ঢাকা, সোমবার   ২৯ এপ্রিল ২০২৪

দান কাকে করবেন

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৮:৫৬, ২৫ এপ্রিল ২০২৩ | আপডেট: ১৯:০২, ২৫ এপ্রিল ২০২৩

দান- স্রষ্টার দয়া ও রহমতপ্রাপ্তি এবং বালামুসিবত দূরের চমৎকার একটি মাধ্যম। স্রষ্টার অত্যন্ত প্রিয় একটি সৎকর্ম হলো আর্তের দুর্দশা লাঘবে মমতাপূর্ণ দান। আমরা দাতার জাতি, অন্যের কষ্ট লাঘবে আমরা অবলীলায় বিলিয়ে দিতে পারি নিজেদের সাধ্যমতো সবকিছু। কিন্তু একটি বিভ্রান্তি অনেককেই আচ্ছন্ন করে রাখে- অমুসলিমদের বুঝি দান করা যাবে না! 

আসলে দানের ব্যাপারে গ্রহীতার ধর্মবিচার করতে বলেনি ইসলাম। পবিত্র কোরআন এবং হাদীসে দান করতে বলা হয়েছে দুঃস্থ-অভাবী-দরিদ্র মানুষকে; মুসলিম দরিদ্র বা অভাবীকেই দিতে হবে এমনটা বলা হয় নি। বলা হয় নি দানের সময় ধর্মের বাছবিচার করতে। 

নবীজীর (স) জীবনীর দিকে তাকালে আমরা দেখব, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অভাবীর দুর্দশা লাঘবে তিনি দান করেছেন। ইসলাম যদি ধর্মের বাছবিচারের কথা বলত তাহলে তার উল্লেখ আমরা নবীজীর হাদীস তথা তার জীবন দৃষ্টান্তেই পেতাম। 

নবীর হাদীস- সকল সৃষ্টিই আল্লাহর পরিবার! ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষই আল্লাহ্‌র সৃষ্টি, সবাই মিলেই রচিত তাঁর পরিবার! 

আনাস ইবনে মালেক (রা) বর্ণিত একটি হাদীস- ‘’সকল সৃষ্টি হচ্ছে আল্লাহর পরিবার।‘’ (আবু ইয়ালা, বায়হাকি) অর্থাৎ, মুসলমান হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ সকলেই আল্লাহর পরিবার। এই পরিবারের লালনকারীকেই আল্লাহ সবচেয়ে বেশী ভালবাসেন। তাই যেকোনো ধর্মের মানুষকেই আপনি দান করতে পারেন। 

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বর্ণিত আরেকটি হাদীস হলো- “যাদের দ্বারা মানুষ সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়, আল্লাহ তাদেরকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসেন।“ 

এখানে সাধারণভাবে মানুষের উপকার করতে বলা হয়েছে; এই ‘মানুষ’ কোন ধর্মের তা উল্লেখ করা হয় নি। 

বোখারী ও মুসলিম শরীফের একটি হাদীস হলো, “আল্লাহ একজন পতিতার সারাজীবনের গুনাহ মাফ করে দিয়েছেন- একটি মৃতপ্রায় তৃষিত কুকুরকে কুয়ো থেকে পানি তুলে পান করানোর জন্যে।“

আপনিই ভেবে দেখুন, যেখানে একজন পতিতার সারাজীবনের গুনাহ মাফ হতে পারে সামান্য একটি তৃষিত কুকুরকে পানি পান করানোর জন্যে, সেখানে স্রেফ ধর্মের পার্থক্যের জন্যে একজন দুস্থ মানুষকে দান করা থেকে বিরত থাকাটা কী ইসলামের শিক্ষা হতে পারে? যে-কারণে সাহাবীদের প্রশংসা করেছেন স্বয়ং আল্লাহ! ইসলামের প্রথম দিকে আরবের মুসলমানরা অমুসলিমদের দান করতে অনাগ্রহ দেখাত। তারা মনে করত, অমুসলিমদের দান করলে সেই দানের জন্য হয়তো তারা সওয়াব পাবে না। তখন আল্লাহতায়ালা একটি আয়াত অবতীর্ণ করেন। অমুসলিম যুদ্ধবন্দি অর্থাৎ মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এসে বন্দি হওয়া অভুক্ত শত্রুদের আহার করানোর প্রশংসা করা হয়েছে আয়াতটিতে। 

সাহাবিদের উত্তম গুণাবলির প্রশংসা করে আল্লাহ বলেছেন, ‘’তাদের প্রয়োজন যত বেশিই হোক না কেন তা থেকেই তারা অভাবী, এতিম ও বন্দিকে খাবার দান করে। (মনে মনে বলে) কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের জন্যেই তোমাদের খাবার দিচ্ছি। তোমাদের কাছ থেকে এর কোনো প্রতিদান চাই না, এমনকি কৃতজ্ঞতাও নয়।’’ (সূরা দাহর, আয়াত, ৮-৯)। 

হযরত আবু দারদা (রা) থেকে বর্ণীত যে, নবীজী (স) বলেছেন, নিঃস্ব, বঞ্চিত ও অবহেলিতদের কল্যাণ করার মধ্য দিয়ে তোমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অন্বেষণ করো। তোমরা তাদের ওসিলায় (প্রতিপক্ষের মোকাবেলায়) সাহায্য এবং রিজিকপ্রাপ্ত হও। (আবু দাউদ, তিরমিজি) সেই নিঃস্ব, বঞ্চিত ও অবহেলিত যেকোন ধর্মের হতে পারে। অর্থাৎ, আপনার প্রতিবেশী কোনো অমুসলিম পরিবার যদি অনাহারে থাকে, কোনো অমুসলিম সহকর্মী যদি বিপদে পড়ে, পথে-ঘাটে অমুসলিম কারো যদি সহযোগিতার প্রয়োজন হয়, তাদের দান করতে, সাহায্য করতে কোন দ্বিধা থাকা উচিত নয়।

আবু হুরায়রা (রা) বর্ণিত হাদীস ‘’প্রতিবেশীকে উপহার হিসেবে যে-কোনো কিছু দেয়া সৎকর্ম বা সাদাকা’’ (বোখারী, মুসলিম) 

প্রতিবেশীর সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে চলার ইসলামের যে নির্দেশনা, তাতে মুসলিম-অমুসলিমের মাঝে কোনো পার্থক্য করা হয়নি। আল্লাহর ঘোষণা অনুযায়ী তাদেরকে দানের পূর্ণ প্রতিদানই আপনি পাবেন। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দানই মানুষকে মানবিক করে। আপনি হঠাৎ অসুস্থ হলেন; যে ডাক্তারের কাছে যাবেন তিনি মুসলিম হিন্দু না খ্রিষ্টান- এটা বিবেচনা করেন? নাকি দেখেন তিনি ভালো ও দক্ষ কিনা? মামলা সংক্রান্ত কোন ঝুট-ঝামেলায় জড়ালেন; যে আইনজীবীর কাছে যান তার ধর্ম কি আপনি বিচার করেন, নাকি তার যোগ্যতা? দুটি ক্ষেত্রেই উত্তর হবে- দ্বিতীয়টি! তাহলে দানের ক্ষেত্রে কেন ধর্ম দেখবেন? 

আবার ধরুন, সড়ক দুর্ঘটনায় কিছু মানুষ আহত হলো। অমুসলিমদের রেখে শুধু মুসলিমদের আপনি হাসপাতালে নিয়ে যাবেন? আপনার বিবেক কি তাতে সায় দেবে? নিশ্চয়ই না! প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় আপনি বিপন্ন মানুষের ধর্ম জিজ্ঞেস করবেন, নাকি তাকে উদ্ধার করবেন? উদ্ধার করবেন নিশ্চয়ই! তেমনি দান পাওয়ার জন্যে যে সবচেয়ে উপযুক্ত, অর্থাৎ সবচেয়ে অবহেলিত- বঞ্চিতকেই দান করতে হবে। এখানে তার ধর্মাধর্ম বিচার মানবিক বলে বিবেচ্য হবে না। আমরা মানবিক, কারণ কোনো দুর্যোগে আমরা বিপন্ন মানুষদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়াই, তিনি যে ধর্মেরই হোন না কেন।

মহাবিচার দিবসে আল্লাহর অনুযোগ থাকবে ‘আদম সন্তানের’ প্রতি আবু হুরায়রা (রা) বর্ণিত মুসলিম শরীফের একটি হাদীস- মহাবিচার দিবসে মহামহিম আল্লাহ অনুযোগ করবেন, ‘হে আদম সন্তান! আমি ক্ষুধার্ত ছিলাম। তোমার কাছে খাবার চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি আমাকে খাবার দাও নি।’ এখানে আদম সন্তানের কথা বলা হয়েছে। মুসলিম বা অমুসলিমের কথা বলা হয়নি। 

আল্লাহ জিজ্ঞেস করবেন, তৃষিতকে তুমি পানি দাও নি কেন? ক্ষুধার্তকে কেন খাবার দাও নি? অসুস্থের কেন সেবা করো নি? আসলে ক্ষুধার্ত-অসহায়-বঞ্চিতের কোনো জাত-পাত-ধর্ম নেই। যেকোনো ধর্মের মানুষের সেবা করাটাই স্রষ্টার সন্তুষ্টি লাভের অন্যতম উপায়। দান করতে হবে তাই ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষ, যে দানের হকদার তাকে।

এমএম/


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি