ঢাকা, শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪

ইতিহাসে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবর

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৫:১৪, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৯

জহিরুদ্দিন মুহম্মদ বাবর। ভারতীয় উপমহাদেশে পরাক্রমশালী মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি শুধু ঐতিহাসিক চরিত্র নন, বিতর্কিতও বটে। ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইন্স ডে। কিন্তু এই দিনটি যে এক ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের জন্মদিনও বটে, সেটা খুব কম মানুষই জানেন। ১৪৮৩ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি বর্তমান উজবেকিস্তানের আন্দিজানে জন্ম হয়েছিল মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবরের।

সাধারণত মুঘল সম্রাটদের মধ্যে আকবর বা শাজাহানের নামই সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়ে থাকে। কিন্তু ইতিহাস বলে- সংস্কৃতি, সাহসিকতা আর সেনা পরিচালনার ক্ষেত্রে বাবর নিঃসন্দেহে এক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন। বাবর যদি ভারতে না আসতেন, তাহলে এ দেশের সংস্কৃতি হয়তো এতটা বিচিত্র হওয়ার সুযোগ পেত না। ভাষা, সংগীত, চিত্রকলা, স্থাপত্য, পোশাক অথবা খাবার-দাবার—প্রতিটা বিষয়েই মুঘলদের অবদান অনস্বীকার্য।

কথিত আছে বাবর শক্ত সমর্থ এবং শারীরিক ভাবে সুস্থ ছিলেন। তিনি কেবল ব্যায়ামের জন্য দু’কাঁধে দু’জনকে নিয়ে ঢাল বেয়ে দৌড়ে নামতেন। কিংবদন্তী আছে, বাবর তার সামনে পড়া সবগুলো নদী সাঁতরে পার হতেন এবং উত্তর ভারতের গঙ্গা নদী দু’বার সাঁতার দিয়ে পাড়ি দিয়েছিলেন।

১৪৯৪ সালে মাত্র বার বছর বয়সে বাবর প্রথম ক্ষমতা লাভ করেন, তিনি ফরগানার সিংহাসনে আরোহণ করেন যা বর্তমানে উজবেকিস্তান নামে পরিচিত। তার চাচা অনবরত তাকে সিংহাসন চ্যুত করার চেষ্টা করেছিলেন এবং তার অন্যন্য শত্রুও ছিল। একসময় সে বাবরকে ক্ষমতাচ্যূত করতে সফল হয়। ফলে জীবনের বেশকিছু সময় তাকে আশ্রয়হীন এবং যাযাবর থাকতে হয়। এসময় তার সাথে শুধুমাত্র তার বন্ধু ও চাষীদের যোগাযোগ ছিল। ১৪৯৭ সালে বাবর সমরকন্দের উজবেক শহরে আক্রমণ চালান এবং ৭ মাস পরে শহর দখল করতে সমর্থ হন। ইতিমধ্যে প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার দূরের ফরগানায় কিছু নোবেলদের বিদ্রোহের কারণে তাকে স্থানটি হারাতে হয়। ফরগানা পূনরুদ্ধারের জন্য অগ্রসর হলে তার বাহিনীর লোকজন তাকে ফেলে চলে যায়, ফলে তাকে সমরকন্দ ও ফরগানা উভয়কেই হারাতে হয়।

১৫০১ সালে বাবর আবার সমরকন্দের দখল নিতে প্রস্তুতি নেন, তবে আবারো তার পরাক্রমশালী প্রতিপক্ষ মোহাম্মদ শেবানী খান এর কাছে পরাজিত হন। তিনি তার কিছু অনুসারী নিয়ে পালিয়ে আসতে সমর্থ হন। পরবর্তীতে বাবর একটি শক্তিশালী দল গঠনে মনযোগী হন এবং প্রধানত তাজিক ও বাদাক্‌শানদেরকে তার দলে অন্তর্ভুক্ত করেন। ১৫০৪ সালে তুষার সমৃদ্ধ অঞ্চল হিন্দুকুশ পর্বত অতিক্রম করেন এবং কাবুল দখল করেন। এর ফলে তিনি একটি নতুন ধনী রাজ্য লাভ করেন এবং নিজের ভাগ্য পূণর্প্রতিষ্ঠিত করেন এবং বাদশাহ উপাধি গ্রহণ করেন।

ভারতে রাজ্য স্থাপন পরিকল্পনা সফল করতে বাবরকে একের পর এক নানা বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করতে হয়। তিনটি প্রধান যুদ্ধে সাফল্য অর্জন করার পর বাবরের স্বপ্ন সফল হয়। এই তিনটি যুদ্ধ হল পানিপথের প্রথম যুদ্ধ, খানুয়ার যুদ্ধ ও ঘর্ঘরা যুদ্ধ।

(ক) পানিপথের প্রথম যুদ্ধ [The first battle of Panipat] (১৫২৬) :
বাবরের ভারত আক্রমণের প্রথম সুযোগ আসে যখন ইব্রাহিম লোদির বিক্ষুব্ধ একটি গোষ্ঠী ইব্রাহিম লোদিকে শায়েস্তা করার উদ্দেশ্যে বাবরকে আমন্ত্রণ জানান। এই আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে বাবর প্রথমে লাহোর অধিকার করেন। এরপর তিনি পাঞ্জাব অধিকার করে ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির সুলতান ইব্রাহিম লোদির সঙ্গে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। ইব্রাহিম লোদি এই যুদ্ধে পরাস্ত হন। বাবরের সামরিক দক্ষতা ও শৌর্যবীর্যের প্রমাণ পানিপথের প্রথম যুদ্ধ। কিন্তু এই যুদ্ধে মুঘল সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ হলেও, এর দ্বারা বাবরের ভারত বিজয় সম্পূর্ণ হয়নি।

(খ) খানুয়ার যুদ্ধ [Battle of Khanua] (১৫২৭) :
আফগান সামরিক নেতারা ও রাজপুতবীর মহারানা সঙ্গ (রাণা সংগ্রাম সিংহ) ছিলেন বাবরের সাম্রাজ্য বিস্তারের পথে প্রধান অন্তরায়। পানিপথের যুদ্ধের পর রানা সঙ্গের সাথে বাবরের সংঘর্ষ ছিল অনিবার্য। রানা সঙ্গ ইব্রাহিম লোদীর চেয়ে অনেক শক্তিশালী ছিলেন। কিছু কিছু আফগান দলপতি তাঁর সঙ্গে যোগ দেন। এই বিপদের দিনেও কিন্তু সমস্ত আফগান দলপতি তাঁর সঙ্গে হাত মেলান নি। ১৫২৭ সালে খানুয়ার যুদ্ধে রাজপুতদের চরম পরাজয় ঘটে। খানুয়ার যুদ্ধ পানিপথের যুদ্ধের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ, কেননা ভারতে মুঘল সাম্রাজ্য বিস্তারের সবচেয়ে বড় বাধা ছিল এই রাজপুতরা। সুতরাং তাদের পরাজয়ের ফলে বাবরের কাজ অনেক সহজ হয়ে যায়। তাঁর সাম্রাজ্যের ভিত দৃঢ়ভাবে স্থাপিত হয়।

(গ) ঘর্ঘরার যুদ্ধ [Battle of Gogra] (১৫২৯) :
এরপর বাবর আফগান দলপতিদের দমন করতে মনস্থ করেন। বাংলা ও বিহারের আফগান দলপতিদের শায়েস্তা তিনি ঘর্ঘরা ও গঙ্গানদীর সঙ্গমের কাছে একটি প্রান্তরে মিলিত হন। ১৫২৯ সালে ঘর্ঘরার যুদ্ধে তিনি আফগানদের সম্পূর্ণরূপে পরাস্ত করে উত্তর ভারতের বিস্তৃত এলাকা দখল করেন। তাঁর সাম্রাজ্য অক্ষ নদী থেকে ঘর্ঘরা নদী পর্যন্ত ও হিমালয় পর্বত থেকে গোয়ালিয়র পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। অবশ্য এর মধ্যে কিছু কিছু জায়গায় তাঁর কর্তৃত্বের বন্ধন ছিল খুব শিথিল। বাবর তাঁর সাম্রাজ্য দীর্ঘ দিন ভোগ করতে পারেনি। এমনকি এই নব প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্যকে দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করার জন্য কোনো শাসন ব্যবস্থাও তিনি চালু করতে পারেন নি।

হিন্দুস্তানের একের পর এক যুদ্ধে তিনি বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, তার স্বাস্থ্য দ্রুতই ভেঙ্গে পড়ছিলো। তাছাড়া দিল্লি আর আগ্রা অধিকার করার পর পরই ইব্রাহিম লোদি মা বাবরের খাবারে বিষ প্রয়োগ করে বাবরকে হত্যার চেষ্টা করেছিলেন। সেইবার বাবর বেঁচে গেলেও বিষের প্রভাব তার শরীরে রয়ে গিয়েছিলো। খুব ধীরে ধীরে হলেও বিষাক্রান্তের ফলে শরীরের ভেতর থেকে দুর্বল হচ্ছিলেন তিনি।

এই ঘটনার পর পরই তাকে বেশ বড় এবং সিদ্ধান্তমূলক দুটি যুদ্ধে নামতে হয়। সব মিলিয়ে তার শরীরের অবস্থা বেশ খারাপই যাচ্ছিলো। এছাড়া তার পুত্র আলোয়ার মির্জার মৃত্যু আর তার কিছুদিন পরেই প্রিয় পুত্র হুমায়ুনের অসুস্থতা পিতা হিসেবে বাবরকে মানসিকভাবে বেশ দুর্বল করে দিয়েছিলো। হিন্দুস্তানের আবহাওয়াও বাবরকে কম ভোগায়নি। সব মিলিয়ে হিন্দুস্তানে আসার পর থেকেই বাবর বিভিন্ন মানসিক আর শারিরিক অসুস্থতায় ভুগছিলেন।

হিন্দুস্তান বাবরের নিকট অপছন্দীয় হলেও তিনি নিজের ভাগ্য মেনে নিয়েছিলেন। তিনি জানতেন, তার ভবিষ্যৎ বংশধররা ঠিকই একদিন হিন্দুস্তানকে নিজেদের মতো করে সাজিয়ে নিবে। আর তারা হিন্দুস্তানকে মন থেকেই আপন করে নিবে। বাবরের ধারণা কোনো অংশেই ভুল প্রমাণিত হয়নি। বাবরের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ঠিকই হিন্দুস্তানকে ভালোবেসে শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছিলেন। নিজেদের মন মতো নানা রঙ্গে তারা হিন্দুস্তানকে সাজিয়ে তুলেছিলেন। আজও হিন্দুস্তানের পথে প্রান্তরে তাদের ভালোবাসার সেসবের ছাপ খুঁজে পাওয়া যায়।

মৃত্যুর পূর্বে সম্রাট বাবর তার পুত্রের জন্য ফারসিতে ‘ওয়াসিয়াতনামা-ই-মাখফি’ বা ‘গোপন উইল’ শিরোনামে একটি গোপন নির্দেশনামা রেখে যান। এই উইলটি ভারতের ভুপালের হামিদা লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত ছিলো। নানলাল সি মেহতা (তিনি এনসি মেহতা নামেই বেশি জনপ্রিয়) এই উইলটি সর্বপ্রথম ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন। সাহাদত হোসেন খানের ‘মোগল সাম্রাজ্যের সোনালী অধ্যায়’ শীর্ষক গ্রন্থটির সৌজন্যে উইলটির বাংলা অনুবাদ পাঠকদের জন্য দেয়া হলো।

    ‘সকল প্রশংসা মহান আল্লাহর জন্য।

    নাসরুদ্দিন মুহাম্মদ হুমায়ুনের নিকট জহির উদ-দিন মুহাম্মদ বাবর বাদশাহ গাজির গোপন উইল। আল্লাহ তোমাকে দীর্ঘজীবী করুন। সাম্রাজ্যের স্থিতিশীলতার জন্য আমি তোমার নিকট এই নির্দেশাবলী রেখে যাচ্ছি। আমার প্রিয় পুত্র, হিন্দুস্তান একটি বৈচিত্রপূর্ন দেশ। মহান আল্লাহর কাছে অসংখ্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি যে, তিনি হিন্দুস্তানকে আমার সাম্রাজ্য হিসেবে দান করেছেন। তোমাকে সকল ধর্মীয় গোঁড়ামির উর্ধ্বে উঠে প্রত্যেক ধর্মের মূলনীতি অনুযায়ী ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তবে, বিশেষ করে হিন্দুস্তানে গরু জবাই থেকে বিরত থাকতে হবে। গরু জবাই থেকে বিরত থাকাই হচ্ছে এ দেশের মানুষের মন জয় করে নেয়ার একমাত্র উপায়। এই কাজটি করলে সাম্রাজ্যের হিন্দু প্রজারা তোমার অনুগত থাকবে। রাজকীয় নিয়ন্ত্রণের আওতাভুক্ত প্রতিটি সম্প্রদায়ের মন্দির ও উপাসনালয় ধ্বংস করা থেকে বিরত থাকতে হবে। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবে, যেন তুমি তোমার প্রজাদের নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারো। এর ফলে প্রজারাও তোমাকে নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবে। উদারতার সাহায্যে এই দেশে ইসলামকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তরবারির সাহায্যে নয়। শিয়া ও সুন্নীদের মতপার্থক্যকে আমলে নিবে না। শিয়া ও সুন্নীদের মতপার্থক্য হলো ইসলামের ভেতর দিকের একটি দুর্বলতা। চারটি মূলনীতিতে সকল ধর্মের প্রজাদের এক কাতারে নিয়ে আসবে। হযরত তাইমূর সাহিব-কিরানির শিক্ষা স্মরণ রাখবে, যাতে শাসনকাজে তুমি পরিপক্কতা অর্জন করতে পারো। কখনো ভাইদের বিরোধিতা করবে না, যদিও এর প্রয়োজন দেখা দেয়। প্রথম জমাদিউল আউয়াল, ৯৩৫ হিজরি (১১ জানুয়ারী, ১৫২৯ সাল)’

এসএ/

 

 


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি