ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ০৫ জুন ২০২৫

পুশ-ইন: নিখিল ভারতের এ কী অমানবিক রূপ!

সাঈফ ইবনে রফিক

প্রকাশিত : ১৭:৪৯, ৩ জুন ২০২৫ | আপডেট: ১৮:২৯, ৩ জুন ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

ভারতকে বহু বছর ধরে শুধু দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম দেশ নয়, বরং বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের মডেল হিসেবে বিবেচনা করা হতো। ধর্ম, ভাষা, জাতি—সবাইকে নিয়ে এক ছাতার নিচে সমান মর্যাদায়, সহাবস্থানের যে স্বপ্ন মহাত্মা গান্ধী, নেহরু, আম্বেদকররা দেখেছিলেন, তা কেবল সংবিধানেই নয়, ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতিতেও গভীরভাবে প্রোথিত ছিল। কলকাতার দুর্গাপূজায় মুসলিম শিল্পীর অংশগ্রহণ, দিল্লির ঈদের ভোজে হিন্দু সহপাঠীর উপস্থিতি, কেরালার গির্জায় হিন্দু বা মুসলিম বন্ধুদের স্বতঃস্ফূর্ততা—এসবই ছিল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জ্বল নিদর্শন। পার্লামেন্টে সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব, সাহিত্য-সংস্কৃতির মেলবন্ধন এবং আঞ্চলিক ভাষার মর্যাদা—এসবই প্রমাণ করেছে, ভারতীয় গণতন্ত্র কেবল আইন আর ভোটে নয়, জীবনের প্রতিটি স্তরে প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি ও অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্যের বাস্তবায়ন।

কিন্তু সম্প্রতি যে চিত্র ‘পুশ-ইন’ নীতির মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে, তা নিছক প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং ভারতের সেই বৈচিত্র্য-সহিষ্ণুতার পথ থেকে ভয়ানক এক বিচ্যুতি। ভারতীয় মিডিয়ার বড় অংশ আজ এমনভাবে প্রচার করছে, যেন হাজার হাজার “অবৈধ বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী” দেশের নিরাপত্তা-ঝুঁকি—তাদের খুঁজে বের করে ঝটপট সীমান্তে ঠেলে দিলে সমস্যার সমাধান হবে। অথচ বাস্তবতা হলো, এদের মধ্যে অনেকে বছরের পর বছর ভারতে কাজ করেছেন, সংসার গড়েছেন, সন্তানদের স্কুলে ভর্তি করেছেন—এমনকি কারও হাতে রয়েছে ভারতীয় ভোটার কার্ড বা আধার নম্বরও। এখন শুধুমাত্র বাংলা ভাষায় কথা বলা কিংবা মুসলিম পরিচয় থাকলেই তাদের “বিদেশি” বলে অপমান, হয়রানি ও উচ্ছেদ করা হচ্ছে।

সবচেয়ে বড় আশঙ্কার বিষয়, সীমান্ত থেকে বহু দূরের রাজ্য—গুজরাট, দিল্লি, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, এমনকি আসাম থেকেও বাংলাভাষী মুসলিম শ্রমিকদের কেবল ভাষা-ধর্ম দেখে আটক করে ভারতীয় বিমানবাহিনীর উড়োজাহাজে তুলে এনে সীমান্তে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। কোনো পরিচয় যাচাই, আইনগত শুনানি, মানবিক মূল্যায়ন ছাড়াই—রাতের আঁধারে, অস্ত্রের হুমকিতে মানুষকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও শরণার্থী সুরক্ষার নন-রিফুলমেন্ট নীতি, আইসিসিপিআর, শিশু অধিকার সনদ—সবই বলে, ব্যক্তিগত শুনানি ও ঝুঁকি-বাছাই ছাড়া কাউকে এভাবে ফেরত পাঠানো যায় না। ভারতের সংবিধানেও নাগরিক অধিকার, সমতা ও ন্যায়বিচারের স্পষ্ট অঙ্গীকার রয়েছে।

আইন ও ন্যায়বিচারকে পাশ কাটিয়ে, ভাষা ও ধর্মকে অপরাধের প্রধান মানদণ্ড বানিয়ে রাষ্ট্রীয় উচ্ছেদ—এটা কেবল মানবিক বিপর্যয় নয়, ভারতের গণতান্ত্রিক কাঠামোর এক ভয়াবহ স্খলন। সুপ্রিম কোর্টের যেসব নির্দেশ বা আইনি যুক্তি তুলে ধরা হচ্ছে, সেগুলো খণ্ডিতভাবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে—যেমন মাত্র ৬৩ জনের জন্য নির্দিষ্ট নির্দেশকে হাজারো মানুষের ওপর প্রয়োগ করা হচ্ছে। মৌলিক অধিকারের প্রশ্নে ভারতের আদালতেও চ্যালেঞ্জ উঠছে; বহু ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীরা হ্যাবিয়াস করপাস বা আইনি আপিলের সুযোগ পাচ্ছেন না।

বাংলাদেশের সীমান্তে বিজিবি ও সরকারের সংস্থা বারবার কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে, পতাকা বৈঠক, আনুষ্ঠানিক চিঠি, সীমান্তে নজরদারি, উদ্ধার তৎপরতা—সবকিছুতে বারবার বলা হচ্ছে, যৌথ যাচাই ছাড়া কাউকে ফেরত নেওয়া যাবে না, এভাবে সীমান্তে ফেলে যাওয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এমন একতরফা পদক্ষেপ পারস্পরিক আস্থা, স্থিতিশীলতা ও আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারকেও চ্যালেঞ্জ করছে।

ভারতের গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোর বড় উদাহরণ বহু বছর ধরেই ছিল—বিভিন্ন ধর্মের উৎসবে একে অপরের পাশে থাকা, পার্লামেন্টে ভাষাভিত্তিক ও সংখ্যালঘু প্রতিনিধিত্ব, সাহিত্য-সংস্কৃতিতে পারস্পরিক মেলবন্ধন। আজ এনআরসি, সিএএ, হিন্দুত্ববাদী উগ্রতা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সিদ্ধান্তের চাপে মুসলিম-বিদ্বেষ ও বাংলাদেশ-ফোবিয়া মাথা তুলছে। ভারতীয় মিডিয়ার বড় অংশও আজ মানবিক সংকটের খবরকে গৌণ করে জাতীয়তাবাদী প্রচারণায় মেতেছে।

সবশেষে, ভারতের বর্তমান পুশ-ইন নীতি তাদের দীর্ঘদিনের অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য থেকে বড় এক বিচ্যুতি। ভাষা, ধর্ম, দরিদ্রতা নয়—নাগরিকত্বের মূল হওয়া উচিত মানবিকতা, ন্যায়বিচার আর মৌলিক অধিকার। গণতন্ত্রের যে অঙ্গীকার নিয়ে ভারত বিশ্বে সম্মান পেয়েছিল, সেটিকে রক্ষা করাই এখন সময়ের দাবি। দুই দেশের সীমান্তে বাস করা প্রতিটি মানুষের মর্যাদা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই হবে প্রকৃত মানবতার জয়—এটাই সত্যিকারের নিখিল ভারতের রূপ হওয়া উচিত, আজকের এই অমানবিক চিত্র নয়।

লেখক: সাঈফ ইবনে রফিক
কবি ও সাংবাদিক 

 

এমবি//


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি