ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪

কস্ট কাটিংয়ের অর্থনীতি বনাম মরা হাতির গন্ধ!

মানিক মুনতাসির

প্রকাশিত : ১৩:৩৫, ২৯ জুন ২০২০ | আপডেট: ১৫:৫১, ২০ জুলাই ২০২০

ঢাকার রাস্তার মুচি থেকে বিশ্বের শীর্ষ ধনী বিল গেটস, ওয়ারেন বাফেট কিংবা জেপি মরগানের মালিক। সবাই এখন কষ্ট কাটিংয়ের চিন্তায় মগ্ন। মুচি হয়তো ভাবছে, জুতা সারাতে সে আগে ২০ টাকা দামের আঠা ব্যবহার করতো এখন সে ১০ টাকা দামের আঠা ব্যবহার করবে। কেননা আগে যে ১০ টাকায় জুতো সারাতো এখন সে হয়তো ৫ টাকায় সারাবে। এতে কি হবে হয়তো জুতোর স্থায়ীত্ব কমবে। যার ফলে জুতার মালিক ঘন ঘন জুতা সারাবে। কেননা যে আঠার দাম ২০ টাকা আর যেটার দাম ১০ টাকা নিশ্চয়ই দুটোর কার্যকারিতা এক নয়।

ফলে জুতার মালিক আর মুচি উভয়কেই তো বাঁচাতে হবে। তাই কস্ট কাটিং না করে অপ্রয়োজনে নতুন জুতো কেনা বন্ধ রাখুন। এক বছর পুরনো জুতাই পরুন। সময় বদলালে আবার নতুন করে দু/তিন জোড়া জুতা কেনা যাবে। তাহলে ঐ মুচিও বাঁচবে। আপনিও জুতা পরতে পারবেন। অন্যদিকে, বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের দাম কমে যাওয়ায় ধারণা করা হচ্ছে- কাঁচামালসহ অন্যান্য জিনিসপত্রের দামও কমে আসবে। তাই অতি ধনীরা জুতোর কারখানা গড়ুন। প্রয়োজন ও পছন্দ অনুযায়ী বিনিয়োগও করতে পারেন। এতে কিছু হলেও নতুন করে কর্মসংস্থান হবে। আবার সামান্য কিছু লাভও হবে। সুইস ব্যাংকে অলস টাকা ফেলে না রেখে এই সংকটে সেটা কাজে লাগান। এতে গরীব মানুষ বাঁচবে।

এবার আসুন, মূল আলোচনায় প্রবেশ করি। করোনাভাইরাস মহামারীতে বৈশ্বিক অর্থনীতির অন্তত ৯ ট্রিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হবে বলে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবিসহ বিভিন্ন সংস্থা পূর্বাভাস দিয়েছে। কোন কোন দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নৈতিবাচক পর্যায়ে চলে যাবে। তবে বাংলাদেশে এর প্রভাবটা একটু কমই পড়বে বলে ধারণা করছে অনেক সংস্থা। আর জাতিংসঘ এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচী, ইউনিসেফ বলছে- বিশ্ব খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে। এজন্য নিজ নিজ দেশের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়াতে হবে। বিশেষ করে খাদ্য উৎপাদন এবং অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়াতে হবে।

এডিবি বলছে, বাংলাদেশের অর্থনীতির ক্ষতি হতে পারে ৩ বিলিয়ন ডলার। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা বলছে, দুই মাসের সাধরাণ ছুটির সময় আমাদের দৈনিক ক্ষতি হয়েছে ৩ হাজার ৩শ কোটি টাকা। বলা হয়েছিল রেমিট্যান্সে ধস নামবে। কিন্তু ঘটেছে ঠিক উল্টো। গত দুই মাস ধরে রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধিতে নতুন নতুন রেকর্ড হচ্ছে। যার ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। নতুন নতুন রপ্তানীর অর্ডারও আসতে শুরু করেছে। অবশ্য প্রথম দুই মাস এপ্রিল ও মে-তে রেমিট্যান্স কিছুটা কমেছিল। 

এখন করোনার প্রভাব বলা যায় সারাবিশ্বেই কমে আসছে। কেননা দেশে দেশে লকডাউন তুলে নিলেও মৃত্যুর হার বাড়েনি। বরং কমেছে। সংক্রমণ বাড়লেও ক্রিটিক্যাল রোগীর সংখ্যাটা কমছে। বাংলাদেশে এটার প্রভাব আরো অনেক বেশি। কেননা ইতলীতে যখন তিন বা চার হাজার আক্রান্ত হতো, তখন মারা যেতো দেড় হাজার। আমাদের এখানে মারা যাচ্ছে এখনো ৫০ জনের কম। অথচ দৈনিক আক্রান্ত হচ্ছে তিন হাজারের বেশি। আবার সুস্থও হচ্ছে নিজের চেষ্টাতে। আবার মোটামুটি সব কল কারখানা, অফিস-আদালত পরিবহন সবই খোলা রয়েছে। মানুষ কাজ করে খেতে পারছে। তবে এটা ঠিক যে, কিছু সংখ্যক মানুষ টিকতে না পেরে ঢাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছে। এটার জন্য দায়ী আমাদের বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারাই। কেননা তারা ব্যবসাকে শতভাগ লাভজনক ভাবেন। এটা অবশ্য সারাবিশ্বেই। ব্যবসা মানেই লাভ। একদিনও লোকসান গুণতে রাজি নয়। 

ধরুন, আপনি কোন একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক। যে কর্মীরা আপনার এই প্রতিষ্ঠানে ১০/১৫/২০ বছর ধরে কাজ করছে তাদের ঘামের বিনিময়েই আপনার কোম্পানি প্রতি মাসে লাভ করেছে কোটি কোটি টাকা। একটা থেকে কারখানা হয়েছে ২০টা। কিন্তু যেই কিনা করোনার আঘাতে এক বা দুই মাস আপনার লাভ কিছুটা কম হলো তখনই আপনি কস্ট কাটিংয়ে নেমে গেলেন। এ রাস্তাটা অবশ্য বিশ্বের বড় বড় কোম্পানিগুলোই আগে করেছে। এমিরেটস-এর মতো কোম্পানি সবার আগে কর্মী ছাটাইয়ের ঘোষণা দিয়েছে। ভারতের রিলায়েন্স গ্রুপ তাদের কর্মীদের বেতন কমিয়েছে। ছাঁটাইও করেছে। অর্থলগ্নীকারী বিশ্ববিখ্যাত ব্যাংক স্টান্ডার্ড চার্টার্ডও একই পথে হেঁটেছে। ফলে বাংলাদেশেও পথ দেখাল বড় বড় কোম্পনিগুলোই। সবচেয়ে বড় ব্যাংক দাবিকারী দ্য সিটিব্যাংক কর্মীদের বেতন কমালো। একই পথে হাঁটলো আরো অনেক ব্যাংক ও বীমা কোম্পানি। শুধু তাই নয়, ব্যাংকগুলো এক জোট বেঁধে গণম্যাধমে বিজ্ঞাপন দেবে না বলে ঘোষণা দিল। 

ভালো কথা, আজকে বিপদের দিনে গণমাধ্যমকে আপনার প্রয়োজন মনে হচ্ছে না। কিন্তু যেদিন আপনি একটি শাখা উদ্বোধন করে প্রেস রিলিজটি পাঠিয়ে আবার ফোন করে বলেছিলেন ভাই, ছবি পারলে প্রথম পাতায় দিয়েন। সে কথা কি মনে আছে আপনার? নিশ্চযই নেই! বিজ্ঞাপন দেবেন না। কর্মী ছাঁটাই করবেন। বেতন কমাবেন। আবার নতুন কর্মী নেবেন। এতে কারখানার উৎপাদন বাড়বে না। উল্টো কমবে। 

অন্যদিকে, গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে ঘটবে আরো বড় বিপদ। কেননা এ খাতে এমনিতেই দক্ষ লোকের প্রচণ্ড অভাব। আর সবখানে সিনিয়র এবং দক্ষদের বাদ দেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে কস্ট কাটিংয়ের নামে। তারচেয়ে বরং বিকল্প চিন্তা করুন। কর্মীদের ছাঁটাই না করে অপ্রয়োজনীয় খরচ কমিয়ে আনুন। প্রচার সংখ্যাও কমানো যেতে পারে। এতে উৎপাদন খরচ কমবে। বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত সংকটকালে এগিয়ে আসা। আমাদের দেশে তো সুবিধা আছে। যারা ব্যাংকের মালিক, তারাই আবার গার্মেন্টস মালিক, আবার তারাই আইন প্রণেতা। তারাই আবার কোন না কোনভাবে গণমাধ্যমের সঙ্গে জড়িত। ফলে বৃহত্তর স্বার্থে নিজেদের মধ্যে সমঝোতার সুযোগ রয়েছে বৈকি।

এবার আসুন, অন্য কথা বলি। বিশ্ব বিখ্যাত গণমাধ্যম ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল গত ৩ এপ্রিল তাদের এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, করোনাভাইরাসের এই দুর্যোগের সময়ে স্থানীয় টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর দর্শকসংখ্যা অনেক বাড়লেও আশঙ্কাজনকভাবে কমেছে বিজ্ঞাপনের হার। ভাইরাস-সংক্রান্ত কোনো সংবাদের পাশে নিজেদের বিজ্ঞাপন দিতে চাচ্ছে না বড় বড় ব্র্যান্ডসহ অনেক প্রতিষ্ঠান। সংবেদনশীল বিষয়টির সঙ্গে নিজেদের ব্র্যান্ড মেলাতে ভয় এবং দ্বিধা-দ্বন্দ্বে রয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো। তাছাড়া লকডাউনের কারণে বন্ধ রয়েছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতসহ প্রায় সব ধরনের প্রতিষ্ঠান। স্থগিত তাদের প্রচার-বিজ্ঞাপনও। পরিবহন বন্ধ থাকায় ভেঙে পড়েছে পণ্যের বিপণন ব্যবস্থা। করোনাভাইরাসের অনিশ্চিত স্থায়ীত্বকালের কারণে নিজেদের বাজেট বাতিল করেছে অনেক বিজ্ঞাপনদাতা। ফলে ভয়াবহ আর্থিক সংকটে গণমাধ্যম। এখন অবশ্য পরিস্থিতি স্বাভাবিকের দিকেই যাচ্ছে। 

আর একই রকম সংকট এড়াতে অস্ট্রোলিয়া, ডেনমার্ক, কানাডাসহ আরো অনেক দেশ তাদের গণমাধ্যম টিকিয়ে রাখতে বিলিয়ন ডলারের প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। কেননা সে সব দেশের সরকার বিশ্বাস করে শক্তিশালী গণমাধ্যম ব্যতিত গণতন্ত্র টিকবে না। আর গণতন্ত্র শক্তিশালী না হলে সুশাসন টিকিয়ে রাখা যাবে না। যার ফলে দেশে অপরাধ বাড়বে। দুর্নীতি-অনিয়ম জেঁকে বসবে। ফলে দেশের সব খাতের মত গণমাধ্যমকেও টিকিয়ে রাখতে হবে। 

বাংলাদেশের গণমাধ্যমে কি হচ্ছে- এটা ব্যাখ্যা করার কিছু না। করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হওয়ার অনেক আগেই  এ দেশের মিডিয়া খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছিল। আর এখন রীতিমত মুখ থুবড়ে পড়েছে। এটা অবশ্য অনেকেরই কাম্য ছিল। কেননা তাহলে তো লুটপাট আরো ভালভাবে করা যাবে। 

প্রথম সারির যোদ্ধা হিসেবে গণমাধ্যম কর্মীরা লড়াই করছেন প্রতিনিয়ত এই অদৃশ্য ভাইরাসের সাথে। পেট আর পেশার তাগিদে দেশপ্রেমের কারণে কাজ করতে গিয়ে আক্রান্ত হচ্ছেন, মারাও যাচ্ছেন। কিন্তু দিন শেষে তারা প্রণোদনা তো দূরের কথা, চাকরি হারাচ্ছেন। বেতন কমানো হচ্ছে। যেসব হাউজে কর্মী ছাটাইয়ের পরিবর্তে বেতন কমানোর ঘোষণা দিয়েছে বা ভাবছে, সেটা তো তাও মন্দের ভালো। ব্যবসার একটা নীতিই হলো যখন বেশি বেশি লাভ হবে তখন কর্মীরা সে লাভের অংশ পাবে কদাচীৎ। কিন্তু যেই সামান্য লোকসান হবে তখনই কোম্পানির কর্মীদের ওপর লোকসানের খড়্গ দাবানো হবে। হয় চাকুরীচ্যুতি নয়তো বেতন কর্তন। এটাই মুনাফাবান্ধব মুক্তবাজার অর্থনীতির সুফল কিংবা কুফল।   

এবার আসুন শুরুর সেই জুতা আর মুচির কথা দিয়ে শেষ করা যাক। নতুন করে অপ্রয়োজনীয় জুতা না কিনেন কিন্তু পুরনোগুলোর কদর করুন। অর্থাৎ পুরনো কর্মীদের ছাঁটাই না করে এই সংকটকালে তাদের প্রতি সহানুভুতিশীল হোন। মুনাফা দুটো বছর কম হলেও পরের বছরই বাড়বে। এবং কর্মীরাও পূর্ণ উদ্যমে কাজ করে আপনার কোম্পানির উৎপাদন বাড়াতে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে। হোক না সেটা কোন জুতার কারখানা কিংবা কোন গণমাধ্যমের কার্যালয়।

শেষ কথা: মূল ধারার গণমাধ্যমের ইতিহাসে ভয়াবহতম সঙ্কটকাল চলছে। এই সংকটে গণ্যমাধ্যম টিকতে না পারলে, কিংবা মরা হাতির মতো পড়ে থাকলে, একদিকে যেমন গন্ধ বেরুবে, অন্যদিকে তেমন ভিন দেশের শকুনেরা মরা হাতির উৎকট গন্ধে প্রিয় মাতৃভুমির সম্পদ লুটে নিতে নির্বিঘ্নে কৌশল করবে। কেননা শক্তিশালী গণমাধ্যম না থাকলে সরকারগুলো এক রকম নিস্ক্রিয় হয়ে যাবে। আর মূল ধারার গণমাধ্যমের জায়গাটা দখল করবে নানান ধরনের স্যোশাল মাধ্যম। যেখানে প্রতিনিয়ত বুনিত হতো হিংসা আর বিদ্বেষের বিষ। ২৪ ঘন্টাই চলবে অপপ্রচার, গুজব আর তেলবাজি। যার পরিণাম কি হতে পারে তা হয়তো আমরা এখন চিন্তাই করতে পারছি না। 

এখানে যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় প্রেসিডেন্টের একটা উক্তিকে মনে করিয়ে দিতে চাই। সেটা হলো- টসাস জেফারসন বলেছিলেন, সংবাদপত্রহীন সরকার আর সরকারবিহীন সংবাদপত্র, দুটোর একটা বেছে নিতে বলা হলে আমি সরকারবিহীন সংবাদপত্রকেই বেছে নেব। কেননা, সুশাসন আর গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে এবং সভ্যতার সার্বিক বিকাশের প্রয়োজনে শক্তিশালী গণমাধ্যমের কোন বিকল্প নেই। ফলে গণমাধ্যমহীন সরকার ব্যবস্থা কখনই কোন দেশের জন্য সুফল বয়ে আনতে পারে না। অতএব দেশের স্বার্থেই গণমাধ্যম টিকিয়ে রাখুন। গণমাধ্যমের কর্মী ছাঁটাই থেকে সরে আসুন।

এনএস/


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


টেলিফোন: +৮৮ ০২ ৫৫০১৪৩১৬-২৫

ফ্যক্স :

ইমেল: etvonline@ekushey-tv.com

Webmail

জাহাঙ্গীর টাওয়ার, (৭ম তলা), ১০, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

এস. আলম গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান

© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি