ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪

তিনি বেঁচে আছেন মনের মণিকোঠায়

বোরহান উদ্দিন চৌধুরী মুরাদ

প্রকাশিত : ১০:৩১, ৪ নভেম্বর ২০২০

আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ছিলেন একজন জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, বীর মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। গণমানুষের অতি কাছের মানুষ ছিলেন তিনি। তিনি ছিলেন গরিব-দুঃখী-মেহনতি মানুষের পরম বন্ধু। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু আমৃত্যু আনোয়ারার মানুষের পাশে নিজেকে উজাড় করে গেছেন। নীতি-নৈতিকতা ছিল তার অনন্য সম্পদ। সাধারণ জনগণ ছিল তার পরম আত্মার আত্মীয়। তিনি জয় করেছেন তাদের মন। বাঙালির সম্মান, গৌরব ও আত্মমর্যাদা বৃদ্ধিতে যেসব রাজনীতিবিদ নিজেকে উৎসর্গ করেছেন তাদের মধ্যে একজন আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। বিভিন্ন সময় চট্টগ্রামে আন্দোলন-সংগ্রামের পুরোধা ছিলেন তিনি।

’৭৫-পরবর্তী আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করতে তার গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। একজন সৎ ও আদর্শবান রাজনীতিক ও সমাজসেবকের যেসব গুণ থাকা উচিত তার সবই আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর মধ্যে ছিল। তিনি ছিলেন আপাদমস্তক একজন দেশপ্রেমিক, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার পথে তিনি ছিলেন মাঠের একজন দক্ষ কর্মী। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জননেত্রী শেখ হাসিনার সোনার বাংলা বিনির্মাণ ছিল তার একমাত্র লক্ষ্য।

আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু বনেদি ও ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান, একজন দেশবরেণ্য শিল্পপতি, দেশের ব্যবসায়ী সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালনের পরও নিজেকে একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, শিল্পপতি হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন না, দেশ ও মানুষকে ভালোবাসতেন বিধায় তিনি একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচয় দিতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। তার কর্মময় জীবনের ব্যাপ্তি ছিল বিশাল। আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি। জীবন আমার ধন্য তার মতো এত বড় মাপের মহৎ হৃদয়বান জাতীয় নেতার সাহচর্য লাভের সুযোগ হয়েছে আমার। তার সেবা করার সুযোগ পেয়েছি। তার বর্ণাঢ্য জীবন বিশ্লেষণ করা, তার মতো এত বড় মাপের নেতা সম্পর্কে বলার যোগ্যতা আমার নেই। কিন্তু তার সঙ্গে থেকে তাকে নিবিড়ভাবে দেখেছি, মিশেছি সুখ-দুঃখের সাথী হয়েছি; যা কিছু শিখেছি, দেখেছি তা আমাকে অভিভূত করেছে। বিশাল হৃদয়ের অধিকারী এ জননেতা সব মানুষের বিপদে-আপদে দরদি হৃদয় নিয়ে এগিয়ে আসতেন, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন। দলের দুঃসময়ে প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে রাজপথে তার সরব উপস্থিতি নেতাকর্মীদের মাঝে প্রাণ সঞ্চার করত, বৃহত্তর চট্টগ্রামের আওয়ামী রাজনীতির অভিভাবক আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর স্মৃতি স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু চট্টগ্রামের খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক; নানা ঝড়ঝঞ্ঝার মাঝেও দলীয় আদর্শে তিনি ছিলেন অবিচল, এলাকার দলীয় নেতাকর্মীদের কাছে হয়ে উঠেছিলেন বড় আশ্রয়স্থল। কেবল রাজনীতিই নয়, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং শিল্পায়নের মাধ্যমেও দেশের মাটি ও মানুষের জন্য কাজ করেছেন তিনি। কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে দেশের বেকারত্ব হ্রাসে অবদান রেখেছেন।

তিনি বহু বছর ধরে সক্রিয় ছিলেন চট্টগ্রামের রাজনীতিতে। দীর্ঘ সময় ধরে ছিলেন দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন চারবার। নবম জাতীয় সংসদে তিনি ছিলেন পাট, বস্ত্র মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি। ১৯৪৫ সালে আনোয়ারা হাইলধর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। তার পিতার নাম নুরুজ্জামান চৌধুরী। তিনি ছিলেন আইনজীবী এবং জমিদার। তার মাতার নাম খোরশেদা বেগম। তিনি বাংলাদেশের স্বনামধন্য শিল্পপতি চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার মরহুম আলহাজ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর দ্বিতীয় কন্যা নূর নাহার জামানের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ১৯৫৮ সালে পটিয়া হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে ওই বছরই ঢাকা নটর ডেম কলেজে ভর্তি হন। ইন্টারমিডিয়েটে পড়ার সময় তিনি বৃত্তি পেয়ে আমেরিকার ইলিনয় ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে ভর্তি হন। পরে তিনি নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে বিজসেন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে পড়াশোনা করেন। সেখান থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে ১৯৬৪ সালের ডিসেম্বরে দেশে ফেরেন। তিনি ১৯৬৫ সালে ব্যবসা শুরু করেন।

আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ১৯৫৮ সালে দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৭ সালে তিনি মূল সংগঠন আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি আনোয়ারা ও পশ্চিম পটিয়া থেকে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য হন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন আলহাজ আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় তার পাথরঘাটাস্থ জুপিটার হাউস থেকে সংগ্রাম কমিটির কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা চট্টগ্রামের আসার পর জুপিটার হাউস থেকে সাইক্লোস্টাইল করে প্রচার করা হয়। তার বাসা থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রসহ সব জায়গায় পাঠানো হয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ভারতে যান এবং সেখানে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন। তিনি মুজিবনগর সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটির সদস্য ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে তিনি বিশ্বজনমত গড়ে তোলার লক্ষ্যে ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চল সফর করেন। তিনি প্রথমে লন্ডনে যান। সেখান থেকে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সদস্য হয়ে আমেরিকায় যান।

স্বাধীনতার পর ১৯৮৬, ১৯৯১ ও ২০০৮ সালে তিনি জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। স্বাধীনতার পর আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি বাংলাদেশের আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় শিল্প ও বাণিজ্য সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পরবর্তী সময়ে আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেছেন। বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন করতে গিয়ে তিনি কারা নির্যাতন ভোগ করেন। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু একজন সফল ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তা ছিলেন। স্বাধীনতার আগে তিনি বাটালি রোডে বয়েল ইন্ডাস্ট্রি নামে একটি কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী সময়ে আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু আসিফ স্টিল মিল, জাভেদ স্টিল মিল, আসিফ সিনথেটিক, প্যানআম বনস্পতি, আফরোজা অয়েল মিল, বেঙ্গল সিনথেটিক প্রোডাক্ট ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন। ভ্যানগার্ড স্টিল মিল, সিনথেটিক রেজিন প্রোডাক্ট ক্রয় করে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের প্রথম দুই দশকে জামান শিল্পগোষ্ঠীর গোড়াপত্তন করেন। তিনি বিদেশি মালিকানাধীন আরমিট মিল ক্রয় করে সেটিকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করান।

দেশে বেসরকারি ব্যাংকিং সেক্টর প্রতিষ্ঠায় তিনি পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন। তিনি দেশে দ্বিতীয় প্রাইভেট ব্যাংক ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেডের (ইউসিবিএল) উদ্যোক্তা এবং প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। তিনি ২০১১ সালে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান পুনর্নির্বাচিত হন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ব্যবসায়ী নেতা হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি দুই দফায় চট্টগ্রাম চেম্বারের প্রেসিডেন্ট ছিলেন এবং ১৯৮৮ সালে দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠক এফবিসিসিআইয়ের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ওআইসিভুক্ত দেশগুলোর চেম্বারের প্রেসিডেন্ট হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৯ সালে তিনি ৭৭ জাতি গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিনিই একমাত্র বাংলাদেশি যিনি এ মর্যাদাপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংস্থার ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। ব্যক্তিজীবনে তিনি ৩ পুত্র ও ৩ কন্যাসন্তানের জনক। ১৯৬৭ থেকে ৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি হাইলধর ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন। স্বাধীনতার পরও তিনি হাইলধর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং থানা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। চট্টগ্রামের আনোয়ারা ও পশ্চিম পটিয়ার বহু মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এ ছাড়াও বহু জনহিতকর কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি।

আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু রাজনৈতিক জীবনের পাশাপাশি পারিবারিক ও সমাজ জীবনে আচার-আচরণ ছিল অনুকরণীয়। তার কাছে রাজনীতি ছিল বৃহত্তর মানবকল্যাণের মাধ্যম। মমত্ববোধ, মৈত্রী ও সমঝোতার অন্বেষণে তার প্রয়াস ছিল অক্লান্ত। সাংঘর্ষিক ও সহিংস রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ছিল দৃঢ় অথচ নম্র ও শান্ত। আজ তিনি আমাদের মাঝে নেই, তবুও তিনি আমাদের অন্তরে চির জাগ্রত। আজ আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি, তার স্মৃতি, অর্থপূর্ণ জীবন ও মূল্যবোধ। তার আদর্শ অন্তরে ধারণ করে প্রতিনিয়ত শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটি আধুনিক ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে আমাদের পথ চলতে হবে। তার মতো ত্যাগী নেতার আজ বড়ই প্রয়োজন। তিনি সারা জীবন বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে লালন করে গেছেন।

তার সঞ্চয় ছিল সাধারণ মানুষের ভালোবাসা। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে থেকে গণমানুষের জন্য কাজ করে গেছেন তিনি। সেবার দ্বারা ও মহৎ কর্মের মাধ্যমে আলোর প্রদীপ হাতে নিয়ে যে মানুষটি অবদান রেখেছিলেন সংগ্রাম-আন্দোলনে, সে মানুষটি আজ তার নিজ গ্রামে চিরনিদ্রায় শায়িত। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু প্রমাণ করেছেন মানুষকে ভালোবাসলে, তাদের জন্য কাজ করলে মানুষ ভালোবাসার প্রতিদান দেয়। তাই তো মৃত্যুর পরও তিনি বেঁচে আছেন আমাদের মনের মণিকোঠায়। আজ তার মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি আজ আরও দীপ্তিময়, আরও বেশি জনপ্রিয়। কিছু ব্যক্তি আছেন যারা মরে গেলেও কর্মময় জীবন তাদের অমরত্ব দান করে। পৃথিবী ও সভ্যতা যাদের দানে হয় সমৃদ্ধ তেমন একজন ক্ষণজন্মা জননেতা ছিলেন আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু।
আলহাজ বোরহান উদ্দিন চৌধুরী মুরাদ : সাবেক একান্ত সচিব 
muradchy71@yahoo.com
এসএ/
 


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি