ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪

মরণোত্তর স্বীকৃতির দাবি

চারণকবি ও কন্ঠযোদ্ধা দিদারুল আলম রফিককে বিনম্র শ্রদ্ধা

কাজী ইফতেখারুল আলম তারেক

প্রকাশিত : ২২:১২, ২ মার্চ ২০২০ | আপডেট: ২২:২০, ২ মার্চ ২০২০

স্বপ্নময় রুপময় স্বর্গসম প্রীতিময়/সাগর কন্যা সন্দ্বীপ আমার প্রিয় জন্মস্থান....।
কল্প কথার গল্প - গাঁথার আনন্দময় দেশ/ বাংলা ভাষার বাংলাদেশ স্বপ্ন পরিবেশ।।

প্রিয় তোমায় ভূলে যেতে বলো না আর বলো না/ আমার প্রাণে ব্যাথা লাগে/ 
তুমি তো আর জানো না,.... জানো না।

বসন্তেরি ফুলবনে মধু- লগনে/তোমায় আমায় দেখা হলো নীরব ক্ষণে।
আমার সোনার বাংলাদেশ/এ' দেশেরি সব কিছুতেই মধুর আবেশ।
যাবার বেলায় প্রিয়/কেন চোখে জল/বেদনার যমুনাতে নামিল কি ঢল।
একটি দেশের কথা আমি/বলতে তোমায় চাই...

একুশে ফ্রেব্রুয়ারি আজও দেয় ব্যাথা ভারী রক্তে রাঙা সেই ইতিহাস আজো কি ভূলতে পারি?...
আমি তো এ বাংলাতে থাকবো চিরদিন ভালোবাসবো..

এমন অসংখ্য কালজয়ী গানের স্রষ্টা তিনি। যার কবিতা-গানে এক সময় মোহিত ছিল দ্বীপ জনপদ সন্দ্বীপ। সন্দ্বীপের অসংখ্য বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মুখে মুখে প্রচলিত ছিল তাঁর রচিত গানে-সুরে এসব গানগুলো। গায়ক রফিক নামেই তিনি সমধিক পরিচিত ছিলেন।

৭০ এর নির্বাচনে অসামান্য অবদান রেখেছিলেন নৌকার পক্ষে। ওনার গানের কথা এখনও সন্দ্বীপীদের হৃদয়ে বাজছে। পাকিস্তানের শাসন-শোষণের বিরুদ্বে তিনি গেয়েছেন-
‘অর্থনীতির বড়্দীঘিতে আমরা মাছ জিঁয়াই/
পশ্চিমারা উঁদ সাজিয়া মাছগুন নিয়া যায়/
৬ দফার এই ৬ কোচ মাইরা
উঁদের কল্লা রাখমু না/
আয় লো রে ভাই দফার জমানা।"

কী অপূর্ব কাব্যিক ভবিষ্যৎ বাণী তিনি গানে গানে করেছিলেন সেসময়।

একাত্তরের এই কন্ঠযোদ্বা সারাদেশে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে গান গেয়েছিলেন সে সময়। বেতারে তিনি স্বাধীনতার গান গেয়ে বাঙালিদের মনে-প্রাণে ঐকতান সৃষ্টি করেছেন। এছাড়া তিনি ১৯৫৪ যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনকালীন সময়ে মোজাম্মেল উকিল প্রার্থী হলে তিনি কন্ঠে গান তুলে নেন। একাত্তরের রনাঙ্গণে যুদ্ব করতে অনেকেই অস্ত্র হাতে নিয়েছে। একজন শিল্পী সে ক্ষেত্রে কী করতে পারে? সে তো বন্ধুকের ভাষায় অভ্যস্ত নয়। তাই তিনি কণ্ঠে তুলে নিয়েছিলেন মুক্তির গান। জাতিকে গণজাগরণে উদ্ভাসিত করে মুক্তির লক্ষ্যে উদ্বেলিত করেছিলেন। 

কবি দিদারুল আলম রফিক স্বাচ্ছন্দ্যময়ী জীবনের আনুকূল্য পাননি এটা সত্যি, কিন্তু এটাও সত্য যেটুকুন পেয়েছিলেন তা পায়ে ঠেলে তিনি ফিরে এসেছেন স্বজাত্যবোধের টানে। শিক্ষকতার মহিমায় নিজেকে আলোকিত করেছেন। তার সুর-সাধনা আর সাংস্কৃতিক চর্চার মধ্য দিয়ে তিনি দেশ ও দেশের জন্য আজীবন কাজ করে গেছেন। তার পান্ডিত্বের প্রগাঢ়তা এত ব্যাপক ছিলো যে তা স্বল্প বাক্যে তাকে নিবেদন করা সম্ভবপর হবে না। তার জ্ঞানের পরিধি এতটাই বিস্তৃত ছিল যে তাকে নিয়ে গবেষণা হতে পারে। 
মনুষ্যত্ববোধে তিনি ছিলেন আধ্যাত্নিকতায় পরিপূর্ণ একজন মানুষ। যিনি তার ছাত্রদের এক মহাজীবনের দর্শন সম্পর্কে শিক্ষা দিতেন। তাঁর সমস্ত সারল্যে উদারতা আর মোহনীয় ব্যক্তিত্বে জুড়ে আছে শিক্ষকতার পবিত্র সত্ত্বা।

তিনি জ্ঞানের প্রদীপ জ্বালিয়ে অন্ধকার আর অনগ্রর শিক্ষার্থীদের জীবন বদলে দিয়েছেন। শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের কাছে তিনি ছিলেন একজন অনন্য দিকপাল। একজন নজরুল গবেষক হিসেবে তিনি সাহিত্য চর্চা করতেন। তার লেখা গান- কবিতা, লোক গান, জারি সারি, মারফতি গান, গজল উল্লেখ্যযোগ্য। সামর্থ্য আর সীমাবদ্বতা তার প্রচারে প্রধান বাঁধা ছিল। প্রচারবিমুখতা আর দরবেশী জীবনে অভ্যস্ত ছিলেন তিনি। বৈষয়িক জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য থেকে দূরে থেকেছেন। তার লেখায় আধ্যাত্নিকতার পরিস্ফুট খুঁজে পাওয়া যায়। তার কাব্য প্রতিভার সমাদর কিংবা কদর প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে কম ছিলেন। কিন্তু জীবনজুড়েই তিনি তাঁর ছাত্রদের কাছে ‘রিয়েল হিরো’ ছিলেন।

প্রিয়জনের জন্যে কিছু লিখা খুব একটা সহজ কাজ নয়, তা আমি ভালো করেই এখন বুজতে পারছি। কিভাবে, কি দিয়ে শুরু করব ভেবে পাই না। কোন শব্দে আপনাকে মূল্যায়িত করবো বুজতে পারছি না। স্মৃতি বিস্মৃতি মিলে যুগান্তকারী এক জীবনের অনন্য মহানায়ক আপনি। কী লিখলে পরে, আপনার জন্যে সেটা সঠিক হবে, এসব ভেবে পাই না। কিন্তু এইভাবে চুপ থাকাটাও এক প্রকার অন্যায়। কেননা আপনার সাথে আমাদের আত্মার একটি অবিচ্ছেদ্য বন্ধন রয়ে গেছে। ভালোবাসার দাবি থেকে, আপনার একজন নগন্য ছাত্র হিসেবে এই দিনে দু’কলম লেখা আমার পরম দায়িত্ব মনে করেছি।

২০০৯ সালের এই দিনে তিনি এই মায়ালোক ত্যাগ করেছেন। মৃত্যু সব মানুষের জন্য অবধারিত। কিন্তু একজন প্রথিতযশা শিক্ষকের জন্য এ সমাজ ও সমাজের মানুষের ভূমিকা কতটুকুন হওয়ার কথা ছিল। সে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে সমাজ ও তার ঘনিষ্ঠজনরা। কারণ যে মানুষটি সন্দ্বীপ পাবলিক হাই স্কুলে তাঁর যৌবনের সোনালি দিন উজার করে দিয়েছেন সেই ঋষীতুল্য মানুষকে আমরা কতোটুকুন মূল্য দিতে পেরেছি? বিদ্যালয় থেকে অবসর নেওয়ার সময় তাঁর ভাগ্যে একটি বিদায় সংবর্ধনা পর্যন্ত জুটেনি। জানি না এই দায়ভার কে নেবে? এমন কী বার্ধক্যকালিন সময়ে যখন তিনি ন্যুব্জ হয়ে পড়েছিলেন তাঁর পাশে দাঁড়ানো মানুষের সংখ্যা ছিল হাতে গনা ক’জন।

সে সময় তাঁর চিকিৎসার উদ্যেগ নিয়ে ব্যর্থ হয়েছি। মৃত্যুর পর তাঁর জন্যে একটি শোকসভার উদ্যেগ নিলে আমাদের দু’একজন শিক্ষকের অসহযোগিতার কারণে বেশি দূর এগুতে পারিনি। স্যারের প্রতি যেহেতু সকল শিক্ষার্থীর দাবি রয়েছে একই সাথে প্রাতিষ্ঠানিক বিবেচনাও এক্ষেত্রে গৌণ ভূমিকা রেখেছে। আমরা যারা স্যারের শেষ পর্যন্ত সম্পৃক্ত ছিলাম তারাও অনেক উপহাস সহ্য করেছিলাম। স্যারের মৃত্যুর পর ২০০৯ সালের ২রা ডিসেম্বর সন্দ্বীপ ফ্রেন্ডস সার্কেল এসোসিয়েশন থেকে ‘ফ্রেন্ডস সার্কেল এ্যাওয়ার্ড-২০০৯’ মরণোত্তর ঘোষণা করা হয়। জানি এ স্বীকৃতি হয়তো কিছু না। কিন্তু একজন ছাত্র হিসেবে নিজ বিবেকের কাছে মুক্তি পেতে সামান্য সময়ের স্মৃতি আর পুরুস্কার কিছুটা হলেও স্বস্তি দেয়। এই মহান শিক্ষাগুরুর সান্নিধ্য পেয়েছি এটাই আমাকে মৃত্যু অবধি আনন্দ দেবে। সেই সাথে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি। মহান আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন যেন আপনাকে জান্নাতবাসী করুন। আমিন।।

জীবনব্যাপী তিনি সাংস্কৃতিক চর্চা আর আদর্শ বহন করেই তিনি অনেককেই মহৎ জীবনের দর্শন দিয়ে গেছেন। কিন্তু কি পেয়েছেন। মোটাদাগে সেটা এখন জানার ইচ্ছে? তার স্মৃতি স্মরণ করেই আমরা তাকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বহন করতে চাই। কেননা একজন চারণ কবি দিদারুল আলম রফিক সব সময় জন্মায় না। সঠিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তার কর্ম-দর্শন আর দেশের প্রতি অবদানের সঠিক মূল্যায়ন হয়নি। দেশ ও দেশের স্বাধীনতার জন্যে তাঁর জীবনব্যাপী অবদানের কোন স্বীকৃতি পাননি। এজন্য তাকে সেভাবে উপস্থাপন করা হয়নি। যেমন হয়নি চারণ কবি শাহ বাঙ্গালির। এই দুই কৃতি সন্তান একাত্তরের ক্রান্তিলগ্নে তারা এ জাতিকে রক্তে স্বাধীনতার জন্যে আগুন ধরিয়েছিলেন। আজ তাঁর প্রয়াণ দিবসে এই মহান ঋষির মরণোত্তর জাতীয় স্বীকৃতি দাবি করছি।

লেখকঃ সাংবাদিক 


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি