ঢাকা, মঙ্গলবার   ১৯ মার্চ ২০২৪

এ ছবি তো অমূল্য!

সেলিম জাহান

প্রকাশিত : ১৫:১৫, ৬ আগস্ট ২০২০ | আপডেট: ১৫:২৭, ৬ আগস্ট ২০২০

ছবি কৃতজ্ঞতা : প্রয়াত আজমল হক

ছবি কৃতজ্ঞতা : প্রয়াত আজমল হক

কামাল জানি, তোর জন্মদিন উপলক্ষ্যে আমার এ শুভেচ্ছা বার্তা কোনদিনই তোর হাতে পৌঁছুবে না। কিন্তু তবু বড় মায়ায় তোকে লিখছি।

তোর বয়স আজ ৭১ হল। আমরাও সে সংখ্যা ছুঁই ছুঁই করছি। আসল ব্যাপার কি জানিস? দিন, মাস, বছর পেরিয়ে আমাদের বয়স বেড়েছে, কিন্তু তুই ব্যাটা ঐ ২৫ এ রয়ে গেলি। দ্যাখ না, আমাদের বুড়ো বয়সের ছবি আছে, তোর কিন্তু ২৫ এর পরে ছবি নেই। তোর বয়স ২৫ এর পরে বাড়লো না, আর আমরা বয়সের সেতুতে একটার পর একটা সেতু-স্তম্ভ পার হয়ে এলেম। তোকে দেখে আমার হিংসা হয়, বুঝলি রে চিরতরুণ!

ক’দিন আগেই খুঁজছিলাম একটা দরকারী কাগজ। পাচ্ছিলাম না কোথাও। এধার ওধার ঘাঁটতে ঘাঁটতে হঠাৎ বেরিয়ে এলো পুরোনো এক হলদেটে বড় খাম। জানি ওখানে থাকার কথা নয় প্রয়োজনীয় কাগজটির, তবু কি মনে করে খুলতে চেষ্টা করলাম খামটির মুখ। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে হুড়মুড় করে খামটির সব কাগজপত্র ছড়িয়ে পড়ল মেঝেতে। বিরক্ত লাগল নিজের ওপরে এই অহেতুক কাজ বাড়ানোর জন্য।

নীচু হয়ে কাগজপত্র তুলতে গিয়ে হঠাৎ দেখলাম, অন্য কাগজের ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে একটি ছবি। একটু বিবর্ণ ছবিটা, এখানে ওখানে রং চটকে গেছে, মুচড়েছেও কিছুটা। ওটা হাতে নিতে নিতে মনে হল, বহুকালের পুরোনো কোন ছবি সন্দেহ নেই। চোখের সামনে ছবিটা আনতেই হঠাৎ পৃথিবীটা দুলে উঠল। বসে পড়লাম সামনের চেয়ারে।

এ কি, এ কোন ছবি? কোথায় লুকিয়েছিল এ ছবি এত কাল? কেমন করে ওটা বন্দী হয়েছিল একটি বিবর্ণ হলদে খামে? এ ছবি তো ১৯৭৫ সালের ১২ আগষ্টের ছবি। রাত্তির তখন ন’টার মতো। ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্রের মিলনায়তনে তোলা। তুলেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান চিত্রগ্রাহক প্রয়াত আজমল হক - আমাদের সতীর্থ রোকেয়া মীনাক্ষী হকের বাবা। সবে আমরা, মানে সলিমুল্লাহ হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্ত: হল বিতর্ক প্রতিযেগিতায় সূর্য্যসেন হলকে হারিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো শিরোপা পেয়েছি।

ঐ তো ছবিতে হাস্যোজ্জ্বল তুই। বাঁ হাতে তার আমাদের বিজয়-শিরোপাটি, ডান হাতে সে ধরে আছে আমার ডান হাত। কামাল দাঁড়িয়ে আছে মঞ্চের সামনে নীচে, আমি আসীন সাদুর কাঁধে মঞ্চের ওপরে। মঞ্চ আর তার আশপাশে আনন্দে উদ্বেলিত সলিমুল্লাহ হলের ছাত্ররা। মনে হল, এ ছবি তোলার ৪৮ ঘন্টা পরেই তো কামালের জীবন প্রদীপ নিভে গেছে নৃশংস আততায়ীদের হাতে। খুব সম্ভবত: এটাই ওর জীবনের শেষ ছবি। এ ছবি তো অমূল্য!

আমার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। আমার চারপাশ লুপ্ত হয়ে গেল, বর্তমান মুছে গেল, চলচ্চিত্রের মতো সময়ের চাকা ঘুরতে লাগল পেছনে - ৪৩ বছর আগে। ঐ তো পরিস্কার দেখতে পাচ্ছি ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের আলোকোজ্জ্বল মিলনায়তন। করতালি, আনন্দ-চীৎকার আর উল্লাসে ফেটে পড়ছে মিলনায়তন। সবে ঘোষিত হয়েছে যে এক তীব্রতম প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরে সলিমুল্লাহ হল দ্বিতীয় আন্ত:হল বিতর্ক প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্বে সূর্য্যসেন হলকে হারিয়ে শিরোপা অর্জন করেছে। আমার সহ-বিতার্কিকেরা দলনেতা হিসেবে আমার হাত আঁকড়ে ধরেছে যুদ্ধ জয়ের গর্বে, আনন্দে, তৃপ্তিতে।

পরিস্কার মনে আছে সেদিনের পুরস্কার প্রদানের পালাটির কথা। ঐ তো বিজয়ী দলের দলনেতা হিসেবে শিরোপা গ্রহন করছি জাতীয় সংসদের অধ্যক্ষ আবদুল মালেক উকিলের কাছ থেকে। পাশে সহাস্যে দাঁড়িয়ে আছেন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের সভাপতি অধ্যাপক আবদুল মতিন চৌধুরী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম।

পুরস্কার বিতরনী শেষে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ মঞ্চ থেকে নেমে গেলে যেন বাঁধ ভেঙ্গে গেল। তুমুল আনন্দ-নৃত্যে, গানে, উচ্চকণ্ঠ ধ্বণিতে ফেটে পড়ল সারা মিলনায়তন। তার নেতৃত্বে শেখ কামাল। সলিমুল্লাহ হলের একদল ছাত্র ততক্ষনে হৈ হৈ করতে করতে মঞ্চ দখল করে নিয়েছে - তাদের আনন্দ-চীৎকারে কান পাতা দায়, তাদের উদ্দাম নৃত্যে মিলনায়তন মঞ্চ টলটলায়মান। হঠাৎ অনুভব করলাম, আমি আর মঞ্চভূমিতে দাঁড়িয়ে নেই - উঠে গেছি একজনের কাঁধে - খুব সম্ভবত: শক্তিমান সাদুর কাঁধেই বোধহয়।

আমার ডানহাতে তখন কাঠ আর তামায় তৈরী ভারী বিজয়-শিরোপা। তাই নিয়ে সাদুর কাঁধে আমি টলটলায়মান। বাঁ হাতে চেষ্টা করছি ওকে ধরে রাখতে। আমার অবস্হা দেখে মঞ্চের একেবার পাশ ঘেঁসে ছুটে আসে কামাল। আমার হাত থেকে তুলে নেয় ঐ ভারী শিরোপা তার বাঁ হাতে। ডান হাত উঁচু করে দৃঢ়ভাবে ধরে রাখে আমার ডান হাত - যাতে আমর ভারসাম্য রক্ষিত হয়, যাতে আমি পড়ে না যাই। ঠিক সে সময়েই ঝলকে ওঠে আজমল হকের ক্যামেরা - তৈরী হয় ইতিহাস।

মনে আছে সে রাতে ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র থেকে কামাল আমাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে। ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ে আসবেন - চারদিকে সাজ সাজ রব। অপরাজেয় বাংলার স্হাপত্যে ঝাড়-পোছ চলছে, রং দেয়া হচ্ছে, ঝাঁ ঝাঁ বাতি তার চারদিকে। ‘চল্, চল্, হামিদ ভাইয়ের তাজমহল দেখে আসি’। বলেছিল সে। ঐ এক ঠাট্টা ছিল আমাদের। অপারজেয় বাংলার স্হাপত্যের প্রতি সে সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক সম্পাদক ম. হামিদের নিবিড় টানের কারনেই আমরা এ নিয়ে হামিদ ভাইকে ক্ষ্যাপাতে চেষ্টা করতাম। হামিদ ভাই মিষ্টি হাসতেন। ১৬ই আগষ্ট আমার অর্থমিতি পরীক্ষা। আমি গাঁই গুঁই করছি দেখে কামাল লোভ দেখালো, ‘চল্, চা খাওয়াবো তোকে’।

না, ফেরাতে পারি নি ওকে। ও ছাড়বার পাত্র ছিল না, যেতেই হয়েছিল ওর সঙ্গে অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে।হামিদ ভাইকে পেয়েছিলাম সেখানে, আর ভাগ্যক্রমে মিলে গিয়েছিল এক চা’ওয়ালা। দু’ এক কথার পরে হামিদ ভাই তার তদারকি-কর্মে ফেরত গিয়েছিলেন। কামাল আর আমি কিছু এলোমেলো গল্প করেছিলাম। এক পর্যায়ে আমি উঠে পড়লাম। পরীক্ষা প্রস্তুতির তাড়া ছিল আমার। যখন চলে আসি, তখন কামাল আমার হাত ধরেছিল আনন্দের উদ্বেলতায়, বন্ধুত্বের উষ্ণতায়, সখ্যতার মমত্বে। পরিস্কার মনে আছে, বিদায় মুহূর্তে ও বলেছিল, ‘দেখা হবে’।

না, আর দেখা হয় নি আমাদের - কোনদিন আর হবে না। আজ যখন ঝাপসা চোখে ছবিটির দিকে তাকিয়েছি, তখন মনে হয়েছে, সে রাতে কামালের এক হাত আমার ভার তুলে নিয়েছিল, অন্য হাত আমাকে ধরে রেখেছিল যাতে আমি ভারসাম্য না হারাই, যাতে আমি পড়ে না যাই। কিন্তু মাত্র ৪৮ ঘন্টার মাথায় হত্যাকারীর গুলি যখন ওর দিকে ছুটে গিয়েছে, ঝাঁঝরা করে দিয়েছে ওকে; ও যখন পড়ে গিয়েছিল, তখন তো ওকে আমি ধরতে পারি নি, ওকে তো আমি রক্ষা করতে পারি নি, ওকে আমি বাঁচাতে পারি নি। কামাল, এ দু:খ আমি কোথায় রাখি? এ লজ্জা আমি কি করে ঢাকি? পৃথিবীর কোন অন্ধকার গহ্বরে আমি লুকোই?
এসএ/
 


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


টেলিফোন: +৮৮ ০২ ৫৫০১৪৩১৬-২৫

ফ্যক্স :

ইমেল: etvonline@ekushey-tv.com

Webmail

জাহাঙ্গীর টাওয়ার, (৭ম তলা), ১০, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

এস. আলম গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান

© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি