ঢাকা, শনিবার   ০৪ মে ২০২৪

নারী জাগরণে বেগম রোকেয়ার অবদান

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৯:৪২, ১১ জানুয়ারি ২০২৩

আন্তর্জাতিক নারী দিবস ৮ মার্চকে বেশ ঘটা করেই ইদানিং পালন করা হয় আমাদের দেশে। নানা অনুষ্ঠান-আয়োজনের মধ্য দিয়ে পালনের পর আবার যে সে-ই। আমরা ভুলে যাই সেই মানুষগুলোকে যাদের কাজের মধ্য দিয়ে অতীতের পশ্চাৎপদতা থেকে সরে এসে কিছুটা হলেও বর্তমানের অগ্রসরতা সূচিত হয়েছে। ভুলে যাই সে মানুষগুলোর ত্যাগকে, ত্যাগের পেছনে তাদের স্বপ্নকে। বেগম রোকেয়া তেমনই এক সমাজ সংস্কারক। 

একশ' বছর আগে যিনি এমন দুনিয়ার এক স্বপ্ন দেখেছিলেন যার অনেক কিছুই আজ বাস্তব। সুলতানাজ ড্রিম বা সুলতানার স্বপ্ন। ১৯০৫ সালে এ উপন্যাসটি বেগম রোকেয়া লেখেন। এতে এমন এক নারীস্থানের কথা বলা হয়েছে যেখানে সবকিছুর নেতৃত্বে আছেন নারীরা। বিশেষ করে তুখোড় মেধাবী একদল নারী বিজ্ঞানীর কারণে রাজ্যটি হয়ে উঠেছে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর এক জগতে। এই মহান বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন উড়ন্ত গাড়ি, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ও আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণের সকল কৌশল। সৌরশক্তি ব্যবহারে দক্ষতা ও স্বয়ংক্রিয় কৃষিব্যবস্থার কারণে এখানে মনুষ্যশ্রমের কোনো প্রয়োজন নেই। রাজ্যের পুরুষরা থাকেন পর্দাঘেরা এক বিচ্ছিন্ন জগতে (যেভাবে সেসময়কার নারীরা থাকতেন)! 

মমতা আর মানবিকতাভিত্তিক সে সমাজে কোনো অপরাধ নেই। নেই কলুষতা। 'যাহা যাহা পুরুষ পারিবে তাহাই নারী পারিবে' রূপকের মাধ্যমে বেগম রোকেয়া তুলে ধরেছেন সেসময়কার নারীদের পশ্চাৎপদতা এবং যুক্তি দিয়ে তুলে ধরেছেন এর অসারতা। যেমন, পুরুষদের মগজ বড় আর নারীদের দেহ দুর্বল- এ যুক্তিকে বেগম রোকেয়া খণ্ডন করেছেন এভাবে- হাতির মস্তিষ্ক অনেক বড় আর সিংহের শক্তি অনেক বেশি। কিন্তু তারপরও এ দুটিই মানুষের বশংবদ। মানুষের চেয়ে বেশি ক্ষমতাশালী তারা নয়। তাহলে শুধু এ যুক্তিতে নারীরা কেন হেয় গণ্য হবে! 

বেগম রোকেয়া বললেন, 'যাহা যাহা পুরুষ পারিবে তাহাই নারী পারিবে।' সন্দেহ নেই- দেড়শ বছর পর আজকের নারীরা এর সবটাকে বাস্তব করতে না পারলেও অনেকটাকেই করেছেন। গল্পের মতোই শোনায়, তবে তার জন্য যে তিল তিল শ্রমে তাকে এগোতে হয়েছে তা হয়তো কিছুটা গল্পের মতোই শোনাবে আজকের কিশোরী-তরুণীদের কাছে। 

বেগম রোকেয়ার জন্ম ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর। তার বাবা ছিলেন জমিদার। শিক্ষিত, জ্ঞানী, ছয়টি ভাষায় পারদর্শী। কিন্তু তার মেয়েদের তিনি লেখাপড়া শেখাতে পারেন নি সামাজিক অপবাদের ভয়ে। পড়াশোনা তো দূরে থাক, মেয়েদের বাইরে বের হওয়া পর্যন্ত মানা ছিল। তবে পুরুষের সাফল্যের পেছনে যেমন নারীর ভূমিকা থাকে, তেমনি নারীর সাফল্যের পেছনেও পুরুষের ভূমিকা থাকে। বেগম রোকেয়ার বড় ভাই ইব্রাহিম সাবের চান নি তার বোনেরা পিছিয়ে থাকুক। তাই বাড়ির সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়তো তখন বোনদের নিয়ে বসতেন তিনি। মোমবাতি জ্বালিয়ে পড়াতেন আরবি, ফার্সি, উর্দু ও বাংলা। বিয়ে এবং জীবনের নতুন অধ্যায় একসময় কিশোরী রোকেয়াকে বিয়ে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হলো। এখানেও প্রজ্ঞার পরিচয় দিলেন বড় ভাই সাবের। বোনের চেয়ে ২০ বছর বেশি বয়সী এক বিপত্নীক পুরুষকে বেছে নেন পাত্র হিসেবে। পেশায় ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন ছিলেন উচ্চশিক্ষিত এবং উদারমনা একজন মানুষ। ইব্রাহিম সাবের বুঝলেন, এখানে যদি বোনকে বিয়ে দেন তাহলে বোনের লেখাপড়া বন্ধ হবে না। 

তা-ই হলো। বিয়ের পর স্বামীর কাছেই শুরু হলো বেগম রোকেয়ার আসল লেখাপড়া। কিছুটা উর্দু তো তিনি আগেই শিখেছিলেন। বিয়ের পর সেই শিক্ষা তার উর্দুভাষী স্বামীর সহায়তায় আরও প্রসার লাভ করল। স্বামীর কাছ থেকে ইংরেজিতেও খুব ভালো দক্ষতা অর্জন করলেন। সুন্দর ইংরেজি রচনা করতে পারতেন তিনি। তবে বাংলাভাষার প্রতি ছিল তার গভীর টান। বাংলা তিনি ছাড়লেন না। লেখালেখি শুরু করলেন বাংলাতেই। তার সাহিত্যচর্চার সূত্রপাতও স্বামীর অনুপ্রেরণায়। ১৯০২ সালে 'পিপাসা' নামে একটি বাংলা গদ্য রচনার মধ্য দিয়ে শুরু হয় তার লেখক জীবন। তার উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মের মধ্যে রয়েছে প্রবন্ধ সংকলন 'মতিচুর' এবং বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি 'সুলতানার স্বপ্ন'।

'সুলতানার স্বপ্ন'কে বিশ্বের নারীবাদী সাহিত্যের এক মাইলফলক ধরা হয়। অন্তঃপুরবাসিনীর বেরিয়ে আসা তার বিবাহিত জীবন বেশিদিন স্থায়ী হলো না। ১৯০৯ সালের ৩ মে মারা গেলেন স্বামী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন। স্বামীর মৃত্যুর পর আত্মপ্রকাশ করলেন এক নতুন বেগম রোকেয়া। লেখালেখির বাইরে সমাজে বদল আনার দিকে এবং নারীশিক্ষার বিস্তারে মন দিলেন। আসলে শুধু কথা দিয়ে বা বুদ্ধিজীবী মহলে নিজের চিন্তাচেতনা ছড়িয়ে দিয়েই থেমে থাকেন নি তিনি। বাস্তব কাজে ব্রতী হয়েছিলেন। ১৯০৯ সালের ১ অক্টোবর ভাগলপুরে প্রতিষ্ঠা করলেন 'সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল'। 

একটা বেঞ্চ, পাঁচজন ছাত্রী। কিন্তু মুসলিম নারীদের পড়াশোনাকে রীতিমতো অপরাধ গণ্য করা হতো সেসময়কার সমাজে। অনেক চেষ্টা করলেন। নিলেন বোরকা পরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্রী সংগ্রহের উদ্যোগও। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হাল ছাড়তে বাধ্য হলেন। চলে এলেন কলকাতায়। তখন তার বয়স ৩০ বছর। কলকাতায় স্বজনহীন, পরিচিতহীন শহরে নতুন করে শুরু করলেন সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুলের কার্যক্রম। এবার অবস্থা একটু ভালো হলো। দুটো বেঞ্চ আর আটজন ছাত্রী। একজন নারী- কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি নেই, বাড়ির বাইরে কাজ করার অভিজ্ঞতা নেই, নতুন শহরে নেই কোনো চেনা পরিচিত মানুষ! 

একমাত্র পুঁজি তার দৃঢ় মনোবল আর গভীর বিশ্বাস। মনোবল হলো যে একদিন তিনি এই অজ্ঞানতা আর অসচেতনতা থেকে নারীদের বের করে আনতে পারবেন। আর বিশ্বাস এই যে, জ্ঞানই পারে একমাত্র এদের মুক্তি দিতে। সেসময় পর্দাপ্রথা এত কঠোর ছিল যে বেগম রোকেয়াকে তার স্কুলে মিটিং করতে হতো পর্দার অন্তরাল থেকে। 

সেসময়কার নারীদের মানসিকতা কিরকম ছিল তা বোঝা যায় বেগম রোকেয়ারই একটি লেখা থেকে- একবার অনেক সাধ্য সাধনার ফলে নানান প্রকার প্রলুব্ধ করিয়া একটি শিক্ষিত মুসলমান পরিবারের মহিলাকে আঞ্জুমানের (বেগম রোকেয়ার প্রতিষ্ঠিত মহিলা সমিতি) মিটিংয়ে আনা গেল। যথাসময়ে মিটিংয়ের কাজ শেষ হইল। সমবেত মহিলারা গৃহে ফিরিবার জন্যে প্রস্তুত হইলেন। এই সময় নবাগতা মহিলাটি আমার সম্মুখে আসিয়া বলিলেন, সভার নাম করিয়া বাড়ির বাহির করিলেন, কিন্তু সভা তো দেখিতে পাইলাম না! 

তবে সামাজিক প্রতিকূলতা ছাড়াও অর্থনৈতিক প্রতিকূলতার মুখেও তাকে পড়তে হয়। বার্মা ব্যাংক নামে সেসময়কার একটি ব্যাংকে ৩০ হাজার টাকা রেখেছিলেন বেগম রোকেয়া। একদিন জানলেন, ব্যাংকটি দেউলিয়া হয়ে গেছে। আনজুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম- আজকের মহিলা সমিতি এক পর্যায়ে এসে বুঝলেন- নারীদের সংগঠিত না করলে এ স্কুল টিকিয়ে রাখা যাবে না। তাই ১৯১৬ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন আনজুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম। মানে ইসলামি নারী সমিতি। আজকের মহিলা সমিতি এরই রূপান্তর। এ সংঠন করতে গিয়েও তাকে অনেক প্রতিকূলতা সইতে হয়েছে। কিন্তু সব ধরনের প্রতিকূলতার মুখেই তিনি ছিলেন অবিচল। 

গায়ের চামড়াকে পুরু করিতে হইবে এ নিয়ে একবার তার সহকর্মীদের উদ্দেশ্যে বলছিলেন, যদি সমাজের কাজ করিতে চাও, তবে গায়ের চামড়াকে এতখানি পুরু করিয়া লইতে হইবে যেন নিন্দা-গ্লানি উপেক্ষা অপমান কিছুতেই তাহাকে আঘাত করিতে না পারে। মাথার খুলিকে এমন মজবুত করিয়া লইতে হইবে যেন ঝড়ঝঞ্ঝা বজ্র বিদ্যুৎ সকলেই তাহাতে প্রতিহত হইয়া ফিরিয়া আসে। আসলে একজন মানুষ বড় হবে কি না, কালকে জয় করবে কি না তা নির্ভর করে তার সাহস-বিশ্বাস এবং এই নিন্দা-গ্লানিকে সহ্য করার ক্ষমতার ওপর। 

বেগম রোকেয়া তাই করেছিলেন। যে কজন ছাত্রী তার স্কুলে পড়াশোনা করেছেন তারাই পরর্বতীকালে বাংলার নারী জাগরণে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। নারী হিসাবে মেয়েরা আজ যেখানে পৌঁছেছেন, তারা সেখানে পৌঁছতেন না, যদি নারীর উন্নতির জন্য বেগম রোকেয়ার মতো মনীষীর অবদান না থাকত। 

একজন মানুষের মৃত্যু কর্মময় মৃত্যু কীভাবে হতে পারে তার প্রমাণও হচ্ছেন বেগেম রোকেয়া। মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত তিনি স্কুলে কাজ করেছেন। তার অভ্যাস ছিল প্রতিদিন তিনি রাতের বেলায় লিখতেন। মৃত্যুর দিন রাতেও তাই করেছেন। আর সে অবস্থায়ই একসময় ঢলে পড়লেন মৃত্যুর কোলে টেবিলের ওপর মাথা রেখে। সকালবেলা কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে দরজা খুলে দেখা গেল যে তিনি আর ইহলোকে নাই। অনন্ত যাত্রায় যাত্রা করেছেন। তার জন্মদিন এবং মৃত্যুদিন একই ৯ ডিসেম্বর।

তার সবশেষ অসমাপ্ত লেখা ছিল নারীর অধিকার শিরোনামের। এ থেকেই বোঝা যায় যে স্রষ্টা তাকে কতটা কবুল করেছিলেন যে জীবনকে তিনি নিবেদিত করেছিলেন যে উদ্দেশ্যে সে কাজ করতে করতেই তিনি মৃত্যুর কাছেও চলে গেলেন। এই ক্ষণজন্মা নারীর প্রতি শ্রদ্ধা।

এমএম/


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি