ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪

আস্থা অর্জনে হোঁচট খাচ্ছে রাইড শেয়ারিং

মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ

প্রকাশিত : ২৩:৫১, ১০ মে ২০১৯ | আপডেট: ১৮:১০, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৯

বর্তমানে একুশে টেলিভিশন’র নিজস্ব প্রতিবেদক। তিনি দৈনিক ইত্তেফাক, ডেইলি নিউএইজ, এনটিভি’র কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক ছিলেন ও বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি’র নেতৃত্ব দিয়েছেন। একুশে গ্রন্থমেলা-২০১৭’তে প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘আসমত আলীর অনশন’ প্রকাশিত হয়। তার বহু গবেষণা প্রবন্ধ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থাপিত হয়েছে।

যানজটের মধ্যে সস্তি, নিরাপদ, আরাম ও দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছতে রাইড শেয়ারিং বেশ জনপ্রিয় এক পরিবহন ব্যবস্থার নাম। বিগত ৩ থেকে ৪ বছরের মধ্যে বাংলাদেশে অ্যাপস ভিত্তিক রাইড শেয়ারিং মানুষের প্রত্যাশা অনুযায়ী সেবা দিয়ে থাকলেও সেবার ক্ষেত্রে সম্প্রতি কিছুটা চিড় ধরেছে। নিরাপত্তা ও আইনের প্রশ্নে কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে রাইড শেয়ারিং।

অ্যাপস ভিত্তিক এ রাইড শেয়ারিং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখলেও মানুষের কাছে আস্থা অর্জন করতে গিয়ে যেন হোঁচট খাচ্ছে বারবার। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি সমস্যার কারনে জনবিমূখ হওয়ার সম্ভবনাও দেখা দিয়েছে রাইড শেয়ারিং এর ক্ষেত্রে। নিয়ম না মেনে রাইড দেওয়া, রাতে নির্ধারিত ভাড়ার চেয়েও বেশি ভাড়া দাবি করা, অসাধু চক্রের দৌরাত্ম, যৌন হয়রানির শিকার হওয়া, ট্রাফিক আইন না মেনে চলা, মাত্রাতিরিক্ত গতিতে যানবাহন চলানোসহ বিভিন্ন অনিয়ম ও খামখেয়ালিপনার কারণে রাইড শেয়ারিং তার স্বকীয়তা হারাতে বসেছে।

রাইড শেয়ারিং এর প্রতিষ্ঠানসমূহের অ্যাপস ব্যবহার করে বাইক বা কার চালাতে যে সব কাগজপত্র প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে থাকে তার সত্যতা নিশ্চিতে নেই কোন পদক্ষেপ। ‘পাঠাও’ এর ওয়েব সাইটের মাধ্যমে জানা যায়, কাউকে রাইডার হতে হলে অ্যান্ড্রয়েড ফোন থাকতে হবে, ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকতে হবে, বাইক বা কারের রেজিস্ট্রেশন থাকতে হবে, জাতীয় পরিচয় পত্র থাকতে হবে। এ সব কাগজপত্র নিলেও তার সত্যতা যাচাই করার ক্ষেত্রে কোন গুরুত্বই দিচ্ছে না প্রতিষ্ঠানটি। সঠিক কাগজপত্র থাকলেও অনেক রাইডার ঠিক মত বাইক বা কার চালাতে পারে না বলেও জানা যায়। এতে করে সড়ক দুর্ঘটনার সম্ভব থেকেই যায়।

উবার-পাঠাও নিবন্ধন প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ করে নিরাপত্তা ব্যবস্থার অনেক ঘাটতি দেখা যায়। কেউ এখানে সহজেই ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে নিবন্ধন করতে পারে। রাইড শেয়ারিং ব্যবহারকারী বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নিরাপত্তাহীনতা ও চালকের উপর ভারসার বিষয়টি এখন বেশ বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।

ধানমন্ডি এলাকার একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইরফান একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে বলেন, রাইড শেয়ারিং এর চালককে না চিনে শুধু মাত্র প্রতিষ্ঠানের উপর ভরসা করেই গাড়িতে চড়তে হয়। কিন্তু উঠে যদি দেখা যায়, চালক বেশ অনাড়ি এবং দ্রুতগতির। তখন ঐ অ্যাপস কোম্পানির উপর আর বিশ্বাস থাকে না। অনেক সময় চালক অসাদচারণ করে থাকেন এবং এ ক্ষেত্রে ব্যবহারকারীর কিছুই করার থাকে না।

মতিঝিল থেকে ঈতিশা হোসেন নামের এক ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমি প্রতিদিনই রাইড শেয়ারিং এর বাইকে করে বাসায় যাওয়া-আসা করি। সব সময় চালক ভালো হন না। এটা ঠিক যে খারাপ কিছু ঘটে গেলে হয়ত অপরাধীদের পাকড়াও করা যাবে। কিন্তু চালকরা অপরাধ করবেন না এমন নিশ্চয়তা তো অ্যাপস কোম্পানি দিচ্ছে না। আর নিয়ম না মেনে ইচ্ছে মত চালানোর অভিযোগ তো আছেই।’ এ ক্ষেত্রে চালকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ ও অ্যাপস কোম্পানিকে সঠিক দায়িত্ব নিতে হবে বলে মনে করেন ঈতিশা। কিন্তু পাঠাওয়ের ক্ষেত্রে চালক কিংবা গ্রাহকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার পদ্ধতি খুঁজে পাওয়াই কঠিন। ভাড়া নিয়ে অভিযোগ জানানোর কোনো ক্ষেত্রও সেখানে নেই। `হিস্ট্রি` অংশে অভিযোগের সুযোগ থাকলেও সেটিতে প্রবেশ করার প্রক্রিয়া জটিল ও সময় সাপেক্ষ।

সম্প্রতি রাজধানীতে উবার পরিচালিত `উবার মোটো`র দুর্ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী নিহত হওয়ার পর এসব প্রসঙ্গ আবারও আলোচিত হচ্ছে। পুলিশ জানিয়েছে উবার চালক যে ঠিকানা দিয়ে নিবন্ধন করেছিলেন, তা ছিল ভুয়া, যা যাত্রী নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ।

এদিকে, প্রায় আরও এক বছর আগে রাইড শেয়ারিং নীতিমালা হলেও সে অনুযায়ী সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর নিবন্ধন হয়নি। নীতিমালার কয়েকটি ধারা নিয়ে সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের আপত্তি এবং পুলিশের পৃথক কয়েকটি সুপারিশের কারণে নীতিমালা এখন পর্যন্ত কাগজে-কলমেই আটকে আছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংশ্নিষ্ট কোনো পক্ষের সঙ্গে কথা না বলে শুধু আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নীতিমালা তৈরির কারণে এটি সর্বতোভাবে গ্রহণযোগ্য নীতিমালা হয়নি।

রাজধানীর কারওয়ান বাজারের সাইয়্যেদ আলম জানান, রাইড শেয়ারিং বিশেষ করে উবার বা পাঠাও তে ভাড়া নিয়ে বেশ ঝামেলা হয়। তিনি কারওয়ান বাজার থেকে একদিন পুরান ঢাকায় যেতে পাঠাও এর বাইক ডাকলে ১৫০ টাকা দেখালেও গন্তব্যে পৌঁছে দেখি ভাড়া ২৫০ টাকা। তিনি জানান, অনেক সময় রাইডার চুক্তি গ্রহণ করেও ব্যবহারকারীকে তুলে না নিয়ে চলে যান। এ সময় রাইডার সরাসরি অন্য কারও সঙ্গে চুক্তি করে চলে যান। এতে রাইডার দুই জনের কমিশনই পান। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বিষয়টির সত্যতা পাওয়া যায়।

নিরাপত্তা, ট্রাফিক আইন অমান্য করা, রাইডের নিয়ম না মানার বিষয়ে পাঠাও রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানের জনসংযোগ শাখার কর্মকর্তা ওমর ফারুখ একুশে টেলিভিশন অনলাইকে বলেন, ‘রাইড শেয়ারিং এর নিয়ম যদি কোন রাইডার না মানেন তাহলে আমরা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। আমাদের জরুরি কল করে অভিযোগ দিলেই আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করি। এখানে রাইডার ও ব্যবহারকারী দুই জনই আমাদের গ্রাহক হওয়া আমাদেরকে দুই দিক থেকেই ভেবে দেখতে হয়। তবে সব সময়ে যে ব্যবহারকারীও নিয়ম মেনে চলেন বা ভালো ব্যবহার করেন তা কিন্তু নয়।’

যৌন হয়রানির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এমন কোন অভিযোগ আমরা এখনও পাইনি। অনেক সময় রাইডার সারা দিন বাইক বা কার চালিয়ে কিছু অসংলগ্ন ব্যবহার করতে পারে কিন্তু বিষয়টি আমরা কঠোর মনিটরিং করছি।’

কেন তার প্রতিষ্ঠানকে মানুষ ভরসা করবে এমনটি জানতে চাইলে তিনি জানান, তারা রাইডারকে প্রশিক্ষণ দেন। তার ব্যবহার থেকে শুরু করে সব কিছুতেই কোম্পানি দেখভাল করে থাকে। নিয়ম-কানুন শিখানো হয় তারপর তাকে রাস্তায় পাঠানো হয়।

রাজধানী ঘুরে প্রায় ২০ জন রাইডার (বাইক ও কার চালক) এর সঙ্গে কথা হয়। তারা একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে জানান, পূর্বে রাইড শেয়ারিং-এ বাইক বা কার চালিয়ে বেশ ভালোই উপার্জন হতো। এখন যে হয় না তা নয় কিন্তু এখন ব্যবহারকারীকে বেশি ছাড় অফার দেওয়ার করণে আমরা নগদ টাকাটা পাই না। আগে দৈনিক বা সাপ্তাহিক টার্গেট কম ছিল এখন অনেক বেশি। তবে বিয়ষটির নির্দিষ্ট কোন টার্গেট নাই। এই টার্গেট ওঠা নামা করে।

রাইড শেয়ারিং সার্ভিস নীতিমালা ২০১৭ তে কিছু বিষয় সংশোধন করার দাবি জানিয়ে আসছে রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্যোক্তরা। নীতিমালার পাঁচটি বিষয়ে তারা আপত্তি তুলেছে। নীতিমালা হওয়ার পর বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ’র (বিআরটিএ) কাছে ১৬টি সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান নীতিমালা অনুযায়ী নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের সূত্র মতে জানা যায়, মোটর বাইক ১১৭৮৪ ও কার ৮৮৫৩ (উবার), মোটর বাইক ২০০০০ ও কার ২০০০ (পাঠাও), মোটর বাইক ১১৭৮৪ ও কার ৬০১ (পিকমি), মোটর বাইক ২৬১১০ ও কার ১১৬১ (ওভাই), মোটর বাইক ৩০৮২২ ও কার ১৬৫৩ (সহজ), মোটর বাইক ৪৩৮৬ (চালডাল) রাজধানী ঢাকায় চলছে। এ ছাড়া অন্যান্য পরিবহনের মধ্যে বাস-মিনিবাস ৭০০০, সিএনজি চালিত অটো রিক্সসা ১৪০০০ ও ট্যাক্সি ক্যাব চলছে ৫০০টি।

রাইড শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম হিসেবে রাজধানীতে উল্লেখযোগ্য হলো স্যাম, উবার, পাঠাও, মুভ, লেটস গো, ইজিয়ার, ওভাই, ডাকো ক্যাপ্টেইন, সহজ রাইড, আমার বাইক। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান শুধু মোটরসাইকেল অথবা শুধু প্রাইভেটকারের শেয়ারিং সেবা দিচ্ছে। তবে বেশিরভাগই মোটরসাইকেলের পাশাপাশি প্রাইভেটকারও জোগান দিচ্ছে। মুভ বা ওভাইয়ের মতো প্ল্যাটফর্মগুলোতে বাইক বা গাড়ির পাশাপাশি পাওয়া যাচ্ছে সিএনজি, মাইক্রোবাস এমনকি পিকাপও।

এসি

 


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি