ঢাকা, বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪

নূর অাহামদ : শ্রমিক রাজনীতির কিংবদন্তী

অালী অাদনান :

প্রকাশিত : ১২:৩৬, ৮ ডিসেম্বর ২০১৮ | আপডেট: ১৫:৪৮, ৮ ডিসেম্বর ২০১৮

‘মৃত্যু’। চিরাচরিত সত্যগুলোর মধ্যে অন্যতম। কিন্তু তারপরও কিছু মৃত্যু অামাদের নাড়া দেয়। জগৎ সংসারে এনে দেয় কিছু শুণ্যতা। কিছু মৃত্যুর অভাব কখনোই পূরণ হয় না। পূরণ করার কথা কেউ ভাবেও না। তোমনি ভাবে চট্টগ্রামের রাজনীতিতে একটি শুণ্যতার সৃষ্টি হলো। চলে গেলেন কিংবদন্তী তুল্য শ্রমিক রাজনীতিবিদ নূর অাহমেদ। যিনি গত পঞ্চাশ বছরেরও বেশী সময় নিজেকে গণমানুষের কাজে লাগিয়েছেন। সীতাকুন্ড- বাড়বকুন্ড- ফৌজদারহাট শিল্পাঞ্চলে তিনি ছিলেন মহিরূহ। পুঁজিবাদী রাজনীতির ঝনঝনানি নয়, পেশী শক্তির দাপট নয়, সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের অধিকার অাদায়ের রাজনীতিই তাকে করে তুলেছিল রাজনীতির নায়ক। নূর অাহমেদ কখনো এমপি, মন্ত্রী হননি। চকচকে গাড়ীও তার ছিল না। তবু ছিলেন সীতাকুন্ডের সাধারণ মানুষের দীর্ঘদিনের নেতা।
প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা নূর অাহমেদ- এর জন্ম হয়েছিল সাধারণ একটি পরিবারে। অাশেপাশের খেটে খাওয়া মানুষদের লড়াই দেখতে দেখতেই বেড়ে উঠেছিলেন তিনি। নূর অাহমেদের রাজনীতির হাতেখড়ি হয়েছিল ছয় দফা অান্দোলনে। সমসাময়িক কালে অন্য অনেকের মতো তিনিও বাঙ্গালীর এ মুক্তির সনদকে প্রথম দীক্ষা হিসেবে নিয়েছিলেন। ৬৯- এর গণঅভ্যুথানে তিনি ছিলেন সীতাকুন্ডের প্রথম সারির সংগঠক। মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি প্লাটুন কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মুখোমুখি গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে তার সাহস ও ব্যক্তিত্ব তার পরবর্তী রাজনীতির গতি নির্ধারণ করে দিয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে শেখ ফজলুল হক মণি বাংলাদেশ অাওয়ামী যুবলীগ গঠন করলে তিনি সীতাকুন্ড উপজেলায় (তৎকালীণ সীতাকুন্ড থানা) এর অাহবায়কের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। একই সময়ে তিনি দেশের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত গাড়ী প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান প্রগতি শ্রমিক লীগ প্রতিষ্ঠা ও এর সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সারাদেশে যেসব নেতাকর্মী মোশতাক- জিয়া সরকারের রোষানলে পড়েছিল নূর অাহামেদ ছিলেন তাদের একজন। এমন প্রেক্ষাপটে তিনি সীতাকুন্ড থানায় বাকশাল- এর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। সভাপতি হয়েছিলেন অ্যাডভোকেট নুরুল অালম। একই সময়ে তিনি বাড়বকুন্ড-কুমিরা- ফৌজদারহাট শিল্পাঞ্চলে জাতীয় শ্রমিক লীগ প্রতিষ্ঠা ও সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। যা বর্তমানে উপজেলা শ্রমিক লীগের কাঠামোতে পরিচালিত হয়। নূর অাহমেদ কতোটা জনপ্রিয় তা একটা সহজ বিষয়ে প্রমাণিত, তা হলো তিনি মৃক্যুকালীন মুহুর্তেও এই সংগঠনের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। একটি সংগঠনে টানা এতোদিন নেতৃত্ব ধরে রাখা প্রমাণ করে নির্মোহ ও সততার অগ্নিপরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ ছিলেন।


৮০ ও ৯০ - এর দশকে এ অঞ্চলের রাজনীতি ছিল শ্রমিক নির্ভর। স্বৈরাচার বিরোধী অান্দোলনকে দাউ দাউ অাগুনে রূপ দিয়েছিল ছাত্ররা ও শ্রমিকরা। অার শ্রমিকদের মধ্যমণি ছিলেন নূর অাহামেদ। সে সময় তিনি সীতাকুন্ড উপজেলায় অাট দশ, সাত দল ও পাঁচ দলের সমন্বয়ে গঠিত বাইশ দলীয় ঐক্যজোটের অাহবায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি এতোটাই জনপ্রিয় ছিলেন তাকে এরশাদ সরকারের পুলিশ গ্রেফতার করলে স্থানীয় জনগণ ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করেছিল। তুলে ফেলা হয়েছিল রেললাইনের স্লিপার। বাধ্য হয়ে সরকার তাকে মুক্তি দিয়েছিল। অামাদের দেশে অন্য অনেক রাজনীতিবিদরা এমন জনপ্রিয়তার সুযোগ গ্রহণ করে। অনেকের ভাগ্য পরিবর্তনের হাতিয়ার হয় জনপ্রিয়তা। কিন্তু নূর অাহামেদ ছিলেন ব্যতিক্রম। যার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৮৮ সালে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে। এরশাদ সরকারের দেওয়া ঐ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে তিনি ছিলেন সীতাকুন্ডে বাকশাল ও অাওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী। তৎকালীন সরকারের পাতানো নির্বাচনে কেন্দ্র দখল ও ভোট বাক্স ছিনতাই ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। সীতাকুন্ডেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তুমুল জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও নূর অাহামদের নিশ্চিত বিজয় কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। ছাত্র-শ্রমিক-জনতা চেয়েছিল এর পাল্টা জবাব দিতে। কিন্তু বাধ সাধেন নূর অাহামদ।

তিনি বলেন, ‘উপজেলা চেয়ারম্যান হতে গিয়ে যদি অামাকে পেশীশক্তি প্রয়োগ করতে হয় তাহলে অামার চেয়ারম্যানগিরি দরকার নেই।’

তার এই নীতিবোধ মর্যাদার দিক থেকে তাকে অন্য অনেকের উর্দ্ধে তুলে দিয়েছিল।
জাতীয় রাজনীতির অাদর্শিক প্রশ্নে ১৯৯১ সালের ১৪ অাগস্ট বাংলাদেশ অাওয়ামী লীগ ও বাকশাল এক হয়ে যায়। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অানুগত্য প্রকাশ করেন অাব্দুর রাজ্জাক। সারা দেশের মতো সীতাকুন্ডেও বাকশাল অাওয়ামী লীগে মিশে যায়। নূর অাহামদ চট্টগ্রাম উত্তর জেলা অাওয়ামী লীগের শ্রম সম্পাদকের দায়িত্ব পান। মৃত্যুকালীন সময়েও  উপজেলা শ্রমিক লীগের সভাপতির পাশাপাশি তিনি এ দায়িত্ব পালন করছিলেন। পর পর তিনবার তিনি জাতীয় শ্রমিক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। প্রয়াত রাজনীতিবিদ অাহসান উল্লাহ মাষ্টারের বিশ্বস্ত সহকর্মী ছিলেন নূর অাহামদ।
শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের পক্ষে তিনি ইরাক, থাইল্যান্ড, লিবিয়া ও লেবানন সফর করেন। এসব সফরকালীন সময়ে তিনি সঙ্গে করে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক প্রতীক ‘নৌকা’ নিয়ে যেতেন। ইরাক সফরকালীন সময় ইরাকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন- এর হাতে নৌকা তুলে দিলে সাদ্দাম হোসেন তাকে অনেক্ষণ জড়িয়ে ছিলেন।
নূর অাহামদ একা নন, তার পুরো পরিবারটিই বঙ্গবন্ধুর অাদর্শের রাজনীতিতে দু:সময়ে ভুমিকা রেখেছিলেন। যা সীতাকুন্ড- উত্তর চট্টগ্রামের রাজনীতিতে বিরল দৃষ্টান্ত। নূর অাহামদ- এর অাপন সহোদর নুরুল অামিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শাহজালাল হল ছাত্রলীগের সিনিয়র সহ সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার অারেক ভাই অাজম খান সীতাকুন্ড ডিগ্রী কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ভিপি পদপ্রার্থী ছিলেন। তার ভাই নাসির অাহামদ স্থানীয় মুরাদপুর ইউনিয়ন অাওয়ামী লীগে অর্থ সম্পাদকের দায়িত্ব ছিলেন বেশ কয়েকবার। নূর অাহামদ- এর ভাইদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ইউসুফ খান সীতাকুন্ড ডিগ্রী কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন।
বর্তমানে তিনি সৌদি অারবস্থ রিয়াদ মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বঙ্গবন্ধুর অাদর্শের পেছনে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিবারের এক নিষ্ঠতার সাথে লেগে থাকা খুব কঠিন ব্যাপার। অার সেই কঠিন কাজটি করে গেছেন নূর অাহামদ ও তার পরিবার।
নূর অাহামদ অাজ নেই। স্ত্রী অানোয়ারা বেগম, চার মেয়ে, তিন ছেলে, পাঁচ ভাই, তিন বোন, দলীয় অসংখ্য নেতা কর্মী, হাজার হাজার শ্রমিক রেখে পাঁচ ডিসেম্বর তিনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন।
সাদা পাঞ্জাবী, সাদা পাজামা, কাঁধের উপর শাল ছিল তার নিয়মিত পোষাক। ধূমপান করতেন। ধীর পায়ে ব্যক্তিত্বের সঙ্গে তিনি হাঁটতেন অসংখ্য সাধারণ মানুষের মাঝ দিয়ে। তিনি সচেতন ছিলেন কিন্তু অহংকারী ছিলেন না। তার মধ্যে কোন ছলচাতুরী বা ভন্ডামী ছিল না। কোন জটিল মারপ্যাঁচের ধার ধারতেন না। তিনি ছিলেন তার মতো। এ অঞ্চলের মানুষ অারেকজন নূর অাহামদ পাবেন না। কিন্তু চাইলে পেতে পারে তার অাদর্শ, সংগ্রাম। যা টিকে থাকে যুগের পর যুগ। তার স্মৃতির উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা।
অা অা//

 


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি