসহ সব সরকারি কর্মচারীকে যদি বাধ্য করা হয় তাদের সরকারী চিকিৎসালয়ে চিকিৎসা নিতে হবে তাহলেই ৯৫ শতাংশ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। ইনফরমাল প্রোভাইডারদের (যেমনঃ ফার্মেসী) ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ কারণ বিশাল একটি জনগোষ্ঠীর আস্থা থাকে তাদের প্রতি।

তিনি বলেন, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, তাইওয়ানের মতো দেশ ছোট ছোট কার্যকরী পদক্ষেপ নিয়ে করোনাকে বেশ ভালোভাবে মোকাবেলা করতে এবং মানুষের আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ে অনেক যোগ্য লোক রয়েছেন যাদের এখনো পরিকল্পনা গ্রহণের সাথে যুক্ত করা হচ্ছে না। দেশে আইন থাকলেও বাস্তবায়নের অভাব। নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের চর্চা কেন্দ্র থেকে বিকেন্দ্রীকরণ হবে। তা বাস্তবায়নে প্রয়োজন জবাবদিহিতা-আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা।

করোনায় অবস্থাপনা প্রসঙ্গে ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, প্রথমেই মানুষ বুঝতে পারলো যে বাংলাদেশে স্বাস্থ্যব্যবস্থার নীতিনির্ধারক এবং প্রধান অধিকর্তারা জনগণের সাথে সঠিক কথা বলছে না। শাহেদ-আরিফ-সাবরিনার মতো টাউট প্রকৃতির লোক যারা চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাথে যুক্ত নন তারা বেসরকারিভাবে টেস্ট করার অনুমতি পেয়ে হাজার হাজার ভুয়া রিপোর্ট প্রদান করার ঘটনাতেও মানুষ মনে আঘাত পেয়েছিল। করোনার উপসর্গ যখব বাড়ছে তখন টেস্টের জন্য ফি নির্ধারণ করার দরিদ্র জনগোষ্ঠী বিপাকে পড়ে। তাছাড়া নমুনা দেয়ার প্রক্রিয়াতেও ছিল নানা ভোগান্তি। নমুনা দিতে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবার ঘটনা ঘটেছে। নমুনা দেয়ার কতোদিন পরে রিপোর্ট পাওয়া যাবে তা নিয়েও ছিল অনিশ্চয়তা। মানুষ তখন ত্যক্তবিরক্ত হয়ে নিয়তিনির্ভর হয়ে পড়ে, মরলে মরবো তাও এই ঝামেলায় যাবো না। এসবের মধ্যেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বিভিন্ন জায়গায় 'সাগরচুরি'র ঘটনা বেরিয়ে আসে মন্তব্য করে তিনি পিপিই সরবরাহ, এন-৯৫ মাস্ক কেনায় দুর্নীতির ঘটনাগুলো তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, জাল পিপিই এবং মাস্ক পরে দেশের চিকিৎসক এবং নার্সদের আক্রান্তের হার বেড়ে যায়। আক্রান্ত রোগীর সংখ্যার সাথে চিকিৎসকদের মৃত্যুহার তুলনা করলে বাংলাদেশে বিশ্বে এক নম্বর দেশ। দেখা গেলো এসব দুর্নীতির সাথে ক্ষমতাসীন দলের লোকজন যুক্ত। গণমাধ্যম সোচ্চার এবং জনমনে বিক্ষোভ প্রকাশ পেলে প্রধানমন্ত্রী জুলাইয়ে তদন্ত কমিশন গঠনের নির্দেশ দেন। এক সপ্তাহ পর রিপোর্ট জমা দেয়া হলেও এখনো সেই রিপোর্ট  প্রকাশ করা হয়নি।

ড. মালবিকা বলেন, বাংলাদেশে শিক্ষা ব্যবস্থায় বিশাল ক্ষত রয়ে গেছে। অপরাধের জন্য জবাবদিহিতা বা শাস্তির বিধান থাকলে মানুষের মাঝে আস্থার জায়গা তৈরি হয়। মেডিক্যাল কলেজগুলোতে শুধু চিকিৎসা প্রদান শেখানো হয়, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা শেখানো হয় না উল্লেখ করে তিনি বলেন, চিকিৎসকরা যখন হাসপাতাল বা মন্ত্রণালয়ে যান সেখানে একটা বড় অংশ জুড়ে থাকে পরিকল্পনা, যেখানে দক্ষতার ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়। শিক্ষা ব্যবস্থা, আইন ব্যবস্থার ক্ষত দূর না করে একজন বা দুজনকে সরিয়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ক্ষত দূর করা যাবে না। সব জায়গায় যোগ্যতাসম্পন্ন লোকদের নিয়োদগদানের উপরও গুরুত্বারোপ করেন তিনি।

ডা. লেলিন বলেন, বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ প্রতি বছর বাজেটে জিডিপির পাঁচ শতাংশ বরাদ্দ রাখা। কিন্তু গত ১২ বছরে বাংলাদেশে বরাদ্দ রাখা হয়েছে মাত্র ০.৯ শতাংশ। এই সামান্য পরিমাণ বরাদ্দও পুরোপুরি স্বাস্থ্যখাতে ব্যবহার করার মতো সামর্থ্য এবং দক্ষতা বর্তমানে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নেই। বাংলাদেশে চিকিৎসা খাতে গনেষণা অত্যন্ত দুঃখজনক। 'রিসার্চ এন্ড কো অর্ডিনেশন' এবং 'ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার' নামে মন্ত্রণালয়ের বিভাগ থাকা উচিত বলে মত দেন তিনি। প্রতিটি বিভাগে একজন সচিব দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত থাকবেন যিনি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে শিক্ষাপ্রাপ্ত।

টিআই/এসি


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি