ঢাকা, মঙ্গলবার   ১৯ মার্চ ২০২৪

নদীর প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে: ড. আইনুন নিশাত

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৯:৪৯, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯

বাংলাদেশকে ‘নদীমাতৃক দেশ’ বলা হয়। তবে নদীগুলো সময়ের পরিক্রমায় হারিয়ে যাচ্ছে। অনেক নদী মানচিত্র ছাড়া এখন খুঁজে পাওয়া যায় না। যদিও সরকার বিভিন্ন পরিকল্পনা হাতে নিয়ে নদীগুলো বাঁচাতে উদ্যোগ নিয়েছে। তবে নদী নিয়ে নেই তেমন একটা গবেষণা এবং সাধারণ মানুষের জানাশোনা।

এ বিষয়ে একুশে টেলিভিশনের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় নদী, নদীর মনস্তত্ত্ব, ড্রেজিং, পকিল্পনা নিয়ে বিস্তারিত কথা বলেছেন বিশিষ্ট পানি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পানি সম্পদ প্রকৌশল বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন একুশে টেলিভিশনের প্রতিবেদক মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ। 

একুশে টেলিভিশনের পাঠকের কথা বিবেচনা করে তার এই বিশেষ সাক্ষাৎকারকে তিন পর্বে ভাগ করা হয়েছে। আজ প্রকাশ করা হলো এর প্রথম পর্ব (নদী, নদীর মনস্তত্ত্ব ও প্রবাহ)।  

একুশে টেলিভিশন: বাংলাদেশে নদীর সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন সংস্থার হিসেবে গরমিল দেখা যায়। এ গরমিল কেন হয়? 
ড. আইনুন নিশাত: যারা বলছে বাংলাদেশে নদীর সংখ্যা ৩০০ কি ৭০০ তারা আর যাই হোক নদী সম্পর্কে জানেন না। নদীর আন্তর্জাতিক সংজ্ঞা অনুযায়ী তো আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে হাজার খানেক নদী আছে। সেই সংজ্ঞা অনুযায়ী সুন্দরবনে ৫০০’র  মতো নদী আছে। এ দেশকে নদীমাতৃক দেশ বলা হয়। নদীর পলির মাধ্যমে এ দেশ গড়ে উঠেছে হাজার বা লক্ষ বছর ধরে। গ্রামের লোকেরা তার এলাকার নদীকে বোঝেন, নদীকে বোঝে বলেই তারা ভাটিয়ালি গাইতে পারে। কিন্তু সাধারণ নগরবাসীরা নদীকে বোঝেন না।

একুশে টেলিভিশন: নদীর গতিবিধিকে হিসেবে রেখে নদী ব্যবস্থাপনা কতটুকু জরুরি?
ড. আইনুন নিশাত: প্রত্যেকটা নদীর আলাদা সত্ত্বা আছে। যেটা বহুদিন পরে সুপ্রিম কোর্ট বুঝতে পেরেছেন। প্রত্যেকটা নদীর আলাদা গতিবিধি আছে। প্রত্যেকটা মানুষ যেমন দেখতে এক রকম তার নাক আছে, মুখ আছে, কথা বলতে পারে, চিন্তা করতে পারে কিন্তু সব মানুষের চিন্তা কি এক রকম? এই যে প্রত্যেকটা মানুষের সত্ত্বা আলাদা, চিন্তা ভাবনা আলাদা। নদীরও তাই। তারপরও মানুষের কিছু চিন্তাভাবনা, চাহিদা ও প্রতিক্রিয়ার মিল আছে কিন্তু পৃথক পৃথক ব্যাপারও আছে। নদীরও আলাদা সত্ত্বা আছে। কাজেই নদীগুলোকে বুঝতে হবে। 

                              চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার মরে যাওয়া পদ্মা নদী

একুশে টেলিভিশন: নদীর ধরনের সঙ্গে পানি প্রবাহের কতটুকু মিল রয়েছে? এতে কি কি বিষয় জড়িত বলে আপনি মনে করেন?
ড. আইনুন নিশাত: নদী শুধু পানি প্রবাহ করে না। নদীর পানির প্রবাহ ও পলির ব্যালেন্স থাকতে হয়। পাহাড়ের মানুষের জীবনযাত্রা এক রকম, শহরের মানুষের জীবনযাত্রা আবার অন্য রকম, উপকূলের মানুষের জীবনযাত্রার আবার ভিন্নতা দেখা যায়। একইভাবে পাহাড়ী নদীর আচরণ এক রকম। পাহাড় থেকে নদীটা এসে যখন সমতলে প্রবেশ করে তখন তার ব্যবহার এক রকম। সমতলের নদী আরেক রকম আর নদীটা যখন সমুদ্রের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে, সমুদ্রে বিলীন হয়ে যাচ্ছে তার সত্ত্বা এক রকম। 

প্রত্যেকটা নদীর একটা বিশেষত্ব আছে। উত্তরাঞ্চলের যে নদীগুলো আছে সেগুলো সম্পর্কে কিছুটা বুঝলেও দক্ষিণাঞ্চলের বড় বড় নদী সম্পর্কে তেমন এটা গবেষণা বা কাজ নেই। যেমন এই যে পায়রা, যেখানে বন্দর নির্মাণ বুদ্ধিমানের কাজ হচ্ছে কিনা বিবেচনা করে দেখতে হবে। এটা নদী বন্দরের জন্য ঠিক আছে কিন্তু সমুদ্রবন্দরের জন্য উপযোগী হবে কিনা সেটা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। 
যারা নদী নিয়ে খুব কথা বলে তাদের বেশিরভাগই নদী সম্পর্কে জানেন না। নদীর মনস্তত্ত্ব জানেন না। 

একুশে টেলিভিশন: নদীর গতি ও প্রকৃতি কিভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়? দেশের নদ-নদী হারিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে কি কি কারণ রয়েছে বলে আপনি মনে করেন?

ড. আইনুন নিশাত: নদী শুধু পানি বহন করে না পলিও বহন করে। তার মানে তাকে পানি ও পলি দুটিই বহন করতে হয়। সেডিমেন্ট কমে গেলে, নদীর তলদেশ থেকে যা প্রবাহিত হয় তাই সেডিমেন্ট। অনেক নদীর তলদেশ থেকে বড় বড় পাথর প্রবাহিত হয় সেগুলোও সেডিমেন্ট, এর কোন বাংলা নেই। এই সেডিমেন্ট যখন ভেঙ্গে যায় তখন কাদা হয়। সেটাকে সিল্ট বা পলি বলা যায়। একটা নদীতে যে পরিমাণ পানি ও পলি আছে যেটা তার অবয়ব ঠিক করে। এই অবয়বের জন্য অন্য একটি বিষয় কাজ করে সেটা হলো পলির সাইজ। পলির আকার যদি ছোট হয় তাহলে তার শক্তি কম লাগে। আর পলির আকার যদি বড় হয় তাহলে শক্তি বেশি লাগে। নদীর চারটি ফ্যাক্টর রয়েছে- পানির পরিমাণ ও প্রবাহ, পলির সাইজ, সেডিমেন্টের আকৃতি ও পরিমাণ এবং চতুর্থ হচ্ছে নদীর ঢাল-যে ঢালে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।

                                        পানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত 

একুশে টেলিভিশন: এ চার ফ্যাক্টর কি বাংলাদেশের সব নদীতে উপস্থিত নেই? বাস্তবিক অর্থে এগুলো কতটুকু প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?
ড. আইনুন নিশাত: এই চারটা বিষয় থেকে নিয়ন্ত্রিত হয়, তার প্রশস্ততা কত হবে গভীরতা কত হবে। আর প্রশস্ততার সঙ্গে তার গভীরতা নিয়ন্ত্রিত। পানির প্রবাহ বাড়লে নদীর প্রশস্ততা বাড়ে গভীরতা বাড়ে কিন্তু প্রকৃতিক কারণে যদি পানির প্রবাহ কমে যায় তাহলে গভীরতা কমবে প্রশস্ততা কমবে। আমি যদি জোর করে প্রশস্ততা কমিয়ে দেয় তাহলে গভীরতা বাড়বে। আর যদি জোর করে গভীরতা বাড়াই এবং প্রশস্ততা না নিয়ন্ত্রণ করি তাহলে সে নদীর প্রশস্ততা বাড়বে। সে নিজে নিজে গভীরতা কমিয়ে প্রশস্ততা বাড়াবে যদি দুই পাশে কোন বাধা না থাকে। নদী অত্যন্ত অলস, সে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়তে চায়। তার প্রশস্ততা সে বাড়াতে চায়। এর জন্যই আমরা যখন নদীকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাই তখন তার দুই পাড়টা আটকে দেই। 

পদ্মা সেতুর এলাকায় নদীর পানি সর্বোচ্চ তিন কিলোমিটার। আমরা একটা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে এটাকে বেঁধে দিয়েছি যে এর বাইরে নদী যেতে পারবে না। আমরা যদি জোর করে প্রশস্ততা কমিয়ে দেই বা গভীরতা বৃদ্ধি করি তাহলে সে শক্তি ব্যয় করবে। 

নদীর প্রবাহ সারা বছর সমান থাকে না। এক এক কালে এক এক রকম প্রবাহ। প্রত্যেক নদীতে আলাদা আলাদ চ্যানেল আছে। যেখান থেকে পরিমাণ পানি বা পলি যায় সেটার সঙ্গে একটা সম্পর্ক আছে। 

একুশে টেলিভিশন: এই চ্যানেলগুলোর প্রবাহ সব সময় তো ঠিক থাকে না। যেমন গাবখান চ্যানেলের প্রবাহ তো ঠিক নেই। এ ক্ষেত্রে কি পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে? 
ড. আইনুন নিশাত: গাবখান চ্যানেল সম্পর্কে বলতে গেলে, ওটাকে যখন কেটে দেওয়া হয় তখন মেঘনার একটা স্রোত বরিশালের দিকে গেল। স্রোতের সঙ্গে পলি গেল। এখন প্রাকৃতিক কারণে স্রোত গাবখান মুখো নেই। এখন স্রোত অন্য দিকে চলে গেছে। যেমন রাজশাহী শহরের পাশে পদ্মা নদী। এক সময় দেখা যায় নদী খুব কাছে চলে এসেছে, আবার দেখা যায় নদী দূরে চলে গেছে। নদী মিয়ান্ডার করে। মিয়ান্ডার শব্দের মানে হচ্ছে ঘুরে বেড়ানো। পাড় ঠিক থাকে না। মিয়ান্ডার করে নদী আরাম পায়। মানুষ যেমন একটা মাঠের মধ্যখান থেকে সরাসরি যায় না কারণ সে আরাম পায় নদীও তাই। মাঠে তো কোন বাধা নেই। সমুদ্রে তো কোন বাধা নেই। কিন্তু স্রোত বিভিন্ন দিক থেকে বেঁকে যায়। পাহাড়ি নদী আঁকা বাকা হয় কারণ নদী বাধা পায়। সেখানে নদীর বাঁক নেওয়ার কারণ হচ্ছে ভূতাত্ত্বিক গঠন। কিন্তু দক্ষিণাঞ্চলের মাটি কিন্তু নদীকে নিয়ন্ত্রণ করছে না। 

এখন আপনি যদি ড্রেজিং করেন। ড্রেজিং করে আপনি তার গভীরতা বড়িয়েছেন গভীরতা বড়ালে ঐ যে প্রবাহ বাড়বে। প্রবাহ বাড়লে প্রশস্ততা বাড়ে। উল্টোটা ও সত্য। প্রশস্ততা বাড়ালে প্রবাহ বেশি চাই। গভীরতা বাড়ালে প্রবাহ বেশি চাই। গাবখান চ্যানেল যখন কেটেছিল, যতটুকু কেটে ছিল এখন তার থেকে অনেক বেশি চওড়া হয়ে গেছে। নদী তার ধর্ম পালন করে বিভিন্ন চ্যানেলে সংযুক্ত হয়েছে। যে স্রোত ছিল সেটা আর সেভাবে নাই। মূল স্রোতটা অন্য জায়গায় চলে গেছে। প্রশস্ততার জন্য যে প্রবাহ দরকার ছিল সেটা নাই। প্রশস্ততা ঠিক রাখার জন্য সেই পরিমাণ পানির প্রবাহ তাকে দিতে হবে। 

একুশে টেলিভিশন: এই প্রবাহ আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারব কিনা?
ড. আইনুন নিশাত: প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। যেমন ছোট নদীগুলো ঘাঘট, করতোয়া, পূর্ণভবা, কুশিয়ারা, সুরমা এগুলো তো একটা চ্যানেল। এখানে প্রশস্ততা বৃদ্ধি করলে তা থাকবে কারণ পানি তো একটা চ্যানেল দিয়ে যাবে। আর যেখানে অনেকগুলো চ্যানেল আছে যেমন সিরাজগঞ্জ, এখানে অনেক চ্যানেল। সেখানে পানি উন্নয়ন বোর্ড হাজার কোটি টাকা খরচ করে কেটেছেন। দু’ তিন বছর আগে। কিন্তু সেগুলো ভরাট হয়ে গেছে। কেটেছেন তো একটা, পানির প্রবাহ চলে গেছে অন্য চ্যানেলে। এই চ্যানেলে পানির প্রবাহ না থাকলে তো ভরে যাবেই। এর গভীরতা বা প্রশস্ততা টিকবে না। নদীর শক্তির বিষয় আছে। তার শক্তি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

এমএস/এসি
 


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি