ঢাকা, মঙ্গলবার   ১৯ মার্চ ২০২৪

করোনায় প্রাপ্তি

সোহাগ আশরাফ

প্রকাশিত : ১২:৩৭, ৩ এপ্রিল ২০২০

করোনা সংক্রমন নিয়ে আতঙ্কের মাঝেও রয়েছে বেশ কিছু খুশির খবর। আতঙ্ক, ভয়, মৃতুর সঙ্গে প্রাপ্তিও অনেক। ভাইরাসটির প্রকোপ আটকাতে বন্ধ রয়েছে শপিং মল, কারখানা, অফিস আদালত। সেই সঙ্গে রাস্তায় কমেছে পরিবহনের সংখ্যা। ফলে বায়ু ও পানি দূষণ কমেছে অনেক। ইতিমধ্যে এর সুফলও মিলছে প্রকৃতিতে।

শুধু প্রকৃতি নয়, বন্ধন সৃষ্টি হয়েছে মানুষে মানুষে। বেড়েছে সৃষ্টিকর্তার প্রতি আনুগত্য। সামাজিক শিষ্টাচার ও পরিচ্ছন্ন জীবন মানুষের মধ্যে একটি বড় পরিবর্তন আনছে। করোনার এই সঙ্কটে ইতিবাচক চিন্তা যদি করা যায় তবে দেখা মিলবে অনেক সুফল।

চলুন দেখে নেওয়া যাক কী কী সুফল ও পরিবর্তন এসেছে এই মহা সঙ্কটের দিনেও-

কমছে দূষণ :

অন্যান্য দেশের মত আমাদের দেশে লকডাউন না থাকলেও বন্ধ রয়েছে সবকিছু। নানা অসুবিধার মধ্যেও কার্যত ঘরবন্দি সিংহভাগ মানুষ। রাস্তা থেকে উধাও যানবাহন। শহরের অধিকাংশ রাস্তা ফাঁকা, শুনসান নিরবতা। এরমধ্যেই বদলে যাচ্ছে রাজধানী শহরের চেনা ছবি। কারণ, ক্রমশ সবুজ হচ্ছে ঢাকা। রাস্তায় যানবাহন না থাকায় উধাও হয়েছে দূষণ। এর ফলে অলি -গলি থেকে রাজপথ সর্বত্রই সবুজ আর সতেজ হচ্ছে গাছপালা।

এখানেই শেষ নয়, দূষণ না থাকায় বাড়ছে দৃশ্যমানতা। খালি চোখে আগের তুলনায় অনেক দূর পর্যন্ত দৃষ্টি যাচ্ছে। অনেক দূরের লক্ষ্যবস্তুকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন মানুষ। সবটাই সম্ভব হয়েছে অঘোষিত লকডাউন জনিত দূষণ রোধের কারণেই।

বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ কমছে, বাড়ছে অক্সিজেনের মাত্রা। এরফলে শ্বাস নিতে সুবিধা হচ্ছে মানুষের।

পরিবেশবিদদের মতে, লকডাউনে মানুষের হাজারো সমস্যা হলেও কিছু সুফল হচ্ছে। তারই প্রমাণ মিলছে শহরগুলোতে। গত কয়েকদিনে ঢাকা শহরের বিভিন্ন পার্কগুলোতে চেনা ছবি পরিবর্তন হয়েছে। সারাবছর শহরের অধিকাংশ গাছপালা থাকে ধুলোয় ভরা। একইভাবে শহরের আইল্যান্ড গুলো সবসময় অপরিচ্ছন্ন অবস্থায় দেখা যায়। কিন্তু গত কয়েক দিনে রাস্তায় সেভাবে লোকজন নেই, যানবাহনও প্রায় চলছেন না বললেই চলে। এর ফলে দূষণ কমছে অনেকটাই।

নেই যানজট :

রাজধানী ঢাকার চিরোচেনা রূপে এসেছি পরিবর্তন। যে যানজটে জনজীবন ছিল বিপর্যস্ত সেখানে এসেছে প্রশান্তি। ঢাকার যেসব রাস্তায় সিএনজি, রিক্সার আনাগোনা লেগে থাকতো, অথবা যেসব গলিতে ফেরিওয়ালার ডাকে সরগরম থাকতো সকাল- দুপুর, সেখানে এখন নীরবতা। বড় সড়ক বা অলিগলিতেও রিক্সা বা সিএনজির দেখা মিলছে না। দখল মুক্ত হয়েছে ফুটপাত।  

সড়ক দূর্ঘটনা কমেছে :

বিশ্বব্যাপী সড়ক, নৌ, রেল ও বিমান পথে চলছে অবরোধ। ফলে সব মাধ্যমেই দূর্ঘটনা কমেছে। নিয়ন্ত্রিত যান চলাচলে এসেছে ঝুঁকিমুক্ত জীবন। আগের মত নেই কোন দুঃসংবাদ।

বেড়েছে সামাজিক বন্ধন :

করোনার এই সঙ্কটের দিনে বিশ্ব আজ কার্যত লকডাউন। মানুষ কর্মস্থল ছেড়ে ঘরের মধ্যে অবস্থান করছে। ফলে দৈনিক কাজের যে ব্যস্ততা তা আজ নেই। পরিবারের সবাই আজ একত্রিত হয়েছে। বসায় বসে সবাই মিলে আড্ডা দিচ্ছে, একে অন্যের সঙ্গে আলাপচারিতায় মেতে উঠেছে, অনেক দিনের না বলা কথা গুলোও তারা বলছেন প্রিয় মানুষটির সঙ্গে। মোবাইল ফোনে আত্মিয়-স্বজনের খোঁজ খবর নিচ্ছেন সবাই।

মানবিক হয়েছে মানুষ :

মানুষে মানুষে দ্বন্দ্ব, বিরোধ, হিংসা অনেকটা কমে এসেছে। বেড়েছে মানবিকগুনাবলি। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা দূর হয়েছে। সহনশীল হয়েছে মানুষ। এখন নিজের সামর্থ অনুযায়ি অন্যের সহায্য করতে চেষ্টা করছে তারা। দরিদ্র-অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে অনেকেই।

দানের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে সবার। মহান আল্লাহ যেখানে এই দানের কথা বারবার বলেছেন- তা এখন উপলব্ধি করতে পারেছে মানুষ।

শুদ্ধাচার ও শিষ্টাচার :

সমাজে ভালো-মন্দ দুটি দিকই বিরাজ করে। তবে মন্দের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে সামাজিক অবক্ষয় দেখা দেয়। কিছুদিন আগে খুন-সন্ত্রাস, ধর্ষন, ছিনতাই ব্যাপকভাবে বেড়ে গেলেও এইদিনগুলোতে সবকিছু নিয়ন্ত্রেণে এসেছে।

সমাজচিন্তাবিদগণ মনে করেন- যা কিছু ভালো আমাদের তা নিয়েই আলোচনা করতে হবে। ভালো নিয়ে আলোচনা করলে সমাজে শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠা পাবে। তাতে আমাদের সমাজ আরও সুন্দরভাবে এগিয়ে যাবে। করোনা সঙ্কট শুদ্ধাচারের পথকে সুগম করে দিয়েছে।

সেই সঙ্গে কিছু শিষ্টাচার মানুষের মধ্য থেকে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল তা আবারও ফিরে এসেছে। বিশেষ করে হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার। কাশি  বা হাঁচির সময় আমরা কিছুদিন আগেও সচেতন ছিলাম না। এখন আমরা টিস্যু ও কাপড় দিয়ে নাক ও মুখ ঢেকে রাখার অভ্যাস গড়ে তুলতে সক্ষম হচ্ছি। এ সময় হাঁচি-কাশির শিষ্টাচারকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।

শুধু করোনার এ সময়ে নয়, সব সময়ই হাত ধোয়া ও হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার মানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিজেকে, আপনজন ও সমাজের অন্যদের নিরাপদ রাখার স্বার্থেই এটি করতে হবে। বিষয়গুলো কিন্তু নতুন করে বলা হচ্ছে না। এর আগে যখন সার্স ও সোয়াইন ফ্লু ছড়িয়ে পড়েছিল, তখনো এসব বলা হয়েছে।

ইতিবাচক চিন্তা :

মানুষকে ইতিবাচক বার্তা দিয়ে উদ্দীপ্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। যে যার মত সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। ব্যাক্তিগত, সাংগঠনিক বা রজনৈতিকভাবেও সচেতন হওয়ার পরামর্শও দেওয়া হচ্ছে। অন্যায়, অবিচার থেকে দূরে সরে এসে সবাই ইতিবাচক চিন্তা করছে।

সৃষ্টিকর্তার আনুগত্য :

চারিদিকে মৃত্যু আতঙ্ক। যে মহামারি এসেছে তা প্রতিরোধে কোন কার্যকর পদক্ষেপ নেই মানুষের হাতে। নানান চেষ্টা করেও অসহায় মানুষ। এরই মধ্যে সবার উপলব্ধি এসেছে এই মহামারি থেকে মুক্তি দিতে পারেন একজন। তিনি সৃষ্টিকর্তা। প্রকাশ্যে হোক আর অপ্রকাশ্যে সবাই মৃত্যুকে ভয় করে। তাই অজানা আতঙ্কে মানুষ এখন সৃষ্টিকর্তার স্মরণাপন্ন হয়েছে। নিরবে ঘরের মধ্যে বসেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে তারা আশ্রয় চাচ্ছে একমাত্র সৃষ্টিকর্তার কাছেই। ফলে বিপদগামী মানুষ ‍সৃষ্টির রহস্য ও অদৃশ্য শক্তির বিষয়ে আরও বেশি বিশ্বাস অর্জন করতে পারছে।  

এক হয়েছে বিশ্ব নেতারা :

করোনা সঙ্কট কোন নিদৃষ্ট একটি এলাকা বা দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। যা ছড়িয়ে পড়েছে পুরো বিশ্বব্যাপী। ফলে পৃথিবীর সব দেশের রাষ্ট্রপ্রধান সঙ্কট মোকাবেলায় এক হয়েছেন। একে অন্যের সহযোগিতা চাইছেন এবং নিচ্ছেন। সবাই সবার খোঁজ-খবর নিচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- সার্কভূক্ত দেশগুলোর নেতারা এক হয়েছেন এই সঙ্কট মোকাবেলায়।

নেই যুদ্ধ :

যুদ্ধের নামে যে পৃথিবীতে প্রতিদিন কোন না কোন দেশ হয়েছে অন্ধকার, যেখানে বারুধের গন্ধ ছড়িয়ে গেছে, অস্ত্র ও গোলার প্রকাণ্ড শব্দে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হয়েছে সেখানেও আজ শান্তি প্রতিষ্ঠিত। নেই কোন যুদ্ধ, নেই কোন হামলা। সবাই অদৃশ্য এক ভাইরাসের কাছে পরাজিত। তাইতো যুদ্ধ বন্ধ করে নিজেকে, নিজের দেশকে রক্ষায় ব্যস্ত যুদ্ধবাজরা।

চিকিৎসার বিজ্ঞানের উন্নতি :

যদিও করোনাকে পরাজিত করতে এখনও চিকিৎসা বিজ্ঞান ব্যর্থ, তবে এই সঙ্কট সবার মধ্যে চিন্তার বীজ বপন করেছে। চিকিৎসকরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, দিন-রাত করোনা মোকাবেলায় একপ্রকার যুদ্ধ করছেন তারা।

হাসপাতাল, চিকিৎসা সরঞ্জামের উৎপদন বৃদ্ধি পেয়েছে। সাধারণ রোগীদের অসুবিধা দেখা দিলেও সবাই নিজেদের সুরক্ষায় নিজেরাই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। চিকিৎসকরাও মানবিক হয়ে উঠেছেন। নিজের জীবন দিয়ে হলেও তারা রোগীকে সুস্থ করার চেষ্টা করছেন। সরকারও চিকিৎসা খাতে সাহায্যের মাত্রা বাড়িয়েছেন।

সাম্প্রদায়িক চিন্তার বিলুপ্তি :

এ এমন এক সঙ্কট ও মাহামারি যা কোন একক গোষ্টির উপর এসে পড়েনি। সমগ্র মানবজাতি এতে আক্রান্ত। কোন একটি ধর্মের বা গোত্রের উপর এ ভাইরাস আক্রমন করেনি। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, ইহুদি ও খ্রিষ্টান সব ধর্মের মানুষের মধ্যেই করোনা হানা দিয়েছে। সবাই উপলব্ধি করেছেন এ সঙ্কট কাটিয়ে মুক্তি দিতে পারেন শুধুই একজন। আর তিনি মানবজাতির সৃষ্টিকর্তা।

সর্বপরি মানুষ পরিশুদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করছে। তারা সহনশীল হয়ে জীবনকে নতুনভাবে গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মৃত্যুকে জয় করে আগামীর প্রত্যাশায় এক হয়ে সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ় করছেন প্রত্যেকে।

এসএ/


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি