ঢাকা, শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪

অদৃশ্য শত্রুর সঙ্গে চলছে মানবজাতির লড়াই

লায়লা নাজনীন

প্রকাশিত : ২০:০৭, ২৯ মার্চ ২০২০ | আপডেট: ২২:৫৯, ২৯ মার্চ ২০২০

লায়লা নাজনীন

লায়লা নাজনীন

একটা সময় ছিল যখন মানুষ যুদ্ধ করতো বন্য প্রাণীর বিরুদ্ধে। তারপর সময়টা আসলো যখন মানুষ মানুষের সাথে যুদ্ধ করা শুরু করল। প্রথমে নিজেদের সাথে, তারপর দেশ ছাড়িয়ে সীমানা পেরিয়ে বিদেশিদের সাথে। এই যুদ্ধগুলো ছিল স্বার্থের যুদ্ধ, অহংকার আর মতবিরোধের যুদ্ধ, কে কার থেকে বড়? কে কার থেকে বেশি শক্তিশালী? যুদ্ধ মানেই নতুন নতুন হাতিয়ার, বোমা, পারমাণবিক শক্তি কী নেই মানুষের নখদর্পনে। আর সেই মানুষই এখন জিম্মি হয়ে আছে করোনা ভাইরাস নামের ছোট্ট একটি ভাইরাসের কাছে যেটা চোখেও দেখা যায় না। কোন অস্ত্রশস্ত্র ছাড়াই যে ভাইরাসটির সাড়ে তিন মাসের মধ্যে বিশ্ববাসীকে জেল নামক নিজের ঘরেই বন্দি করে রেখেছে। মানুষ এখন বন্যপ্রাণী না, মানুষ না, অস্ত্র না, আধুনিক টেকনোলজি না যুদ্ধ করছে দিনের-পর-দিন নানা প্রজাতির ভাইরাসের সাথে।

বর্তমানে করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি আমাদের সবারই জানা। বিশ্বব্যাপী এই করোনা ভাইরাস এর কালো দিন মনে হয় আর শেষ হচ্ছে না। প্রতিমুহূর্তে ভেসে আসছে দেশবিদেশ থেকে মৃত্যু সংবাদ। মনে হচ্ছে বিশ্ব এক মৃত্যুপুরীতে পরিণত হতে যাচ্ছে। বিশ্ব এখন আর্থিকভাবে পঙ্গু, সামাজিকভাবে বিপদগ্রস্থ এবং মনুষ্য জাতি এখন মানসিকভাবে অস্থির হয়ে উঠছে। 

এমন এক ভাইরাস যার নাম করোনা না হয়ে হওয়া উচিত ছিল সেলফিশ। কারণ এই ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির লাশ পর্যন্ত কেউ ছুঁতে পারে না। প্রিয়জন অসুস্থ তাকে কেউ দেখতে যেতে পারবে না। স্বামী স্ত্রীকে, সন্তান মা-বাবাকে, পিতা-মাতা-সন্তান কে কেউ কারো সহায়তায় আসতে পারবে না। চারিপাশে শুধু আর্তনাদ।

নাগরিকত্বের অধিকার নিয়ে উঠছে প্রশ্ন, জনগণ সরকারকে, সরকার জনগণকে, দেশবাসী বিলেত ফেরতদের একে অন্যকে করছে দোষারোপ। ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত জনগোষ্ঠী, বাজারে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ধনীদের ঘরভর্তি খাবার আর গরিবদের নিঃস্ব হওয়ার জোগাড়, মধ্যবিত্তরা দুশ্চিন্তার প্রহর গুনছে। শত শত মানুষ চাকরিহীন হচ্ছে , অনেকে আনপেইড লিভে আছে, ব্যবসায়ীরা কোটি কোটি টাকার ক্ষতি আর লোন কাঁধে নিয়ে দিন পার করছেন। এর শেষ হবে কোথায় কারো জানা নেই।

বাংলাদেশ ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। এখন সচেতন না হলে COVID-19 ছড়াবে দ্রুতগতিতে। যেখানে আমেরিকা ইতালি এবং স্প্যান মতো দেশে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে এবং মৃত্যুর হার ও বেশি, সেখানে সচেতন না হলে বাংলাদেশ এর মত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে। ইতালির জনগণ প্রথমে বিষয়টিকে ততটা গুরুত্ব দেয় নেই আজ তার খেসারত দিচ্ছে মৃত্যুর হার চায়নাকেও অতিক্রম করেছে।

করোনা ভাইরাস সম্পর্কে আমরা এখন কম বেশি সবাই জানি। সাধারণ করোনা ভাইরাস এ জ্বর সর্দি কাশি হয়। কিন্তু অতি সম্প্রতি আবিষ্কৃত হওয়া করোনা ভাইরাস দ্বারা সংক্রমণ রোগের নাম COVID 19। নতুন আবিষ্কৃত কোন ভাইরাস কে NOVELবলা হয়। সেই কারণে এই ভাইরাসের নাম NOVEL CORONA VIRUS। এই ভাইরাসটি 2019 সালে চীনের উহান শহর থেকে উৎপত্তি হয় বলে ধারণা করা হয়। এই ভাইরাসটির সাধারণ লক্ষণগুলো হলো জ্বর, ক্লান্তি এবং শুকনা কাশি। এর মধ্যে কিছু রোগীর শরীর ব্যথা, সর্দিতে নাক বন্ধ হওয়া, গলা ব্যথা এবং ডায়রিয়া হতে পারে। এই ভাইরাসটির সর্বশেষ ধাপ হচ্ছে ফুসফুসকে আক্রান্ত করা। এবং পরিণতি হয় শ্বাসকষ্ট। প্রায় ৮০% লোক বিশেষ চিকিৎসা ছাড়াই সেরে ওঠে যাদের ইমিউনো সিস্টেম ভালো। বয়স্ক ব্যক্তিরা এবং যাদের উচ্চ রক্তচাপ, হার্টের সমস্যা ডায়াবেটিস এর মত রোগ আছে তাদের গুরুতর অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

WHO এর মতে, ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশির সময় নাক বা মুখ থেকে নিঃসৃত ছোট ছোটফোটা গুলির মাধ্যমে এই রোগটি একজন থেকে অন্যজনে মাঝে ছড়ায়। এই ফোটা গুলি ব্যক্তির চারপাশে বস্তু এবং পৃষ্ঠের উপর পড়ে, অন্যেরা উক্ত বস্তু বা পৃষ্ঠাগুলিকে স্পর্শ করার পরে তাদের চোখ নাক স্পর্শ করে COVID 19 এ সংক্রমিত হয়। লোকেরা COVID 19 আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশির ফোঁটা নিঃশ্বাসের সাথে গ্রহণ করলে COVID 19 এ সংক্রমিত হতে পারে এ জন্যই অসুস্থ ব্যক্তি থেকে তিন ফুট বেশি দূরে থাকা গুরুত্বপূর্ণ।

বাঙালি জাতি হিসেবে আমরা খুব আবেগপ্রবণ জাতি। পরিবার এবং আত্মীয় পরিজনের জন্য আমাদের মন কাঁদে কিন্তু এই আবেগ আমাদের জন্য হতে পারে আত্মঘাতী। আজ থেকে প্রায় এক মাস আগে আমার এক বন্ধুর সাথে সেল ফোনে কথা হচ্ছিল। সে বলল তার জ্বর সর্দি ঠান্ডা ডাক্তার দেখিয়েছে। ডাক্তার নরমাল ফ্লু এর কথা বললেন এবং বাসায় রেস্ট করতে বললেন। বন্ধুটি তার বাসায় গিয়ে স্ত্রীকে বলল তুমি এবং বাচ্চারা আমার রুমে কিছুদিনের জন্য এসো না। কিন্তু ব্যাপারটা হলো উল্টো তার স্ত্রী তাকে এক মিনিটের জন্য একা ছাড়লো না এবং বাচ্চারা পরপর এসে উঁকি দিতে থাকলো, বাবার কি হয়েছে জানতে। সেদিন দুপুরে তার বাবা-মা তাকে দেখতে আসলো এবং বিকালে ভাই-বোন হাজব্যান্ড দেখতে আসলো। বন্ধুটি এখন সুস্থ আছে। আল্লাহ না করুক সে যদি COVID 19 এ আক্রান্ত হতো আর এরকম সবাই দেখতে আসত তাহলে চিন্তা করুন কি পরিস্থিতি হত! অতি ভালবাসা ও মায়া আমাদের জন্য যেন কান্নার কারণ না হয়ে দাঁড়ায়।

হোম কোয়ারান্টিনে থাকা মোটেও আনন্দের ব্যাপার না, ব্যাপারটা কঠিন। কিন্তু আমাদের নিজের এবং পরিবারের সুরক্ষার জন্য সরকারের পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত হোম কোয়ারান্টাইন এ থাকতে হবে। এর মধ্যে যদি অতি জরুরি কোন কাজে যেমন খাবার দাবারের জন্য অথবা ওষুধ কিনতে হয় তবে বিশেষ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে। যেমন বাইরে বের হলে মুখে মাস্ক এবং হাতে গ্লাভস পরতে হবে। মানুষ দেখলে একটু দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ানো বা হাটা, বাইরে থেকে এসে কাপড় ভালোভাবে ধুয়ে ফেলা, হাত ভালোভাবে সাবান দিয়ে ধোয়া মিনিমাম ২০ সেকেন্ড, ঘরের মেঝে, দেয়াল, দরজার হাতল, ওয়াশরুমের কল ডেটল বা ব্লিচিং পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে। বাসার দরজার বাইরে ডেটল স্প্রে করা। বাসায় ছুটা বুয়া থাকলে এক মাসের জন্য ছুটি দিয়ে দেওয়া উত্তম। ময়লা বাস্কেট এ করে না ফেলে পলিথিন ব্যাগ করে বাইরে রেখে দেয়া যাতে ময়লা বাস্কেট না ধরতে হয়। আশেপাশের বাসার বা আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধবীকে এই সময়ে বাসায় আসতে বারণ করা। 

দরিদ্র দিন আনে দিন খায়। মানুষের খাবারের চাহিদা মেটাতে না পারলে কোয়ারেন্টাইন বলবৎ রাখাও কঠিন হয়ে পড়বে কারণ এই দরিদ্র মানুষগুলোর কাছে এখন করোনা আক্রান্ত হওয়া থেকে সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা। কাজ না থাকলে তারা কিভাবে প্রতিদিন অন্ন জুটাবে পরিবারের জন্য। এমনিতেই না খেয়ে সব মরে যাবে। তবে আশার আলো হচ্ছে সরকারি সংস্থার পাশাপাশি এখন বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা সংগঠন এবং ব্যক্তিবর্গ ও স্বেচ্ছাসেবী দল এগিয়ে এসেছে এই দরিদ্র মানুষের পাশে। মানবতার খাতিরে অনেকে ব্যক্তি উদ্যোগে চাল, ডাল, তেল, আলু, পেঁয়াজ প্রয়োজনীয় টাকা দিচ্ছে। বিভিন্ন পয়েন্টে যেমন কমলাপুর রেলস্টেশন বিভিন্ন রিক্সা স্ট্যান্ড এবং এর দরিদ্র পীড়িত এলাকায় এ কর্মসূচি জারি রেখেছেন অনেকেই। 

সর্বোপরি এই কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য আমাদের সকলকে মানসিক স্থিরতা বজায় রেখে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এক হয়ে একযোগে কাজ করা উচিত। জনগণ সরকার সবাইকে এক ইউনিট হয় এই কঠিন সময়ে একজন আরেকজনের হাতিয়ার হয়ে কাজ করা উচিত। আল্লাহ আমাদের সবাইকে মানসিক শান্তি ও সমৃদ্ধি দান করুন। আমিন।

লেখক: হেড অফ এইচআর, স্টার সিনেপ্লেক্স

এমবি//


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


টেলিফোন: +৮৮ ০২ ৫৫০১৪৩১৬-২৫

ফ্যক্স :

ইমেল: etvonline@ekushey-tv.com

Webmail

জাহাঙ্গীর টাওয়ার, (৭ম তলা), ১০, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

এস. আলম গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান

© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি