ঢাকা, মঙ্গলবার   ১৯ মার্চ ২০২৪

জেনে নিন আশুরার তাৎপর্য

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৯:১৫, ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৯ | আপডেট: ১৯:১৭, ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৯

হিজরি নববর্ষে মহরম চান্দ্রমাসটি পুরনো বছরের জরাজীর্ণতাকে মুছে দিয়ে ইসলামের ইতিহাসকে জানার, মুসলিম ঐতিহ্যকে চেনার ও দুরন্ত সাহসিকতার সঙ্গে ত্যাগ-তিতিক্ষায় নির্ভীক পথচলার কল্যাণময় শুভবার্তা নিয়ে ফিরে আসে। মহরম শব্দের অর্থ অলঙ্ঘনীয় পবিত্র। 

ইসলামে মহরম মাসটি অত্যন্ত ফজিলতময় ও মর্যাদাপূর্ণ। এ মাসেই বহু নবী-রাসূল ইমানের কঠিন পরীক্ষার মাধ্যমে মুক্তি ও নিষ্কৃতি পেয়েছিলেন। অসংখ্য তথ্যবহুল ঐতিহাসিক ঘটনা এ মাসে সংঘটিত হয়েছিল। ১০ মহরম কারবালা প্রান্তরে হজরত ইমাম হোসেন (রা.)-এর শহীদ হওয়াকে কেন্দ্র করে বর্তমানে আশুরার গুরুত্ব পেলেও ইসলামের ইতিহাসে এইদিনে অসংখ্য তাৎপর্যময় ঘটনা রয়েছে। এ কারণে মুসলমানরা দিনটিকে ধর্মীয় ভাব-গাম্ভীর্যের মধ্যদিয়ে পালন করে থাকেন।

এই পৃথিবীর সবকিছু এবং চলমান সময়ের প্রতিটি মুহূর্ত আল্লাহ পাকের সৃষ্টি। এসবের মধ্যে বাছাই করে তিনি নির্দিষ্ট স্থান এবং কিছু সময়কে সম্মানিত করেছেন। সময়ের পরিক্রমা উল্লেখ করতে গিয়ে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ পাক যে চারটি মাসকে সম্মানিত বলে আখ্যায়িত করেছেন, মহরম মাস তার অন্যতম। আরবি পরিভাষায় এ মাসকে আল্লাহর মাস বা শাহরুল্লাহ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ইসলামের অনেক আগে থেকেই এ মাস আল্লাহ পাকের কাছে অতি সম্মানিত এবং ফজিলতপূর্ণ।

হাদিসের প্রায় সব কিতাবে মহরম মাসের ফজিলত এবং এ মাসের ১০ তারিখ আশুরার রোজা সম্পর্কে রাসূল (সা.) থেকে বর্ণিত একাধিক হাদিস রয়েছে। পবিত্র কুরআনের সুরা তওবার ৩৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ পাক চারটি মাসকে সম্মানিত উল্লেখ করে এ মাসগুলোতে পরস্পর অন্যায় ও অবিচার থেকে বিরত থাকতে বিশেষ নির্দেশ দিয়েছেন। ইসলামপূর্ব যুগেও এ মাসগুলোতে যুদ্ধ-বিগ্রহ থেকে মানুষ বিরত থাকতো।

রাসূল (সা.) বলেছেন, রমজানের রোজার পর মহরম মাসের রোজা আল্লাহ পাকের কাছে সবচেয়ে বেশি ফজিলতময়। (মুসলিম/হাদিস নং- ১৯৮২)

মক্কায় থাকাকালে রাসূল (সা.) নিজে এ আশুরার দিন রোজা রাখতেন তবে তা পালনে কাউকে আদেশ করেননি তিনি। মদিনায় হিজরতের পর যখন তিনি ইহুদিদের এ মাসের ১০ তারিখে রোজা রাখতে দেখলেন, তখন তিনি এর কারণ জিজ্ঞেস করলেন। ইহুদিরা জানালো, এ মাসের ১০ তারিখে আল্লাহ পাক মুসা আলাইহিসসালামকে ফেরাউনের কবল থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন। এ তারিখেই ফেরাউন ডুবে মরেছিল। হজরত মুসা নবী এ দিনটিতে রোজা রাখতেন। রাসূল (সা.) তখন বললেন, আমরাও মুসা নবী আলাইহিসসালামের অনুসরণ করবো। তোমাদের চেয়ে আমাদের অধিকার বরং বেশি। 

তিনি তখন থেকে মহরমের ১০ তারিখ রোজা রাখা শুরু করলেন এবং সবাইকে নির্দেশ দিলেন। (বুখারি/হাদিস নং- ১৮৬৫) সুতরাং মদিনায় হিজরতের পর তার এ আদেশের কারণে আশুরার রোজা সবার জন্য ওয়াজিব হিসেবে গণ্য হতো; কিন্তু যখন রমজান মাসের রোজার হুকুম নাজিল হলো, তখন আশুরার রোজার হুকুম ওয়াজিব থেকে সুন্নতের পর্যায়ে নেমে এলো। রাসূল (সা.) তখন বললেন, যে চায় সে রোজা রাখতে পারে এবং যে চায় না, সে না রাখলেও ক্ষতি নেই। (বুখারি, মুসলিম, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ, দারেমি, বায়হাকি)

রাসূল (সা.) বলেছেন, এ আশুরার দিন রোজা রাখার কারণে আল্লাহ পাক বান্দার বিগত এক বছরের গোনাহসমূহ মাফ করে দেন। (মুসলিম/হাদিস নং- ১১৬২) মুসলিম শরিফের বর্ণনায় জানা যায়, ইন্তেকালের আগের বছর রাসূল (সা.) ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন, যদি আমি আগামী বছর বেঁচে থাকি তবে নয় তারিখেও রোযা রাখবো। এজন্যই আশুরার রোজার সঙ্গে এর আগের দিন রোজা রাখাকে মুস্তাহাব বলেছেন উলামায়ে কেরাম।

প্রখ্যাত হাদিস বিশারদ হাফেজ ইবনে হাজার হজরত ইবনে আব্বাসের বর্ণনা উল্লেখ করেছেন, যাতে রাসূল (সা.) বলেছেন, তোমরা আশুরার দিন রোজা রাখো। তবে এতে যেন ইহুদিদের সঙ্গে সামঞ্জস্য না হয়ে যায় সেজন্য এর সঙ্গে মিলিয়ে হয় আগের দিন কিংবা পরের দিনসহ রোজা পালন করো।

মহরম এবং আশুরা সম্পর্কে কিছু বিষয় স্পষ্টভাবে জানা থাকা প্রয়োজন, আশুরার দিন ছাড়াও পুরা মহরম মাস আল্লাহ পাকের কাছে সম্মানিত এবং ফজিলতপূর্ণ। রমজান মাস ছাড়া অন্যান্য মাসের চেয়ে এ মাসের নেক কাজে বেশি সওয়াব এবং অন্য মাসের চেয়ে এ মাসে কৃত অপরাধের শাস্তিও বেশি।

আশুরার দিন ইসলামের পূর্বযুগ থেকেই মহিমান্বিত দিন। রাসূল (সা.)-এর প্রিয়তম দৌহিত্র হোসাইন (রা.)-এর শাহাদাতের ঘটনা নিঃসন্দেহে দুঃখজনক ও হৃদয়বিদারক। তবে কারবালার এ ঘটনার সঙ্গে আশুরার ফজিলতের কোনো সম্পর্ক নেই।

কেউ যদি শুধু মহরম মাসের ১০ তারিখ রোজা রাখেন এবং এর আগে বা পরে একটি রোজা যোগ না করেন, তবে তা মাকরুহ নয়, বরং এতে মুস্তাহাব বিঘ্নিত হবে; কিন্তু প্রকৃত সুন্নত হলো, আগের ৯ মহরম বা পরের দিনের সঙ্গে ১১ মহরম মিলিয়ে মোট ২দিন রোজা রাখা। যে এ আশুরার দিন রোজা রাখতে পারলো না, তার জন্য কোনো সমস্যা কিংবা আশাহত হওয়ার কিছু নেই। যদি কেউ ৯, ১০ এবং ১১ তারিখ মোট ৩ দিন রোজা রাখেন তবে তা সর্বোত্তম হিসেবে গণ্য হবে। ইমাম ইবনুল কাইয়িম এ মত উল্লেখ করেছেন।

আর আশুরার রোজার ফজিলতে যে এক বছরের গুনাহ মাফ করার সুসংবাদ রয়েছে, তা সগিরা গুনাহসমূহের জন্য প্রযোজ্য। কারণ অন্য এক হাদিসে রয়েছে, কবিরা গুনাহ এর আওতায় নয়। বরং কবিরা গুনাহ কখনোই তওবা ছাড়া মাফ হওয়ার নয়। ইমাম নববী এবং ইমাম ইবনে তাইমিয়াসহ প্রখ্যাত সব হাদিস বিশারদগণ এ মত ব্যক্ত করেছেন।

আশুরার ইতিহাস
আশুরা ইতিহাসের এক বেদনা বিধুর ঘটনা। ৬৮০ খ্রিস্টাব্দের এ দিনে ইরাকের কারবালা প্রান্তে ফোরাতের তীরে বিশ্বের ইতিহাসের এক নির্মম হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। এতে মহানবি (সা.) এর দৌহিত্র ইমাম হোসেন সপিরবারে শাহাদাৎ বরণ করেন।
এ সব ঘটনার সাথে হিজরি ৬১ সনের একই দিনে কারবালার বিয়োগান্তক ঘটনাও যোগ হয়েছে। কারবালার ঘটনা সংগটিত হওয়ার আগেই ইসলাম আশুরার গুরুত্ব দিয়েছে। এ কারণেই রমজান মাসের রোজার আগে মুসলমানদেরকে এ দিনে ফরজ হিসেবে রোজা রাখতে হয়েছে- যা ইহুদি ধর্মের বিধানেও আছে। তবে কারবালার মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর মুসলিম সমাজে আশুরা শোকাবহ দিন হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলির পর মুয়াবিয়া মুসলিম জাহানের আমির বা শাসক নিযুক্ত হন। আর হযরত আলি তনয় ও মহানবির দৌহিত্র ইমাম হোসেন চুক্তি অনুযায়ী মুয়াবিয়ার খেলাফতের উত্তরাধিকারী মনোনীত হন। কিন্তু আমিরে মুয়াবিয়ার ইন্তিকালের পর তার পুত্র ইয়াজিদ চুক্তি ভঙ্গ করে অন্যায়ভাবে খেলাফতের দায়িত্ব নেন এবং শাসন ব্যবস্থায় স্বৈরাচার নীতি অবলম্বন করেন। এতে মুসলিম জাহানে বিবাদ-বিশৃঙ্খলা বেড়ে যায়। এহেন পরিস্থিতিতে খেলাফতের ন্যায্য দাবিদার ইমাম হোসেন বাধ্য হয়ে ইয়াজিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন।

একদিকে ক্ষমতায় মদমত্ত স্বৈরাচার ইয়াজিদ অন্যদিকে খেলাফতের ন্যায্য দাবিদার মহানবি (সা.) দৌহিত্র ইমাম হোসেন। ইয়াজিদের সরকারি বিশাল বাহিনী অন্যদিকে ইমাম হোসেন (রা.) এর পক্ষে মুষ্টিমেয় সত্যের সৈনিক। অন্যায়-অসত্যের বিরুদ্ধে সত্য-ন্যায় প্রতিষ্ঠার লড়াই। স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে অধিকার আদায়ের খেলাফত প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। একদিকে ইয়াজিদের বিপুল সমরাস্ত্র অন্যদিকে ইমাম হোসেন নিরস্ত্র। অধিকন্তু ইয়াজিদের সৈন্যদের দ্বারা ফোরাতের তীরও অবরুদ্ধ।

ইমাম হোসেন ও তার সৈনিকেরা তৃষ্ণায় কাতর। এমতাবস্থায় ইমাম হোসেনকে আত্মসমর্পণের জন্য ইয়াজিদ প্রস্তাব পাঠান। কিন্তু ইয়াজিদের অন্যায়-অসত্য ও স্বৈরাচারী শক্তির কাছে মাথা নত না করে তিনি যুদ্ধ চালিয়ে যান। এ অসম যুদ্ধে স্বভাবতই ইমাম হোসেন পরাজিত হন। আর বিজয়ী ইয়াজিদ পাশবিক উম্মাদনায় মেতে উঠেন। তিনি পরাজিত ইমাম হোসেন ও তার পরিবারের সদস্যদের নির্মমভাবে হত্যা করেন। সাধারণভাবে যুদ্ধে বিজয়ী প্রশংসিত কিন্তু কারবালা যুদ্ধের ইতিহাস ভিন্ন। ন্যায়-অন্যায় বিবেচনায় কারবালা যুদ্ধের বিজিত নন্দিত অন্যদিকে বিজয়ী ঘৃণিত। নৃশংসতা-নির্মমতার কারণে ইয়াজিদ নিন্দনীয়। আর ইমাম হোসেন পরাজিত হয়েও ইতিহাসে স্মরণীয়। অন্যায়-অসত্যের কাছে মাথা নত না করার জন্য তিনি বিশ্ব বরণীয়। সত্য-ন্যায়ের ঝাণ্ডা সমুন্নত রাখার জন্য তার আদর্শ অনুকরণীয়।

কারবালার নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের প্রায় ১৪শত বছর অতিক্রান্ত হলেও আজও ইমাম হোসেন সমগ্র মুসলমান জাতির অন্তরে স্মৃতিময় হয়ে আছেন। একইভাবে ইয়াজিদের প্রেতাত্মাও বিদ্যমান আছে। তাই সময়-স্থানের ব্যাপক ব্যবধান সত্ত্বেও কারবালার প্রেক্ষাপট আর আজকের প্রেক্ষাপট প্রায় অভিন্ন। কারণ সত্য-মিথ্যার চিরন্তন দ্বন্দ্ব। এ দ্বন্দ্বে সত্যপন্থী ও ন্যায়বাদীদের ত্যাগ করতেই হবে। তবেই কারবালার শহীদদের প্রতি যথার্থ সম্মান দেখানো হবে।

প্রকৃতপক্ষে মুসলিমগণের এক তাৎপর্যময় দিন পবিত্র আশুরা। এ দিনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য কারবালার বিষাদময় ঘটনা। এতে লুকিয়ে আছে ত্যাগের মহিমা আর সত্য-ন্যায় প্রতিষ্ঠার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। তাই শুধু মর্সিয়া-মাতম নয় বরং ত্যাগ-কুরবানি আশুরার প্রধান শিক্ষা।

টিআর/


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি