মেট্রোরেল যখন স্বপ্ন বনাম বাস্তবতা!
প্রকাশিত : ২০:৩০, ২৬ ডিসেম্বর ২০২২ | আপডেট: ২০:৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২২
মেট্রোরেল প্রকল্প উদ্বোধন হচ্ছে বুধবার। এর প্রস্তুতি ঠিক কি পর্যায়ে আছে,সে বিষয়ে সংবাদ সংগ্রহের জন্য উত্তরার দিয়াবাড়িতে। সেখানে কথা হচ্ছিল বেসরকারি এক ব্যাংকের কর্মকর্তার সাথে। যে কিনা প্রতিদিনই অফিস করে মিরপুর ১০ এ। মেট্রোরেল হলে কিভাবে উপকৃত হবেন তিনি সেটি জানতে চাইছিলাম কৌতুহল থেকে। বললেন, অফিসে যাওয়া আসার সময় বাঁচবে তবে অর্থ খুব একটা সাশ্রয় হবে না।
স্বপ্নের পদ্মা সেতুর পর স্বপ্নের মেট্রোরেল। যাতে চড়ে এই ব্যাংক কর্মকর্তার মতো কোটিরও বেশি নগরবাসী খুব অল্প সময়ে পৌছেঁ যাবে নির্দিষ্ট গন্তব্যে, কর্মস্থলে। যেমন উত্তরার দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত আসতে সময় লাগবে মাত্র ২০ মিনিট আর এ গন্তব্য যদি হয় মতিঝিল তাহলে আরেকটু বাড়তি মিনিট ১৫-২০ সবমিলিয়ে ৪০ মিনিট। যেখানে বর্তমানে এ পথটি পাড়ি দিতে রাজধানী বাসীকে গুনে গুনে খরচ করতে হয় অন্তত ৬ ঘন্টা, আসা যাওয়া মিলিয়ে।
সম্প্রতি গবেষণা সংস্থা বিআইডিএসের এক জরিপ দেখছিলাম, যেখানে বলা হয়েছে, এ শহরে সড়কে প্রতিদিন গড়ে ৮০ লাখের বেশি কর্মঘন্টা নষ্ট হয়েছে, যা ২০১৭ সালেও ছিলো ৫০ লাখ। যানজটের কারণে প্রতিদিন যে কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে, তার আর্থিক মূল্য প্রায় ১৪০ কোটি টাকা।
কেবল কর্মঘণ্টা নয়, ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্যামে থাকায় সড়কের আয়ুও কমছে অন্তত ৩০ শতাংশ । সবমিলিয়ে ঢাকার যানজটের কারণে মোট দেশজ উৎপাদন জিডিপির ক্ষতি প্রায় তিন শতাংশ। ২০১৫-১৬ সালের নতুন ভিত্তি বছরের যদি হিসাব ধরি তাহলে অর্থমূল্যে এ ক্ষতির পরিমাণ ১ লাখ ১ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
তাহলে ষ্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে এ মেট্রোরেল পুরোপুরি কার্যক্রমে যাওয়া শুরু করলে কর্মঘণ্টা, সময় বিবেচনায় অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধির রসদ যোগানো শুরু করবে। কেবল তাই নয়, যানজট, দূষণে নাকাল শহরবাসী স্বস্তিতে ঘরে ফিরলে স্বাস্থ্য খাতেও ব্যক্তিগত বরাদ্দ কম রাখতে হবে, পরিবারকে সময়ও দেয়া সম্ভব হবে যা সরাসরি জিডিপিতে মূল্যায়িত না হলেও শ্রমিকের কর্মদক্ষতা বাড়িয়ে উৎপাদনশীলতাকে বাড়াতে সাহায্য করবে।
এতো গেল মেট্রোরেলের কারণে নগরবাসীর প্রতিদিনের সময় কমার লাভ ক্ষতির হিসাব নিকেশ । কিন্তু এই মেট্রোরেল ব্যবহারের জন্য যে ভাড়া নির্ধারণ করেছে সরকার তা ঠিক কতোটা প্রভাব ফেলবে এই অর্থনৈতিক মন্দার দু:সময়ে ?
ঢাকার মেট্রোরেলে যাতায়াতে সর্বনিম্ন যাত্রীভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ২০ টাকা। আর উত্তরা থেকে মতিঝিল স্টেশন পর্যন্ত ভ্রমণের জন্য খরচ হবে ১০০ টাকা। কিলোমিটারপ্রতি এ ভাড়া পাঁচ টাকা। সরকার মেট্রোরেলে সর্বনিম্ন যে ভাড়া নির্ধারণ করলো সেই ২০ টাকা দিয়ে একজন যাত্রী সবোর্চ্চ দুই স্টেশনে যাতায়াত করতে পারবে। আর যদি হয় কেবল এক স্টেশন তাও কিন্তু ওই ২০ টাকায় খরচ করতে হবে পকেট থেকে।
যেখানে বর্তমানে রাজধানীতে বড় বাসের ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে প্রায় ৩ টাকা আর মিনিবাসের ক্ষেত্রে আড়াই টাকার মতো। সর্বনিম্ন ভাড়া বড় বাসে ১০ টাকা, মিনিবাসে ৮ টাকা। তবে আবার যারা রিকশা, সিএনজি বা রাইড শেয়ারিংয়ে চলেন তাদের জন্য কিন্তু এই মেটোরেলের ভাড়া সাশ্রয়ী হতে যাচ্ছে। কারণ, ঢাকায় এখন সিএনজিতে উঠলেই ১শ থেকে ১৫০ টাকার নিচে কোন ভাড়া নেই । অন্যদিকে রিক্সা যদি ব্যবহার করতে চান পরিবহণ হিসাবে তাহলে যাত্রীকে গুণতে হয় নিম্নে ২০ টাকা।
সাধারণ মানুষ যখন মেট্রোতে চড়ার আগে খরচের হিসাব নিকেশ কষছে তখন কিন্তু মেট্রো রেল কর্তৃপক্ষ এরই মধ্যে জানিয়েছে, আধুনিক এই গণপরিবহনব্যবস্থা চালু করতে সরকার বিপুল বিনিয়োগ করেছে। এর পরিচালনা খরচও বেশ বেশি। তাই ভাড়া বেশি হয়নি। বরং ভবিষ্যতে ভাড়া আরও বাড়িয়ে এই বাহনকে লাভজনক একটা গণপরিবহনব্যবস্থা হিসেবে গড়ে তোলার চিন্তা আছে তাদের।
এতো গেলো খরচের হিসাব নিকেশ । এখন আসা যাক আপনার আমার কিংবা যারা মেট্রোতে যাতায়াতের কথা ভাবছেন ঢাকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তাদের জন্য মেট্রো স্টেশন পর্যন্ত আসার পথটা কেমন হবে বা হতে যাচ্ছে।
মেট্রোরেলে পথের যে রুটটি করেছে সরকার তাতে উত্তরা-মতিঝিল রুটটির এক প্রান্ত উত্তরা বলা হলেও রাজধানীর উত্তর অংশের মূল জনপদ থেকে স্টেশনের দূরত্ব কয়েক কিলোমিটার। আবার প্রাথমিক পর্যায়ে দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁ পর্যন্ত চালুর যে সিদ্ধান্ত সেখানে আগারগাঁও এসে নামার পর যাত্রীদের বাসে করে যেতে হবে গন্তব্যে। মেট্রোরেলের আরামদায়ক ভ্রমণ শেষে পুরোনো বাস ব্যবস্থা যাত্রীর বিরক্তির কারণ হবার শংকা থেকে যাচ্ছে।
কেবল তাই নয়, উত্তরার দিয়াবাড়ী ও আশপাশের এলাকার মানুষ অপেক্ষাকৃত মেট্রোরেলের কারণে সুবিধা পেলেও ১ থেকে ১০ নম্বর এমনকি ১৩, ১৪ নম্বর সেক্টরের বসবাসরতদের মেট্রোর সুবিধা নিতে হলে বেশ ভোগান্তির পথ হতে যাচ্ছে স্টেশন অব্দি। কেননা, উত্তরার সব সেক্টরে যাতায়াত ব্যবস্থা এক নয়, গণপরিবহনও সীমিত। কেবলমাত্র একটি বাস কোম্পানি হাউজ বিল্ডিং হয়ে দিয়াবাড়ি পর্যন্ত চলাচলের অনুমতি পেয়েও কালভার্ট রোডে এসে স্টপেজ গেড়েছে। সেখান থেকে মেট্রো পর্যন্ত যেতে হলে আবারো খরচ করতে হবে ৩০ টাকা আর পথটা যদি হয় হাউস বিল্ডিং থেকে তাহলে খরচ পড়বে ৮০ টাকা। তারপরও না হয় গেলেন স্বপ্নের মেট্রোতে চড়ে আগারগাঁ অব্দি এরপর কি করবেন যাত্রীরা ?
আগারগাঁও নেমে আবার সেই আগের ভোগান্তি যানজট। এখান থেকে বাসে চেপে যেতে হবে ফার্মগেট, শাহবাগ বা মতিঝিলের পথে। এই পথের যানজট বড় মাথা ব্যাথার কারণ, আরেকটি হলো আগারগাঁও নেমে যাত্রীরা আসলে বাসে উঠতেই পড়বেন ভোগান্তিতে। এছাড়া আগারগাঁও কেন্দ্রীক সরকারি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অফিস, স্কুল কলেজ থাকায় এখানে প্রতিদিন অসংখ্য যাত্রীকে বাসের জন্য অপেক্ষায় থাকতে হয় বেশিরভাগ সময় থাকেনা বসার ব্যবস্থাও।
বিশ্লেষকরা কিন্তু এরই মধ্যে জানিয়েছিলেন, পুরো রুটটি সচল না হলে দিয়াবাড়ী থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল যাত্রী ভোগান্তি কমাতে পারবে না বরং এটি আরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তাদের মতে, মেট্রোরেল কেন্দ্রীক অন্যান্য সংযোগ বাস বা শাটল বাস বা অন্যান্য যান ব্যবস্থা চালু না করলে এটি ভোগান্তি নিরসন ব্যর্থ হবে। পাশাপাশি নিম্ন ও মধ্য আয়ের যাত্রীদের বিবেচনায় যদি ভাড়া কমিয়ে মেট্রো কেন্দ্রীক বানিজ্যিক প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা যায় তাহলে এই আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থাকে জনপ্রিয় করা যাবে অতি দ্রুত সময়ে।
কাবেরী মৈত্রেয়, সাংবাদিক
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।










