ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪

দেহঘড়ি

ডিএনএ রহস্য

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ২০:১০, ১৪ জানুয়ারি ২০১৮ | আপডেট: ২০:২৮, ১৪ জানুয়ারি ২০১৮

আমরা খুব কমই নিজের দিকে তাকাই, নিজের প্রতি মনোযোগ দেই। যদি মনোযোগ দেই তবে দেখবো-কী অভূতপূর্ব আর অতুলনীয় এক সৃষ্টি এই মানবদেহ।

আমাদের দেহ গঠিত হয়েছে প্রায় ৭০ থেকে ১০০ টিলিয়ন দেহকোষের সমন্বয়ে। প্রতিটি কোষে খাবার পৌঁছানোর জন্য রয়েছে শিরা-ধমনীর প্রায় ৬০ হাজার মাইলের পাইপলাইন। আছে ফুসফুসের মতো রক্ত শোধনাগার। নিদ্রাহীন কাজ করে যাচ্ছে হৃৎপিন্ডের মতো শক্তিশালী পাম্প, যা একজন মানুষের জীবদ্দশায় প্রায় সাড়ে চার কোটি গ্যালনের চেয়ে বেশি রক্ত পাম্প করে থাকে। আছে চোখের মতো ছোট্ট একটি ক্যামেরা ও লেন্স, যা দিয়ে সুবিশাল এই পৃথিবীর অপার সৌন্দর্য আমরা অবলোকন করি। আর দেহের বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনার জন্যে রয়েছে স্নায়ুতন্ত্র, এন্ডোক্রাইন, রক্ত সংবহনতন্ত্রের মতো সূক্ষ্ম ও স্বয়ংক্রিয় একাধিক ব্যবস্থা ।

জীবনের শুরুতে যদি আমরা তাকাই তাহলে দেখবো, মাতৃগর্ভে একটি ডিম্বাণুর (Ovum) সাথে একটি শুক্রাণু (Sperm) এসে মিলিত হচ্ছে। শুক্রাণু এবং ডিম্বাণু-এ দুয়ের ডিএনএ মিলে তৈরি হচ্ছে একটি নতুন ডিএনএ। তৈরি হচ্ছে একটি নতুন কোষ।

সেই নতুন কোষটি থেকে স্ব-বিভাজন পদ্ধতিতে ১ টি থেকে ২টি , ২ টি থেকে ৪ টি, ৪ টি থেকে ৮ টি, ৮ টি থেকে ১৬ টি, ১৬ টি থেকে ৩২ টি-এভাবে কোষের সংখ্যা বাড়ছে।

কোষের সংখ্যা যত বাড়ছে তত নতুন নতুন অঙ্গ-প্রতঙ্গ তৈরি হচ্ছে । এক সময় মানবশিশু পূর্ণাঙ্গ রূপ ধারণ করে এবং সে ভূমিষ্ঠ হয়।

মাতৃগর্ভে একটি ভ্রুণের ধীরে ধীরে বেড়ে-ওঠা, একপর্যায়ে মানবশিশুতে রূপ নেওয়া এবং তারপর জন্ম থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত একজন মানুষের সকল শরীরবৃত্তিয় কার্যক্রম-এ সবকিছুই কিন্তু পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয় ডিঅক্সিরাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড (ডিএনএ) দ্বারা। আমাদের শরীরে যতগুলো কোষ আছে প্রত্যেকটি কোষের কেন্দ্রে থাকে এই ডিএনএ।

ডিএনএ নিয়ে গবেষণা করে প্রথম যিনি নোবেল পুরস্কার পান তিনি ড. জন কেনড্রু। ডিএনএ-কে তিনি এককথায় খুব চমৎকারভাবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ডিএনএ হচ্ছে জীবনের ব্লু-প্রিন্ট বা জীবনের নীল নকশা। ডিএনএ এত সূক্ষ্ম যে, পূর্ণবয়স্ক একজন মানুষের শরীরের প্রতিটি কোষ থেকে যদি ডিএনএ-কে আলাদা করে ফেলা হয়, তবে এই ডিএনএগুচ্ছ একটি চা-চামচে রেখে দেওয়া যাবে। চামচের তলানিতে এটি পড়ে থাকবে, চামচ ভরবে না।

ডিএনএ দেখতে সিঁড়ির মতো পেঁচানো একটি ফিতা। দৈর্ঘ্যে এটি এক মিটার পরিমাণ লম্বা হতে পারে। একজন মানুষের শরীরের সবগুলো কোষে যে পরিমাণ ডিএনএ টেপ থাকে, সেগুলোকে যদি একটানা সাথে একটা জোড়া লাগানো হয়, তবে পৃথিবী থেকে সূর্য পর্যন্ত আপনি কমপক্ষে ১০০ বার প্যাঁচ দিতে পারবেন। তারপরও এই টেপ ফুরাবে না।

কী আছে এই ডিএনএ টেপে? প্রতিটি ডিএনএ টেপে রয়েছে তিন বিলিয়ন জেনেটিক কোড এবং এই কোডগুলোকে যদি ভাষান্তরিত করা হয়-বাংলা, ইংরেজি যেকোনো ভাষায় তাহলে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার মতো কমপক্ষে হাজার খণ্ডের বিশ্বকোষ প্রয়োজন হবে। অর্থাৎ আমাদের শরীরের প্রতিটি কোষ হচ্ছে হাজার খণ্ডের এনসাইক্লোপিডিয়া বা বিশ্ববোষের তথ্যমালায় সমৃদ্ধ একেকটি তথ্যভাণ্ডার। আর আমাদের সকল শরীরবৃত্তিয় কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে এই তথ্যমালা দিয়ে ।

শুধু যে দেহের বেড়ে-ওঠা আর শারীরবৃত্তিয় কার্যক্রম পরিচালনা তা নয়, যখন আপনার ত্বক কেটে যায়, হাড় ভেঙে যায়, তখন কে জোড়া লাগায়? কে নিরাময় করে? ডাক্তার ত্বকটাকে কাছাকাছি এনে সেলাই করে দেন, ভাঙা হাড় জায়গামতো বসিয়ে দেন; কিন্তু জোড়া লাগায় আপনার ডিএনএ’র মধ্যে বসে থাকা ডাক্তার অর্থাৎ ডিএনএ-তে সঞ্চিত নিরাময়ের তথ্যমালা।

শুধু মানুষ নয়, যেখানে প্রাণ সেখানেই ডিএনএ। গাছপালা পশুপাখি ব্যাকটেরিয়া ভাইরাস-যেখানেই প্রাণ সেখানেই ডিএনএ। একটা গাছের কথাই ধরা যাক। হয়তো গাছের একটা ডাল মচকে গেছে। এখানে কে জোড়া লাগালো? কোন ডাক্তার? জোড়া লাগালো সেই গাছের ডিএনএ’র জেনেটিক কোডে সঞ্চিত তথ্যমালা।

আগেই বলা হয়েছে, ডিএনএ হচ্ছে জীবনের ব্লু-প্রিন্ট বা নীল নকশা। কেমন নীল নকশা? ধরুন, আপনি শো-রুমে গিয়েছেন, একটি গাড়ি কিনবেন। কিন্তু দেখা গেল, আপনি গাড়ি না কিনে গাড়ির একটি ব্লু-প্রিন্ট কিনে নিয়ে এলেন। তারপর সেটি রেখে দিলেন আপনার গ্যারেজে।

এবার কল্পনা করুন, সেই গ্যারেজে ব্লু-প্রিন্ট নিজে নিজে মোটরগাড়ির চেসিস তৈরি করছে, ইঞ্জিন তৈরি করছে, সিট তৈরি করছে, সিট-কভার তৈরি করছে, উইন্ডশিল্ড তৈরি করছে, তারপর নিজে নিজে স্প্রে করে রঙিন ঝকঝকে তকতকে হয়ে যাচ্ছে। একসময় পেট্রোল ভরে নিজে নিজেই গাড়িটি চলতে শুরু করেছে।

এই পুরো বিষয়টিকে যদি কল্পনা করতে পারেন, তাহলে প্রাণের বিকাশে ডিএনএ’র ভূমিকাকে আপনি চমৎকারভাবে বুঝতে পারবেন, উপলব্ধি করতে পারবেন। বাবার শুক্রাণু আর মায়ের ডিম্বাণু মিলে যে একটি নতুন ডিএনএ ও নতুন কোষ তৈরি হয়েছিলো, তা থেকেই আমাদের পুরো শরীর গঠিত হয়েছে। আর সেই সাথে পরিচালিত হচ্ছে সব ধরনের শারীরবৃত্তিয় কার্যক্রম।

সুতরাং আমরা বলতে পারি, ডিএনএ হলো চেতনা বা তথ্যমালার সমষ্টি। আর এই চেতনা যদি দেহ সৃষ্টি করতে পারে, চেতনা যদি কাটা ত্বক জোড়া লাগাতে পারে, ভাঙা হাড় জোড়া লাগাতে পারে, তবে চেতনা কেন নিরাময় করতে পারবে না? চেতনা কেন তথাকথিত নিরাময়-অযোগ্য রোগব্যাধি থেকে মুক্ত করে আপনাকে নিরাময়ের পথে নিয়ে যেতে পরবে না? এটি তখনই সম্ভব-যখন আপনি বিশ্বাস করবেন।

 

এম/টিকে


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি