ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪

বদলে যাক আপনার জীবন

পথচারী

প্রকাশিত : ১৪:৫২, ২৭ জুলাই ২০২১

জীবন বদলাতে হলে দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হলে প্রথম বিশ্বাস করতে হবে যে, আমি আমাকে বদলাতে পারবো। বিশ্বাস করে কতজনই তো বদলেছেন নিজেকে। জন্মেছেন দরিদ্র পরিবারে। বেড়ে উঠেছেন অযত্ন-অবহেলায়। পরিণত জীবনে হয়েছেন খ্যাতিমান-ক্ষমতাবান। ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি বিজ্ঞানী এ পি জে আবদুল কালাম, হোন্ডা মোটরসের মালিক সইচিরো হোন্ডা, ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি লুলা ডি সিলভা আর যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি বারাক হোসেন ওবামা এই বদলে যাওয়া মানুষদেরই কয়েকজন। এরা জন্মগ্রহণ করেছিলেন কুঁড়েঘরে। পরিণত জীবনে থেকেছেন প্রাসাদে। শুরু করেছিলেন শূন্য থেকে, পৌঁছেছেন পূর্ণতায়। বাইরে থেকে কেউ তাদের জীবনকে বদলে দেয়নি। তারা জীবন বদলেছেন বিশ্বাস দিয়ে, নিজের মনের শক্তিকে ব্যবহার করে।

আপনিও বদলাতে পারেন আপনার জীবন। ভাবুন কোন কোন ক্ষেত্রে আপনার পরিবর্তন প্রয়োজন। কী বদলাতে চান। কোন ক্ষতিকর অভ্যাসচক্র থেকে আপনি বেরুতে চান। এটা হতে পারে শারীরিক কোনো অসুস্থতা, অহেতুক ভয়, মানসিক কোনো দুর্বলতা, হৃদয়ঘটিত কোনো জটিলতা, পরিবারে অবজ্ঞা, আর্থিক অক্ষমতা, শিক্ষায় আপাত ব্যর্থতা, সৃজনশীল বন্ধ্যাত্ব, পেশাগত বা সামাজিক কোনো অচলাবস্থা। অবস্থা যা-ই হোক, এখান থেকে আপনি বেরিয়ে আসতে পারেন। আপনার আগে এসব জটিলতা থেকে অসংখ্য মানুষ বেরিয়ে এসেছেন, অবগাহন করেছেন সোনালি সাফল্যে; তাদের দুঃখ-কষ্ট-অক্ষমতা স্থান পেয়েছে অতীতের বিস্মৃত স্মৃতিতে।

জীবনের যা যা বদলানো দরকার তা আপনি চিহ্নিত করেছেন। এবার বিশ্বাস করতে শুরু করুন, আমিও পারবো আমার সবকিছু বদলাতে। মনে বিশ্বাস আসতে চাচ্ছে না? সংশয় বার বার উঁকি দিয়ে বিশ্বাসকে দুর্বল করে দিচ্ছে? দিক! কিছু আসে যায় না। সংশয়কে হটিয়ে বিশ্বাসকে প্রবল করার হাতিয়ার এখন আপনার কাছেই রয়েছে। এই মোক্ষম হাতিয়ারের নাম অটোসাজেশন বা বদলে বিষয় বার বার আত্মস্ত করা। অটোসাজেশনে ছোট ছোট কথা শব্দ বার বার উচ্চারিত হয়ে সৃষ্টি হয় বিশ্বাস ও শক্তির এক অন্ত-অনুরণন যা বদলে দেয় সব কিছু, তৈরি করে নতুন বাস্তবতা।

বার বার উচ্চারিত ইতিবাচক শব্দ বা কথার প্রভাব সম্পর্কে সাধকরা সচেতন ছিলেন আদিকাল থেকেই। প্রতিটি ধর্মেই ইতিবাচক কথা বা বাণীকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। নবীজী (সা.) বলেছেন, কারো সাথে দেখা হলে সালাম বিনিময়ের পর কুশল জিজ্ঞেস করলে বলবে, ‘শোকর আলহামদুলিল্লাহ, বেশ ভালো আছি’। কেন বলেছিলেন, বললে কী হবে, না বললে কী ক্ষতি, এসব আমরা হাজার বছর ধরেও বৈজ্ঞানিকভাবে বুঝি নি।

বিশ শতকের শুরুতে মনোবিজ্ঞানীরা এই ‘ভালো আছি’ বলার গুরুত্ব বুঝতে শুরু করলেন। ফরাসী মনোবিজ্ঞানী ডা. এমিল কোয়ে বাস্তব গবেষণায় দেখলেন— ভালো কথা বার বার বললে ভালো জিনিসগুলোই তার দিকে আকৃষ্ট হয়। সে ভালো হতে থাকে। তিনি তার ক্লিনিকে রোগমুক্তির জন্যে প্রয়োগ করলেন অটোসাজেশন। ১৯১০ থেকে ১৯২৬ সাল পর্যন্ত মাইগ্রেন, মাথাব্যথা, বাতব্যথা, অ্যাজমা, প্যারালাইসিস, তোতলামি, টিউমার, গ্যাস্ট্রিক, আলসার, অনিদ্রা থেকে হাজার হাজার মানুষকে ভালো করেছেন এই অটোসাজেশন প্রয়োগ করে। তার এই নিরাময় প্রক্রিয়ায় রোগীকে কিছুদিন সকালে ও বিকেলে একাগ্র মনোযোগ দিয়ে ২০ বার বলতে হতো ‘ডে বাই ডে ইন এভরি ওয়ে আই অ্যাম গেটিং বেটার অ্যান্ড বেটার’। ব্যস, রোগ উধাও।

বাংলাদেশে ফলিত মনোবিজ্ঞানের পথিকৃত প্রফেসর এম ইউ আহমেদ নিজের ওপর এই অটোসাজেশন প্রথম প্রয়োগ করেন ১৯৩৪ সালে। প্যারাটাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে ৪ মাস ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালে থাকার পর ডাক্তাররা তার বাঁচার আশা বাদ দিয়ে তাকে বাড়ি নিয়ে যেতে বলেন। তাকে বজরা নৌকা করে বরিশালে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। বুড়িগঙ্গায় নৌকায় উঠেই তিনি ভেতর থেকে বাঁচার মন্ত্র পেলেন। অন্তর থেকেই বার বার বলতে লাগলেন—‘আমি বাঁচতে চাই! আমি বাঁচবো!’ তিনি সুস্থ হয়ে উঠলেন। একই প্রক্রিয়ায় ১৯৭৩ সালেও ৬৪ বছর বয়সে ‘ক্লিনিক্যালি ডেড’ অবস্থা থেকে বেঁচে ওঠেন তিনি।

প্রফেসর এম ইউ আহমেদ শুধু নিজের ওপরই অটোসাজেশন প্রয়োগ করেন নি; তাঁর প্রবর্তিত মেডিস্টিক সাইকোথেরাপি প্রক্রিয়ায় অটোসাজেশন দিয়ে হাজার হাজার রোগী বিভিন্ন জটিল ব্যাধি থেকে মুক্তি পেয়েছেন বিস্ময়করভাবে। মনোদৈহিক রোগ নিরাময়ে প্রফেসর এম ইউ আহমেদ অত্যন্ত সফলভাবে অটোসাজেশন প্রয়োগ করেন তিন দশক ধরে।

এত সাফল্য এত বদলের হাজার হাজার ঘটনা বিস্মিত করতে পারে আপনাকে। যে কেউ মনে করতে পারেন এগুলো অলৌকিক, এরা ভাগ্যবান। আসলে এগুলো কোনো অলৌকিক ঘটনা নয়। এগুলো বিজ্ঞানের কার্যকারণের ফলাফল। তারপরও যদি একে অলৌকিক মনে করেন, তাহলে এ অলৌকিকত্ব আপনিও ঘটাতে পারেন। পারেন ভাগ্যবানের তালিকায় নিজের নাম লেখাতে। কারণ এরা আপাত অসম্ভবকে সম্ভব করতে যে উপকরণ ব্যবহার করেছেন তা এখন আপনার হাতের মুঠোয়। এর নাম অটোসাজেশন।

স্বাভাবিকভাবেই আপনার মনে আবারও প্রশ্ন জাগবে অটোসাজেশন অর্থাৎ শুধু কিছু কথা কিছু শব্দ কিছু বাক্য কিভাবে জীবনে এত বড় পরিবর্তন আনতে পারে। এ রহস্যও বিজ্ঞানীরা আস্তে আস্তে উন্মোচন করেছেন। ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টরা হাজার হাজার গবেষণা করে দেখেছেন মানুষের নার্ভাস সিস্টেম বাস্তবতা ও কল্পনার মধ্যে কোনো তফাত করতে পারে না। বাস্তব ঘটনা দেখলে যে ব্রেন ওয়েভ সৃষ্টি হয়, সেই একই ঘটনা কল্পনা করলেও একই ব্রেন ওয়েভ সৃষ্টি হয়। যে কারণে সিনেমায় আমরা অভিনয় দেখে হাসি আবার কান্নায় বিষাদে মন ভরে ওঠে। আপনি জানেন পুরোটাই অভিনয়। কিন্তু তারপরও উত্তেজনা বা বিষাদের রেশ কাটাতে সময় লাগে। এই সূত্রকেই মনোবিজ্ঞানীরা কাজে লাগাচ্ছেন কখনো অটোসাজেশনে, কখনো মনছবিতে।

নবীজীর (সা.) ‘শোকর আলহামদুলিল্লাহ, বেশ ভালো আছি!’ বলতে বলার রহস্য এখানেই। আপনি দিনে ২০/৩০/৪০ জনের সাথে দেখা হওয়ার পর যদি একই কথা বলেন, তাহলে ৪০ বার আপনার মস্তিষ্কে এই ভালো থাকার বাণী যাচ্ছে। বার বার একই বাণী যাওয়ার ফলে মস্তিষ্কে ভালো থাকার তরঙ্গ তৈরি হচ্ছে। ভালো থাকার আকুতি বাড়ছে। নিউরো সাইন্টিস্টরা দীর্ঘ পরীক্ষায় দেখেছেন, যখনই মস্তিষ্কে নতুন তথ্য যায়, মস্তিষ্কে নতুন ডেনড্রাইট অর্থাৎ একটি নিউরোন থেকে আরেকটি নিউরোনে নতুন সংযোগ পথ তৈরি হয়। ক্রমাগত একই তথ্য যেতে থাকলে মস্তিষ্কের কর্মকাঠামো বদলে যায়। মস্তিষ্ক তখন এই নতুন বাস্তবতা সৃষ্টিতে লেগে যায়।

অটোসাজেশনে আপনি আসলে একই কথা, একই বাণী বার বার বলে মন ও মস্তিষ্কের বিশাল শক্তিভাণ্ডারকে সক্রিয় করে তোলেন। আপনার মনোদৈহিক প্রক্রিয়া নিজের চাওয়াকে পাওয়ার জন্যে প্রস্তুত ও যোগ্য করে তোলে। পাওয়ার মনোদৈহিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলেই চাওয়া পরিণত হয় বাস্তবতায়। অতি দ্রুতই বদলে যায় সব। মনে হয় সব অলৌকিক। নিজেকে মনে হয় ভাগ্যের বরপুত্র।

তা হলে আর দেরি কেন, এখনই শুরু করুন। হাজার অটোসাজেশন পড়ে ফেলুন একবসায়। খুব বেশি সময় লাগবে না। আপনার যেগুলো প্রয়োজন চিহ্নিত করুন। তারপর একটি কাগজে লিখে ফেলুন।

অটোসাজেশন দেয়ার জন্যে একটু নিরিবিলি জায়গায় বসুন। চোখ বন্ধ করুন। কয়েকবার লম্বা দম নিয়ে দম ছেড়ে দেহকে একটু শিথিল করুন। মনোযোগকে একাগ্র করুন আপনার তালিকায় লেখা অটোসাজেশনগুলোর প্রতি। আপনি একটি ভালো সিনেমা যে মনোযোগ দিয়ে দেখেন, মন যেভাবে আটকে থাকে সিনেমার পর্দায়, ঠিক ততটুকু মনোযোগ হলেই চলবে। বার বার মনে মনে উচ্চারণ করতে থাকুন অটোসাজেশনগুলো। কল্পনায় রঙিন হয়ে উঠুক কথামালা। ২০ থেকে ১০০ বার মনে মনে বলুন এই একই কথা। দিনে দুবার এই একই অনুশীলন করুন। এছাড়া দৈনন্দিন কাজের যেকোনো ফাঁকে মনে মনে ২/৪ বার দিতে পারেন এই অটোসাজেশন। অটোসাজেশনের বার বার অনুশীলন আপনার মনোদৈহিক প্রক্রিয়ায় সৃষ্টি করবে নতুন অনুরণন, নীরবে-নিঃশব্দে ভেতর থেকেই বদলাতে শুরু করবেন আপনি। বদলে যাবে আপনার জীবন।

প্রিয় পাঠক, কার্যকারিতা বেশি মনে হওয়া বা আপনার স্বাচ্ছন্দের প্রেক্ষিতে বর্তমান বা ভবিষ্যৎ কালজ্ঞাপক শব্দবে যে কোনোটি দিয়েই আপনি অটোসাজেশনগুলোকে চর্চ াকরতে পারেন। যেমন, আপনি ‘করব’, ‘হবে’ বা ‘থাকবে’ বলতে পারেন। অথবা বলতে পারেন ‘করছি’, ‘হচ্ছে’ বা ‘থাকছে’।

প্রতিদিন মনে মনে শতবার বলুন- আমি বিশ্বাসী, আমি সাহসী, আমি পারি, আমি করব, আমার জীবন, আমি গড়ব।

এএইচ/


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি