ঢাকা, শনিবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

ড. আহমদ শরীফের ডায়েরি

ড. নেহাল করিম

প্রকাশিত : ১০:১১, ২৮ অক্টোবর ২০১৮ | আপডেট: ০০:০৯, ৩ নভেম্বর ২০১৮

Ekushey Television Ltd.

বাংলাদেশের সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতির জগতে ড. আহমদ শরীফ (১৯২১-১৯৯৯) একজন প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব, যাকে উপেক্ষা করা যায়, তবে কোনো অবস্থাতেই তার বিশাল কীর্তি অস্বীকার করা যায় না। সম্ভবত তিনি একমাত্র ব্যক্তি, যিনি সবার কাছে প্রিয় হওয়ার দুর্বলতাকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। পেশাগত জীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। পঞ্চাশের দশকের প্রথম থেকে নব্বইয়ের দশকের শেষ পর্যন্ত সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, দর্শন, ইতিহাসসহ প্রায় সব বিষয়ে অজস্র লিখেছেন।
বর্তমান নিবন্ধটি ড. আহমদ শরীফের প্রকাশিত (২০০৯) ডায়েরি ‘ভাব-বুদ্বুদ’ থেকে সংকলিত। বৃহৎ আকারের না হলেও গ্রন্থটির পৃষ্ঠা সংখ্যা ২০৪। উদ্ধৃত করার মতন অসংখ্য বাক্য ছিল কিন্তু কয়েক পৃষ্ঠার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে বলে সংক্ষিপ্ত আকারে সংকলিত হয়েছে। বর্তমান নিবন্ধটি চারটি ভাগে বিভক্ত। যথা— ক. ভাবদর্শন, খ. অনুভূতি, গ. ব্যক্তিত্ব এবং ঘ. প্রত্যাশা। সূত্র : বণিক বার্তা
ভাবদর্শন
এ পর্যায়ে আহমদ শরীফের জীবনে যে ভাব, অভিজ্ঞতা, চিন্তাচেতনার উদ্ভব ঘটেছিল, তার প্রতিফলন ঘটেছে নিম্নে উদ্ধৃত বাক্যগুলোয়। এটি মন-মনন, সমাজ ও সামাজিক সম্পর্ক ইত্যাদির ওপর রচিত হয়েছে।
১. প্রীতিহীন হূদয় ও নির্লক্ষ্য কর্ম দুই-ই বন্ধ্যা। ২. গুণ ও ঘ্রাণ গোপন রাখা যায় না। ৩. সুখ কেউ কাউকে দিতে পারে না, সুখ পেতে জানতে হয়। সুখ বাইরে নেই, সুখ চিত্তলোকে সৃষ্টি করতে হয়। ৪. কল্পনা, বিশ্বাস, আধ্যাত্মিকতা হচ্ছে ম্যাজিক আর ঐহিকতা হচ্ছে লজিক। তাই যুক্তিই জীবনাচারের নিয়ামক। ৫. বিস্ময়, কল্পনা, ভয়-ভক্তি ভরসাজাত লৌকিক-অলৌকিক, অলীক ও শাস্ত্রিক সংস্কার বিশ্বাসকে এক শব্দে Prejudice বলে সংজ্ঞায়িত বা অভিহিত করলে এ Prejudice বর্জন করে ভাব-চিন্তা-কর্ম আচরণে ও আচারে-বিচারে জ্ঞান ও যুক্তি প্রয়োগই হচ্ছে আধুনিকতা। ৬. প্রিয়া কোল দেয়, পৃথিবী করে লালন, এ দুটো ব্যবস্থা নির্বিঘ্ন হলেই জীবন হয় আনন্দিত স্বপ্ন। ৭. দিনের আলো এবং রাস্তার অপরিচিত লোক আমাদের নির্ভয় রাখে, রাতের অন্ধকার ও নির্জনতা আমাদের ভীত করে। ৮. ফুল টানে চোখ, গান টানে মন, ফুলে আর গানে বিরূপতা নেই সেই মানুষের। রূপ-গুণ-সুর শেষাবধি মনে লাগে, মর্মে লাগে, অবসরে মনে মর্মে কাজেও। ৯. মানুষ নিজের জন্য স্বাধীনতা চায় সর্বক্ষণ কিন্তু অন্যকে রাখতে চায় অধীন। ১০. পীর-দরগা-খানকা-হুজরা-সুফি-দরবেশপন্থী-অধ্যাত্মবাদীরা গণশোষণের জন্যই এসবকে ইসলাম ও শরিয়তসম্মত বলে প্রচার করে। অজ্ঞ মুসলিমরা ইমানের অপরিহার্য অংশ করে তুলেছে এসব কোরআন-সুন্নাহবহির্ভূত অলীক ও অলৌকিক বিশ্বাস-সংস্কার ও ধারণাকে। ১১. এ যুগ বিজ্ঞানের যুগ, এ যুগ প্রকৌশল প্রযুক্তি যন্ত্রের যুগ। কাজেই বিজ্ঞানের তত্ত্বে, তথ্যে ও সূত্রে আস্থা এবং বিজ্ঞানীর আবিষ্কার, উদ্ভাবন ও সৃৃষ্টিই জীবন-জীবিকার অবলম্বন। ১২. মানুষ, শিক্ষিত মানুষ, অশিক্ষিত মহৎ-ইতর-জ্ঞানী-মূর্খ নির্বিশেষে সবাই নিজের জন্য স্বাধীনতা আবশ্যিক বলে জানে। কিন্তু অন্যের জন্যও যারা জরুরি বা ন্যায্য বলে মানে না। যারা নিজেদের জন্য রাষ্ট্রিকভাবে জাতীয় পর্যায়ে স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছে তারাও অন্যদের অধীনে রাখার জন্য প্রাণপণে প্রয়াসী। এটি একটি আধি মনুষ্যত্ববিরোধী বা মানবতাবিরোধী। ১৩. প্রাণ থাকলে প্রাণী হয় কিন্তু মানুষ হওয়ার জন্য মন ও মনন দুই-ই দরকার। ১৪. আনুগত্য মুক্তবুদ্ধি ও স্বাধীন সিদ্ধান্তে বাধা বা পরিপন্থী। ১৫. বিশ্বাসের দুর্গে যুক্তি প্রবেশপথ পায় না। তেমনি যুক্তির জগতে বিশ্বাস কখনো গ্রাহ্য হয় না।
অনুভূতি
এ পর্যায়ে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ড. আহমদ শরীফের মনের অভিব্যক্তি প্রকাশ পেয়েছে, যাতে তার চিন্তাচেতনার প্রতিফলন ঘটেছে।
১. ২১শে ফেব্রুয়ারি গৌরবের রোমন্থন, না সমকালীন সংকটে- সমস্যায় একুশের সংগ্রামের অনুসরণ বা কর্তব্য কি একুশে গৌরবের রোমন্থন, না সংগ্রামের অনুসরণ? ২. প্রেম জীবনে একটি নতুন অনুভব, একটি নতুন উপলব্ধি, একটি নতুন সুখ, একটি নতুন আনন্দরূপে জাগে। ৩. নাস্তিকের কারো কৃপার প্রত্যাশাও থাকে না, মৃত্যু-উত্তর ভয়েরও আশঙ্কা থাকে না। সে থাকে ভয়-ভরসার ঊর্ধ্বে নিশ্চিত। ৪. মানুষে মানুষে রয়েছে কাঁটাতারের বেড়া, সে বেড়া শাস্ত্রের, স্থানের, ভাষার, মতের, পথের, বিত্তের, বিদ্যার, বিশ্বাসের, সংস্কারের, সাংস্কৃতিক ও আচারের পার্থক্যজাত ঘৃণা, অবজ্ঞা, স্বতন্ত্র চেতনাপ্রসূত। তাই মানুষ মিলতে পারছে না কোথাও। ৫. হজ জান্নাতের ‘গ্রিন কার্ড’ পাইয়ে দেয় না। ৬. কাশীবাস স্বর্গবাসের ‘পাসপোর্ট’ও নয়, ‘ভিসাও’ নয়। ৭. যৌবনে আর বার্ধক্যে হূদয়ঘটিত সমস্যা দেখা দেয়। দুটোই অস্থির রাখে। তবে স্বাদ আলাদা এই যা। একটি বেদনামধুর, অন্যটি বেদনাবিধুর। আর বেদনামাত্র লঘু-গুরু যন্ত্রণার নামান্তর। ৮. ব্যক্তিক, পারিবারিক কিংবা জাতীয় ঐতিহ্যের, কৃতি-কীর্তির স্মরণ, রোমন্থন, আস্ফাালন প্রভৃতি অযোগ্য-উদ্যমহীনকে রোমন্থনে আগাম আনন্দ-সুখ দেয় মাত্র। যোগ্যতা অর্জনে, উন্নতি-উন্নয়নে অনুপ্রাণিত করে না। আর যোগ্য উদ্যমশীল উদ্যোগী মেধা-মনীষাসম্পন্নদের ঐতিহ্য স্মরণের প্রয়োজনীয়তাই থাকে না। কেননা তারা নিজেরা সু ও স্বপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রেরণা, প্রণোদনা আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে এবং জীবনের লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ ও বরণ করে। ৯. মানবতার শত্রু তিন ‘R’— Race, Religion and Region. ১০. জীবন হচ্ছে আনন্দ-যন্ত্রণার সমষ্টি। জীবনানুভূতিতে তবু আনন্দের আমার আশ্বাসের ও সুখের মাত্রা বেশি।
১১. প্রলোভন প্রবল হলে আস্তিক মানুষ করে না হেন অপরাধ অপকর্ম নেই। তবু তাদের শাস্ত্রভীতি এত প্রবল কেন বোঝা যায় না। আশৈশব শোনা কথায় বিশ্বাস, ভয়-ভক্তি, ভরসা এত গাঢ়, গভীর ও ব্যাপক কেন, যুক্তি-বুদ্ধি প্রয়োগে এক্ষেত্রে তাদের এত অনীহা কেন বোঝা ভার। লাভে-লোভে, স্বার্থে অপকর্ম-অপরাধপ্রবণ হওয়া সত্ত্বেও তারা মুক্তবুদ্ধি ও যুক্তিযোগে কালের দাবি। হূদয়ের চাহিদা যুক্তির। যুক্তির ন্যায্যতা স্বীকার করলেই তাদের মানসিক জীবনও সমকালীনতার প্রসাদপুষ্ট হতো। যুক্তিতেই মানুষের মুক্তি, বিজ্ঞানের তত্ত্বে, তথ্যে ও সত্যে আস্থাই জীবনের ঋজু পথের দিশারি— এ তত্ত্ব বোধগত হলেই কেবল একজন মানুষ যুক্তিবাদী, বিবেকবান, আধুনিক বা সমকালীন চেতনাসম্পন্ন হতে পারে।
১২. একালে নৃতত্ত্ব, সমাজবিজ্ঞান, প্রত্নতত্ত্ব, ইতিহাস, বিজ্ঞান ও  প্রকৃতি প্রভৃতি সম্পর্কে প্রমাণসম্ভব জ্ঞান অর্জন করেও, অর্জন, করার সুযোগ পেয়েও এখনো ভূতে-ভগবানে বিশ্বাস কী করে যে দৃঢ় রেখেছে, তা ভেবে পাইনে। নৃতত্ত্ব, সমাজবিজ্ঞান, প্রত্নতত্ত্ব, বিস্ময়, কল্পনা, বিশ্বাস, সংস্কার-ধারণার উৎস, উদ্ভব ও বিবর্তন ধারার প্রায় তথ্যনির্ভর আলোচনা বিশ্লেষণ ও পরিবেষ্টনী-প্রগতি-প্রকৃতি প্রভৃতিজাত-জীবনযাপন পদ্ধতি সম্পর্কে আমাদের অবহিতি সত্ত্বেও কেন বিশ্বাসের ভূত ভগবানকে ছাড়ে না? কেন জ্ঞান-যুক্তি-বুদ্ধি-বিজ্ঞান আশ্রয়ী হয় না মানুষ? ১৩. যৌবনে স্ত্রী সুখের ও আনন্দের, মধ্যবয়সে চাহিদার ও নালিশের বিরক্তির তালিকা মাত্র, আর বার্ধক্যে বল-ভরসার অবলম্বন। ১৪. স্বামীর বা স্ত্রীর বিরহ যৌবনে যন্ত্রণার, মধ্যবয়সে নিঃসঙ্গতাজাত নিরানন্দের, বার্ধক্যে অসহায়তার কারণ্যের কারণ। ১৫. নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিচালনায় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবির মধ্যেই নিহিত রয়েছে সরকারি সর্বশ্রেণীর কর্মচারীর চরিত্রের, আদর্শের ও নৈতিক চেতনার প্রতি অবিশ্বাস এবং আমজনতার চরিত্রে অনাস্থা। সবাই যেন হয় ভয়ে অথবা লাভে-লোভে-অর্থে ও স্বার্থে আত্মভোট ও আত্মবিক্রয় করতে রাজি। ১৬. শাস্ত্রিক বিচার ও আচার ব্যক্তির, কিন্তু রাষ্ট্রে অভিন্ন অধিকার সবার।
ব্যক্তিত্ব
তার জীবনকালে বঙ্গের যারা স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে সমাজ-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে আছেন, তাদের মধ্যে বিশেষ কয়েকজনের ওপর ড. আহমদ শরীফের মূল্যায়ন তুলে ধরা হলো—
১. আত্মমর্যাদাবোধই চরিত্র অটল-অটুট রক্ষার প্রধান খুঁটি। আত্মসত্তার মূল্য ও মর্যাদা চেতনাই মানুষকে সততার, সরলতার, সৌজন্যের, সহানুভূতির, কৃপার, করুণার, দয়া-দাক্ষিণ্যের, সত্য ভাষণের, সত্যকে আঁকড়ে থাকার আধার করে। নির্ভীক ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদা বোধেরই প্রসূন মনুষ্যত্বের ফল। বিদ্যাসাগর শির উঁচু রাখতে পেরেছিলেন— এ মর্যাদাবোধের পুঁজির শক্তিতেই। তাই তিনি রায়বাহাদুর, রাজা, স্যার, সি-আই-ই হননি। ২. রাজা রামমোহন রায় মগজে ছিলেন অসাধারণ এবং চরিত্রে ছিলেন সব দোষে দুষ্ট। ৩. বিদ্যাসাগর চরিত্রে ছিলেন অতুল্য, মেধায়-মনীষায় ছিলেন সাধারণ। তবে নিরীশ্বর হওয়ার মতন যুক্তিবাদী ও সাহসী আর সংযমে, পরমতসহিষ্ণুতায় ও সৌজন্যে ছিলেন উঁচুমানের সংস্কৃতিমান। ৪. মধুসূদন ছিলেন এককথায় আরবি তাজি। ৫. বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন দেশ-জাতি মানুষের কল্যাণ ভাবনায় চিরনিষ্ঠ। আর মেধা-মনীষায় উনিশ শতকের সর্বশ্রেষ্ঠ পুরুষ। ৬. স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন হিন্দুর দেবদর্শনের গৌরবগর্বী। কালিসাধক, রামকৃষ্ণের শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেও তার মধ্যে কালিভক্তি কিংবা ধর্মানুরাগ প্রবল ছিল না। তিনি ছিলেন সমকালসচেতন। একজন রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতিবোদ্ধা মনীষী ও মনস্বী মানবসেবী। রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠাতেই এ মানবপ্রেম সুপ্রকট। ৭. জীবন ও জগৎ সম্পর্কে অন্নদাশংকর রায়ের সন্ধিৎসা গাঢ়, গভীর ও ব্যাপক, তবু তিনি নাস্তিক নিরীশ্বর হতে পারেননি। গান্ধী— রবীন্দ্রনাথ প্রভাবিত বুর্জোয়া চিন্তাচেতনা তার জীবনদর্শন হয়ে রইল। ৮. রবীন্দ্রনাথের বিপুল রচনার প্রতিটি হরফ নিজের হাতে লেখা, প্রতিটি শব্দ তার চেতনার, চিন্তার ও বক্তব্যের প্রতীক ও প্রতিম। প্রতিটি শব্দে জড়িয়ে রয়েছে তার মন, মগজ, মনন, অনুভব ও উপলব্ধি আর শ্রম ও সময়, হয়তো আনন্দও। সে আনন্দ রচনার, সৃষ্টির, নির্মাণের ও অভিব্যক্তির মাধ্যমে মনের, মগজের ও মর্মের উদ্বেগ-আবেগমুক্তির। ৯. নজরুল ইসলাম বড় কবি নন, প্রিয় ও প্রয়োজনের কবি। সুরস্রষ্টা হিসেবে তিনি অনন্য, বাণীস্রষ্টারূপে নিতান্ত সাধারণ। প্রয়োজন ফুরোলে অর্থাৎ সমাজ পরিবর্তন হলে কবি হিসেবে প্রিয় থাকবেন না। সুরস্রষ্টা হিসেবে হয়তো শতেক বছর টিকতেও পারেন। ১০. নীরদ চৌধুরী রক্ষণশীল দাম্ভিক কিন্তু প্রচণ্ড আত্মপ্রত্যয়ী ব্যক্তিত্ব। জ্ঞান-গুণী-মনন-মনীষাসম্পন্নও তিনি। ১১. রণেশ দাস গুপ্ত ছিলেন বিদ্যায়, আদর্শ নিষ্ঠায়, জ্ঞানচর্চায়, লেখায়, ভোগবিমুখতায় অনন্য চরিত্রের লোক। ১২. গোটা উনিশ শতকে বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন একজন অনন্য, অসামান্য, অসাধারণ ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্ব, রামমোহন রায়কে স্মরণে রেখেও এ কথা বলা চলে।
প্রত্যাশা
প্রত্যাশার অন্ত নেই। সবাই প্রত্যাশা করে এবং সবারই প্রত্যাশা থাকে। তেমনি আমাদের জাতি, সমাজ ও রাষ্ট্র নিয়ে ড. আহমদ শরীফের প্রত্যাশা নিম্নে সংকলন করা হলো—
১. পাকিস্তানিদের ইসলামী দৌরাত্ম্য একবার আমাদের বাঙালি ও সেক্যুলার করেছিল। এবার স্বদেশী ও স্বধর্মীর ইসলামী হামলা আমদের নাস্তিক বা শাস্ত্রদ্রোহী করবে। ২. আমাদের প্রথম পরিচয় আমরা মানুষ। আমাদের শেষ পরিচয় আমরা মানুষ। আমাদের লক্ষ্য হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-মুসলমান থাকা নয়, মানুষ হওয়া। ৩. গুণীর প্রতি শ্রদ্ধা মনুষ্যত্বের লক্ষণ, আর ক্ষমতাবানের প্রতি আনুগত্য আত্মমর্যাদাবোধ ও আত্মপ্রত্যয়হীনতার প্রমাণ। পেশাগতভাবে উন্নতি করা মহৎ ব্যক্তি নয়; স্বার্থবাজ সাধারণ শ্রেণী মাত্র। রাজনীতিতেও তাই দেখি বুদ্ধিমান-শক্তিমান সাহসী ব্যক্তিত্বও ধূর্ত হয়ে পদোন্নতির বা পদপ্রার্থীর দিকে ছোটে। গুণে-ত্যাগে-গণসেবায় মহৎ হয়ে শ্রদ্ধেয় নেতা হওয়ার প্রয়াসী হয় না। দূরদৃষ্টির অভাবের ফলে এরা আশুপ্রাপ্তিলিপ্সু হয়। এনায়েতউল্লাহ খান, কাজী জাফর, মওদুদ প্রভৃতি এমনই আত্মমর্যাদাবোধরিক্ত ধূর্ত ও ক্ষমতালিপ্সু মানুষ। ৪. টোল-মাদ্রাসার শিক্ষা শিক্ষার্থীদের অতীত ও ঐতিহ্যমুখী করছে আর রাখছে বিজ্ঞান ও সমকালীন চেতনা ও চাহিদাবিমুখ। ৫. ইংরেজি মাধ্যমে প্রাথমিক-মাধ্যমিক শিক্ষা বিদ্যার্থীদের করছে স্বদেশবিমুখ ও বিদেশমুখী। আর বাংলা মাধ্যমে চালু শিক্ষা ব্যবস্থা প্রশ্নোত্তর লেখাপড়া শেখায় কিন্তু জ্ঞানী-বিদ্বান করে না। এর থেকে মুক্তি আবশ্যিক ও জরুরি, নইলে দেশে প্রত্যাশিত গুণের, মানের, মাপের, সংখ্যার ও মানসিকভাবে বঞ্চিত মাত্রার গুণের ও চরিত্রের মানুষ মিলবে না। ৬. জীবনে ভাব-চিন্তা, কর্ম-আচরণের সর্বক্ষেত্রেই সংযমের প্রয়োজন আছে বলেই শাসনও আবশ্যিক। ৭. ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক জীবনে ধর্মশাস্ত্র-ধর্মবিশ্বাস ধর্মীয় পালা-পার্বণ অবশ্যই থাকবে এবং ভাব-চিন্তা, কর্ম-আচরণে ধর্মভাবের অভিব্যক্তি দেয়ার স্বাধীনতাও থাকবে। প্রত্যেক ধর্ম মতবাদ জাতির, সম্প্রদায়ের বা গোষ্ঠীর। কিন্তু সেক্যুলার রাষ্ট্রে, সরকারে, সংসদে, দপ্তরে কোনো ধর্মেরই স্বীকৃতি থাকবে না। কোনো ধর্মেরই অস্তিত্ব সরকার ও রাষ্ট্র স্বীকার করবে না। ধর্ম বিশ্বাস নিতান্ত ব্যক্তিক, পারিবারিক ও সামাজিক লৌকিকতা ও আচার-আচরণরূপেই স্বীকৃত থাকবে মাত্র। আমাদের ভাবী সংবিধানের উপক্রমে এ কথাগুলো বড় হরফে মুদ্রিত থাকা আবশ্যিক।
উপরে সংকলিত বাক্যগুলো আমাদের ব্যক্তিজীবন, সমাজজীবন ও রাষ্ট্রীয় জীবনে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করেছে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আগামীতে আরো বেশি করে প্রভাবিত করে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে বলে বিশ্বাস। একথা বলার প্রয়োজন হয় না যে, সমাজের বিকাশ ও ইতিবাচক পরিবর্তন সাধনের জন্য প্রগতিনিষ্ঠ চিন্তার চর্চা আবশ্যক। মুক্তচিন্তা, যুক্তিবাদ, স্বদেশ অন্বেষা, বিজ্ঞানমনস্কতা, গণকল্যাণ, কুসংস্কার মুক্তি, মনুষ্যত্ববোধ বিকাশই  সমাজকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এসএ/


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি