ট্রিপল-ক্রাইসিসের মুখোমুখি আ’লীগ, হতে পারে কয়েক টুকরো
প্রকাশিত : ২০:২০, ১২ জুলাই ২০২৫

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বিবিসিতে জুলাই আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর শেখ হাসিনার ‘হত্যার নির্দেশ দেয়ার’ অডিও ফাঁস এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের পদক্ষেপের কারণে আওয়ামী লীগের জন্য বহুমাত্রিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এতে করে আগামীতে অভ্যন্তরীণ ভাঙন, আইনি লড়াই এবং আন্তর্জাতিক নিঃসঙ্গতার মতো ভয়াবহ ট্রিপল-ক্রাইসিসের মধ্যে পড়তে হতে পারে দলটি বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছে দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। সহসাই এই সংকট থেকে দলটি বের হতে পারবে কিনা তা নিয়ে নানান প্রশ্ন উঠেছে দেশের রাজনৈতিক মহলে।
সম্প্রতি ফাঁস হওয়া অডিও নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম তাজুল ইসলাম দাবি করেন, ফাঁস হওয়া অডিওটি বিবিসি নয়, বরং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একজন বিশেষ তদন্ত কর্মকর্তা উদ্ধার করেছেন। তিনি বলেন, ‘এটি কেবল শুরু—এখনো অনেক কিছু বাকি আছে।’
এই মন্তব্যের পর দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। উল্লেখযোগ্যভাবে, ফাঁস হওয়া অডিওর সত্যতা ইতোমধ্যে ফরেনসিক বিশ্লেষণে প্রমাণিত হয়েছে এবং তা আদালতে প্রমাণ হিসেবে গৃহীত হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল এই অডিওর ভিত্তিতে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে পাঁচটি মানবতাবিরোধী অভিযোগ গঠন করেছে। অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সাবেক পুলিশ প্রধান আল-মামুন।
এই প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ নিয়ে নতুন করে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। যদিও আওয়ামী লীগ দাবি করেছে, এসব কর্মকাণ্ড রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। দলটির পক্ষ থেকে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় এক ফেসবুক পোস্টে বলেছেন, ‘একটি লজ্জাজনক অপসাংবাদিকতার উদাহরণ।’
তবে আন্তর্জাতিক মহল—বিশেষ করে বিবিসি, রয়টার্স, এপি এবং টাইমস অব ইন্ডিয়া—এই অডিও রেকর্ড ও মামলাকে একটি ‘জাস্টিস টার্নিং পয়েন্ট’ বলে অভিহিত করছে।
এছাড়া ভারতকে শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠানোর আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশের ট্রাইব্যুনাল। তবে নয়াদিল্লি এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি।
অন্যদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই অডিও প্রকাশ এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনা ও তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন এবং সাবেক আইজিপির রাজসাক্ষি হওয়ার ঘটনা দলটিকে রাজনীতির একটি নতুন ও সংকটপূর্ণ মোড়ে নিয়ে যাচ্ছে। এটি শুধু বিচার কিংবা শাস্তির প্রশ্ন নয়, বরং দেশে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক ভারসাম্য ও আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতার বিষয়েও নীতিনির্ধারক হয়ে উঠতে পারে।
তারা আরও দাবি করেন, এ ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ কোনো রাজনৈতিক চাপ বা আন্তর্জাতিক রাজনীতি দিয়ে মিটিয়ে ফেলা সম্ভব নয়। বিশেষ করে যখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সরাসরি এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। এর মধ্যেই বিবিসি, রয়টার্সসহ বিশ্বের প্রভাবশালী গণমাধ্যমগুলো এ ইস্যুকে গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করেছে। ফলে এটি শুধু দেশের ভেতরে নয়, বরং আন্তর্জাতিক পর্যায়েও আওয়ামী লীগের গ্রহণযোগ্যতা ও ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলবে নিঃসন্দেহে।
তারা ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগ বেশ কিছু বিপদের সম্মুখীন হতে পারে বলে ধারণা করছেন। তাদের মতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে বেশ কিছু বিপদের মুখোমুখি রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়া আওয়ামী লীগ।
প্রথমত, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার প্রেক্ষিতে ভারত যদি ভবিষ্যতে তাকে আশ্রয় না দেয় বা রাজনৈতিক চাপের মুখে প্রত্যার্পণ করে, তাহলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব শূন্যতায় পড়বে। দলের ভেতরে তখন নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব ও বিভাজন তীব্র হতে পারে।
দ্বিতীয়ত, অডিওর পাশাপাশি ভিডিও প্রকাশ হলে, যেটি সরাসরি সহিংসতার প্রমাণ বহন করে, তখন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের বিরুদ্ধে তদন্তের আওতা আরও বাড়বে। এতে সরকারের সাবেক মন্ত্রিদেরও বিচারের মুখোমুখি হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হবে।
তৃতীয়ত, এই সংকটকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের ওপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা (যেমন যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভিসা নিষেধাজ্ঞা, সম্পদ জব্দ ইত্যাদি) আসতে পারে, যা দলের অভ্যন্তরীণ অর্থায়ন, বিদেশ সফর ও কূটনৈতিক সংযোগের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে।
চতুর্থত, আন্তর্জাতিক মহলে শেখ হাসিনার বিচার দাবি যদি আরও জোরালো হয়, তবে আওয়ামী লীগ সরকার যে ‘নির্বাচন নির্ভর গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার দাবি করছিল, সেটিও প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এতে আগামী জাতীয় নির্বাচনের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নিয়েও সংকট দেখা দিতে পারে।
পঞ্চমত, তরুণ ভোটার ও নাগরিক সমাজের মধ্যে ইতোমধ্যে নৈতিক প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। শেখ হাসিনার “শুট অন সাইট” নির্দেশ বাস্তব প্রমাণিত হলে ছাত্র-তরুণদের সমর্থন হারানোর ঝুঁকিতে পড়বে দলটি, যা ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের ভিত্তিকে দুর্বল করে দেবে।
সবশেষে, দেশের ভেতরে বিএনপি, জামায়াতসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে রাজপথে সক্রিয় হওয়ার সুযোগ পাবে। তাদের দাবি আন্তর্জাতিক সহায়তা ও জনসমর্থনের জোরে আরও সংগঠিত হতে পারে। ফলে সরকার ও দল দুই-ই রক্ষা করতে গিয়ে আওয়ামী লীগকে আগামী মাসগুলোতে অভ্যন্তরীণ ভাঙন, আইনি লড়াই এবং আন্তর্জাতিক নিঃসঙ্গতার মতো এক ভয়াবহ ট্রিপল-ক্রাইসিসের মধ্যে পড়তে হতে পারে।
এসএস//
আরও পড়ুন