ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪

বাংলাদশে হাইটেক র্পাক: সফল করার উপায়

ইঞ্জিনিয়ার আবুবকর হানিপ

প্রকাশিত : ১৩:১৯, ২২ নভেম্বর ২০১৯ | আপডেট: ১৩:২৬, ২২ নভেম্বর ২০১৯

বাংলাদেশে ২৮টি হাইটেক পার্ক প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছে সরকার। এই লক্ষ্যে বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক অথরিটি (বিএইচটিপিএ) গঠন করা হয়েছে আগেই আইসিটি মন্ত্রাণালয়ের অধীনে। 

বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটি, সিলেট হাইটেক প্রজেক্ট, বঙ্গবন্ধু হাইটেক প্রজেক্ট রাজশাহী, শেখ কামাল হাইটেক পার্ক এবং ইনকিউবেশন সেন্টারসহ বেশ কিছু প্রকল্প অন্যতম। লক্ষ্য ২০২৫ সাল নাগাদ ‘চতুর্থ বিপ্লব’ নামের এ্‌ই নতুন ডিজিটাল বিপ্লব থেকে বছরে ৫ বিলিয়ন ডলার আয় করা। ২০১৭ সালে যেটা সর্বসাকুল্ল্যে ছিল ৮০০ মিলিয়ন ডলার। তার অর্থ হলো এই ছয় বছরের মধ্যে আয় ৬ গুণ বাড়ানো। সেটা কি রাতারাতিই সম্ভব? নাকি এই আইটি পার্কগুলোকে সফলভাবে দাঁড় করানোর জন্য আমাদের কিছু করনীয় আছে? 

যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশের একজন আইটি উদ্যোক্তা হিসেবে আমার নিজস্ব ভাবনায় বেশ কিছু সমস্যা চিন্হিত করেছি এবং ভারতে আইটি অফিস থাকার সুবাদে তাদের অগ্রযাত্রা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষন করার সুযোগও হচ্ছে আমার প্রতিনিয়ত। সেসব বিষয় কিছুটা তুলে ধরতে চাই আপনাদের সামনে। 

হাইটেক পার্ক কি?

তথ্য প্রযুক্তির উন্নয়নের মাধ্যমে সারা বিশ্বের যে ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক নেটওয়ার্ক, সেখানে থেকে আয় বাড়ানোর জন্য, বিশেষায়িত এলাকা বা প্রতিষ্টান-এটাই  হলো হাইটেক বা আইটি পার্ক। এটা কিছুটা ইপিজেড বা এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন এর মত, যেখানে বিশ্বের বড় বড় গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠান বা রপ্তানীকারকরা বিশেষ সুবিধায় শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন এবং সেই ব্যবস্থাপনায় গার্মেন্টস শিল্প পার্ক ধারণা ও পরিচালয়নায় বাংলাদেশ মোটামুটি সফল । 

ভারতের হরিয়ানা রাজ্যে ২টি অফিস (গুরগাও এবং নয়ডা) থাকার সুবাদে এবং যুক্তরাষ্ট্রে গত ১৫ বছর ধরে আইটি ট্রেনিং ও জব প্লেসমেন্ট এর কাজ করতে গিয়ে আইটি পার্ক সম্পর্কে নিবিড় জানাশোনার সুযোগ হয়েছে। সেখানে একটি সফল আইটি পার্কের জন্য, নানা প্রজাতির প্রযুক্তি সুবিধা , প্রযুক্তি সেবা ক্রেতা, প্রযুক্তি জনশক্তি, অর্থাৎ ভেন্ডর এবং প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলির বিকিকিনির পরিবেশ, ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ শিল্প, প্রভৃতির একটি মিলন মেলা বা অনূকুল পরিবেশ আইটি পার্কের সফল হওয়ার জন্য পূর্বশর্ত। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশে আমরা এই পার্কের ধারণা, হাইটেক পার্কের বেলায় কতটুকু নির্মাণ করতে পেরেছি বা পারছি।

ভারত কিভাবে আইটি বিপ্লবের সুবিধা নিচ্ছে?

২০১৭ সালের কথাই যদি আমরা ধরি তাহলে দেখবো, ভারত এ বছরে আইটি এবং প্রযুক্তি খাত থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলার আয় করছে। ঐ একই বছর আমরা করেছি ৮০০ মিলিয়ন ডলার। ২০২৫ সালের মধ্যে যেটা ৫ বিলিয়নে উন্নীত করার কথা, সেটা কি এমনি এমনিই আসতে পারে? 

ভারতের সুবিধা হচ্ছে, বিশ্বব্যাপী এর প্রযুক্তি দক্ষ জনশক্তির পরিচিতি। গার্মেন্টস এ যেমন বাংলাদেশের পরিচিতি আছে, ভারতের পরিচিতি আইটি ক্ষেত্রে। সারা বিশ্বের যত আউট সোর্সিং বাণিজ্য তার সিংহভাগ এখন ভারতীয়দের দখলে। 

সেখানে উদীয়মান মার্কেট হিসেবে বাংলাদেশকে ইন্টারনেট জগতে প্রতিষ্ঠিত করতে গেলে কিছু বিষয় সামনে আনতে হবে। তার আগে দেখে নেই কিভাবে ভারত সেটি করছে।

যুক্তরাষ্ট্রের যত ফরচুন ১০০ বা ফরচুন ৫০০ কোম্পানি আছে তাদের সামনের সারিতেই সিসকো, মাইক্রোসফট, আইবিএম এগুলি আছে। এসব ছোট বড় কোম্পানিগুলির অনেকেই তাদের প্রজেক্ট অফিস স্থাপন করেছে  ভারতে। কারণ একটাই, যুক্তরাষ্ট্রে যেই প্রযুক্তি কর্মীকে বছরে দেড়লাখ দুইলাখ ডলার বেতন দেয়া লাগে, ভারতে এর পাচ ভাগের এক ভাগ দিলেই চলে। 

তবে, দক্ষকর্মীর এই সহজলভ্যতাই একমাত্র কারণ নয়। এর সাথে ভারতের আইটি পার্কগুলি এসব ফরচুন কোম্পানিগুলিকে এক লোকেশনের মধ্যেই প্রযুক্তি জনশক্তির সাথে সাথে, অন্যন্য শক্তিও যোগান দিতে পারছে।  এখন বাংলাদেশে একটিও ফরচুন ১০০ বা ৫০০ কোম্পানিকে আমরা নিতে পারিনি। কারণ, আমাদের যতটুকুই দক্ষ জনশক্তি আছে সেটিও আমরা ভালভাবে প্রচার করা শুরু করিনি এখনো। আমাদের এখন পর্যন্ত কার্যক্রম হলো, কম্পিউটার বিকিকিনি এবং পার্ক মানেই হলো আইটি প্রশিক্ষণ। যেখানে কেবল শিক্ষার্থীদের যাতায়াত। সেখানে আর্ন্তজাতিক ভেণ্ডর, ডেভেলপার, ভাল হোটেল, নিবিড় রাজধানীর সাথে যোগাযোগ এগুলির ঘাটতি রয়েছে পরিকল্পনায়।

মাইক্রোসফট কেন ভারতে? বাংলাদেশে নয় কেন?

বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান যেমন গুগল, মাইক্রোসফট, সিসকো অথবা ওরাকল বা সমগোত্রীয় কোম্পানিগুলো  তাদের প্রজেক্ট অফিস ভারতে নিয়েছে। এ্‌সব উদাহারণ ভারতের আইটি সার্ভিসকে বিশ্বব্যাপী বিক্রি করার জন্য বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। আমরা যদি  চাই,  এসব কোম্পানিগুলো ভারতের পরিবর্তে  বাংলাদেশে আসুক, তাহলে আগে প্রশ্ন করতে হবে কেন তারা বাংলাদেশে আসবে?

-আমরা কি তাদের জন্য  ১০ বছর, বা ২০ বছরের লোভনীয় ট্যাক্স মওকুফ করছি?

-তাদেরকে কি সুবিধামত জায়গায় জমি দিচ্ছি?

-তাদের অর্থের লেনদেনের জন্য পর্যাপ্ত অর্থনৈতিক রেয়াত দিচ্ছি?

- তাদের সিকিউরিটি বা নিরাপত্তা দুশ্চিন্তা দূর করছি?

- ২৪/৭ আইটি পার্ক এবং সংলগ্ন এলাকায়  নির্বিগ্ন কাজের পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারছি? যেহেতু আমেরিকার সময়ের সাথে বাংলাদেশের সময় তফাৎ আছে ১০ ঘণ্টার।

-আইটি পার্কের আশে পাশে বা অভ্যন্তরে আমরা কি বিশ্বমানের হোটেল, মানসম্মত রেস্টুরেন্ট, বিনোদন, হাইস্পিড ইন্টারনেট, বিরামহীন বিদ্যুৎ, যাতায়াত, নারী-পুরুষ কর্মীদের রাতে কাজ করার উপযোগী নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে পারছি?

সহজ বিষয় হলো, আমেরিকা বা গ্লোবাল প্রতিষ্ঠান গুলি কম মূল্যে পণ্য বা সার্ভিস পেতে চায় এটা সত্য। কিন্তু বাস্তবতা হলো, শ্রম বা সেবার মূল্য ভারতে কিছু পরিমাণ বেশি হলেও তারা ভারতে থাকতেই বেশি পছন্দ করবে, কেননা, ভারতে প্রযুক্তি দক্ষতা সময়ের পরিক্ষায় উত্তীর্ণ। সেখানে বাংলাদেশ এখনও হাটি হাটি পা পা করছে। এক্ষেত্রে একটি বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠানের প্রজেক্ট অফিস বাংলাদেশে নিতে হলে তাদেরকে অভাবনীয় রেয়াত সুবিধা অফার করতে হবে। যেই প্রণোদনার আকর্ষনে তারা তাদের প্রজেক্ট নিয়ে আসবে বাংলাদেশে। যদি ফরচুন ১০০ বা ৫০০ কোম্পানি নাও যায়, তাহলে ফরচুন ১০০০ মানের কোম্পানিদের কে টার্গেট করতে হবে। কেননা, দুই একটি কোম্পানিকে নিতে পারলে আরো প্রতিষ্ঠান তাদের অনুসরণ করতে পারবে।

কেন বড় প্রতিষ্ঠানের প্রজেক্ট অফিস দরকার বাংলাদেশের আইটি পার্কে?

টেকনোলজি ট্রান্সফার:  

এটাই হওয়া উচিৎ সবচে বড় যুক্তি। ধরুন, মাইক্রোসফট একটি প্রজেক্ট অফিস করলো বাংলাদেশের কোন এক আইটি পার্কে। তো, সেখানে প্রজেক্ট করা মানেই হল, স্থানীয়ভাবে লোক নিয়োগ দেয়া। দেখা গেল নির্ধারিত প্রজেক্ট শেষের পরে যদি প্রতিষ্ঠান সে জায়গা ত্যাগও করে, অথবা ঐ প্রকল্প যদি শেষও হয়ে যায়, সেখানে কর্মরত বাংলাদেশিরা একটি দক্ষতা বা অভিজ্ঞতা অর্জন করলো। এই অভিজ্ঞতা তারা অন্যখানে বাংলাদেশের নিজস্ব উদ্যোগে সফল ভাবে সংযোজন করতে পারে। এই সুযোগটুকুও করে দিতে হবে আমাদের প্রযুক্তি শিক্ষার্থী বা যারা উদ্যোক্তা তাদের।

বিদেশি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন: 

২০২৫ সালের মধ্যে আমাদের টার্গেট অনুযায়ী প্রযুক্তি খাত থেকে ৫ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে, কেবল দেশীয় ছেলে মেয়েদের ফাইভআর , কিংবা আপওয়ার্কে কাজ করলেই চলবে না। বরং, বৃহাদাকারের সফটওয়ার রপ্তানি, জনশক্তি রপ্তানী, আইটি সল্যুশন রপ্তানি করতে হবে। সফটওয়ার, আইওটি সামগ্রীর উৎপাদন দেশীয়ভাবেই করতে হবে এবং সেগুলি রপ্তানি থেকেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে। না হলে এই পরিসংখ্যানগুলি কেবলই বাগাড়াম্বাড় হিসেবে পরিচিতি পাবে। 

চতুর্থ স্তম্ভ প্রতিষ্ঠা:

গার্মেন্টস শিল্প বিপ্লব হয়েছে বহু বছর আগেই। নানা প্রতিকুলতায় এখনও বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের অগ্রযাত্রা অব্যাহত আছে। এই পোশাক শিল্প এবং সাথে জনশক্তি রপ্তানি বা প্রবাসী শ্রমিকরাই দেশের অর্থনীতির প্রাণশক্তি। কিন্তু সময়ের আবর্তনে এই দুই অর্থনৈতিক খাতের উপর অধিক নির্ভরতা কমানোর পথে একমাত্র বিকল্প হচ্ছে চতুর্থ স্তম্ভ বা প্রযুক্তি বিপ্লব। সেই প্রযুক্তি বিপ্লবের জন্যেই বাইরের ফরচন প্রতিষ্ঠানগুলিকে বাংলাদেশে নিয়ে যাওয়া দরকার যেমনি ভাবে বাইরের গার্মেন্টস শীর্ষ প্রতিষ্ঠানগুলিও কাজ করছে বাংলাদেশে। 


ইঞ্জিনিয়ার আবুবকর হানিপ

হাইটেক পার্কে বড় কোম্পানিকে নেয়ার জন্য কি কি করতে হবে?

মার্কেটিং: 

বিশ্বমার্কেটে চীন তাদের যাত্রা শুরু করেছে ১৯৯০ সালের পর থেকে। এখন সারা বিশ্বই জানে যে, কম দামে আধুনিক প্রযুক্তির সেরা মার্কেট চীন। কিন্তু সেই পরিচিতি পাওয়ার আগ পর্যন্ত কি করনীয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলি তাদের নিজেদের চেষ্টায় বা ইচ্ছায় কি যাবে সেখানে? নাকি এখানে জোরালো মার্কেটিং একটি বড় বিষয়? 

এই মার্কেটিং করবে কারা? অবশ্যই প্রাথমিকভাবে সরকার। দ্বিতীয় ভাগে বাংলাদেশের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান গুলি, কিন্তু সেখানেও সরকারী অবকাঠামোর সুবিধা তাদের দরকার। কিভাবে? সেই ব্যাখ্যা দেয়ার আগে বলছি কিভাবে সরকার এই মার্কেটিংটি করতে পারে।

দূতাবাসের মাধ্যমে: যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ দূতাবাসে যিনি ইকোনোমিক মিনিস্টার আছেন বা কর্মাশিয়াল কাউন্সিলর আছেন তারা নানা ফরচুন কোম্পানিগুলোকে পরিদর্শনে যেতে পারেন নিয়ম করে। সেখানে বাংলাদেশের আইটি পার্ক, দক্ষ জনশক্তি, বা অনন্য যেসব সুবিধা  প্রণোদনা হিসেবে দেয়া হচ্ছে বা সুযোগ আছে সেগুলির প্রচারপত্র নিয়মিত সরবরাহ করতে পারেন।

এর বাইরে নিয়মিত সেমিনার, ট্রেড শো অথবা রোড শো’র  ব্যবস্থা করে ফরচুন কোম্পানীগুলোর প্রতিনিধিদেরকে দাওয়াত করতে পারে দূতাবাস। সেখানে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় আইটি প্রতিষ্ঠান বা সফটওয়ার প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে আমেরিকান প্রতিষ্ঠানগুলোর ভাবের বিনিয়ম করার ব্যবস্থা করা। শুধু তাই নয়, দূতাবাসের কর্মাশিয়াল উইং এসব কোম্পানীর সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে ফলোআপ মিটিং করার ব্যবস্থা করা। 

কেননা, একটি বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে নিয়মিত ফরচুন প্রতিষ্ঠানের সাথে প্রাথমিক যোগাযোগ অনেক সময় অসম্ভব হয়ে দাড়ায়। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ দূতাবাসের মধ্যস্থতা থাকলে ব্যবসায়ী বা উদ্যোক্তাদের পথ অনেক খানি সহজ হয়ে যায়। এই কাজ শুধু যুক্তরাষ্ট্র তো নয় বরং ইউরোপের অনন্য দেশ অথবা এশিয়ার উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলিতেও করা যেতে পারে। 

- কনসাল্টেন্ট নিয়োগ:  দূতাবাসের যেহেতু অনেক রকম কাজ করতে হয়, সেহেতু আইটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেয়া যেতে পারে। ভারতের ক্ষেত্রে হাজারো প্রতিষ্ঠান ভারতীয় দূতাবাস এবং এককভাবে নিজেরাও দূতাবাসের মাধ্যেম  পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে। তারা ভারতের প্রযুক্তি সক্ষমতাকে আমেরিকার বাজারে নিয়মিত তুলে ধরার কাজ করছে নানা ভাবে। কখনও সেমিনার, কখনও বড় আয়োজন, কখন বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচার, কখনও বা রোড শো বা ফেয়ার আয়োজন করে। বাংলাদেশের হাইটেক পার্ক বা প্রযুক্তি সক্ষমতাকে ছড়িয়ে দেয়ার মত বিপনন চোখে পড়ার মত নয় , অথবা একেবারেই নেই। 

- দূতাবাসের অবকাঠামো কাজে লাগানো: এর অর্থ হলো, দূতাবাসকে লিয়াজো করার কাজে লাগানো। আপনারা দেখে থাকবেন আমেরিকার বিভিন্ন ব্যবসায়ীরা যখন বাংলাদেশে যায়, বাংলাদেশের সরকার বা ব্যবসায়ীদের সাথে মিটিং করার ব্যবস্থা করে দেয় যুক্তরাষ্ট্রের ঢাকাস্থ দূতাবাস।  ধরুন, বাংলাদেশের ডেটাসফট, তারা নিজেরা কোন প্রতিষ্ঠানকে কাজের জন্য এ্যাপ্রোচ করতে সেই প্রতিষ্ঠানের প্রধানকে পেতে যে বেগ পেতে হবে, যদি দূতাবাস থেকে কোন ফোন করে অথবা দাওয়াত দেয়া হয় ঐ একই প্রতিষ্ঠানের প্রধানকে, তার সাথে ডেটাসফট এর মিটিং হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি সৃষ্টি হয়। সে কারণে আটটি পার্ক সফল করতে হলে দূতাবাসের অবকাঠামো কাজে লাগতে হবে।

মূল কথা হলো, এই বিয়ষে যদি বাংলাদেশ তার দক্ষতা প্রচার করতে চায়, অথবা ২/৪টি বড় কোম্পানিকে বাংলাদেশে নিতে চায় তাহলে উডপেকার বা কাঠঠোকরার মত লেগে থাকতে হবে। 

বিনিয়োগ প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও দুর্নীতি পুরোপুরি বন্ধ করা : 

প্রতিটি বড় বিনিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুই ধরনের নীতির বিষয়ে পরিষ্কার অবস্থান ঘোষণা থাকা উচিৎ। এক- এন্ট্রি  ক্রাইটেরিয়া বা সূচনার সময়কার চুক্তির শর্ত  আর দুই.- এক্সিট ক্রাইটেরিয়া বা বেরিয়ে যাওয়ার সময়কার শর্তাবলী।

অনেক সময় দেখা যায়, শর্তাবলীর অনেক কিছুই পরিষ্কার থাকে না। অনেক প্রতিষ্ঠান প্রাথমিক শর্তে বিনিয়োগ করলেও পরে অনন্য বিয়ষাবলী সামনে চলে আসে যা তাদেরকে হতচকিত করে। আবার কোন প্রতিষ্ঠান যদি বিনিয়োগ  করে, তার বিনিয়োগের লভ্যাংশ সহজ শর্তে সে ফেরত নিতে পারবে কিনা, এসব বিষয়াবলীতে পরিষ্কার আইনি ঘোষণা থাকা প্রয়োজন। কেননা, এর উপরে নির্ভর করে বিনিয়োগ সর্ম্পকিত সুনাম। এই সুনাম বা দূর্নামই বিদেশি বিনিয়োগের পথে বড় নিয়মক হিসেবে কাজ করে। এ জন্য ওয়ালস্ট্রিট সহ বিদেশি বিনিয়োগের জন্য আলাদা দপ্তরকে দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে। 

আমি বলছিলাম বড় কোম্পানিকে বাংলাদেশে টানতে হলে কিছু লোভনীয় প্রনোদনা দেয়ার কথা। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে অনেক সময় উল্টোচিত্র দেখা যায়। অনেক সময় বিদেশি কিছু প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করতে চাইলেও, স্থানীয় পর্যায়ে, রাজনৈতিকভাবে অথবা প্রশাসনের ক্ষমতাধরদের তরফ থেকে ব্যবসার ভাগ চাওয়া হয়। অথবা নির্দিষ্ট পরিমান চাদা দাবী করা হয়। তাতে শুরুতেই বিগড়ে যান বিদেশি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তারা। এক্ষেত্রে এই দুর্নীতির মূলোৎপাটন করাটা একটা বড় কাজ।

কোর্স কারিকুলামকে আধুনীকিকরণ: 

বাংলাদেশে প্রতি বছর লক্ষাধিক ব্যাচেলর ও মাস্টার্স পাশ করা শিক্ষার্থীরা বের হচ্ছে তাদের পড়াশুনা কেবল পাঠ্য বই কেন্দ্রীক। এসব শিক্ষার্থাকে হাতে কলমে কাজের উপযোগী করতে বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে উচিৎ। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে কম্পিউটর সাইন্স বা আইটি পড়াশুনায় মূল কোর্সের সাথে A B C D কোর্সের প্রবর্তন জরুরি।

A= Artificial Intelligence  ( Robotics, Machine Learning , IoT etc.) 

 B = Block Chain

C= Cyber Security 

D= Data Analytics ( Big Data) 

আমাদের মনে রাখতে হবে, বিশ্ব মার্কেট প্রতিযোগীতামূলক সার্ভিস কিনতে চায় সেটা সত্য, তবে তার চেয়ে বড় সত্য হলো তারা কাজ বা সার্ভিসের কোয়ালিটি ঠিক রেখে  নিদিষ্ট  সময়ের মধ্যেই ডেলিভারী চায়। সে কারনে বিজনেস এথিক্স, এবং বিজনেস ইংলিশ সহ  অন্যন্য বিষয়গুলি এসব পড়াশুনায় অর্ন্তভূক্ত করা দরকার। 

TTT= Train The Trainers

যারা প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেন তাদেরকে উপরোক্ত কোর্স কারিকুলাম বিষয়ে সম্যক প্রশিক্ষনের সাথে  বিশ্ব বাণিজ্য, প্রযুক্তি বদলের ধরন ইত্যাদি সর্ম্পকে নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিতে হবে।  যেন তারা সময়ের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ থাকতে পারেন এবং তাদের শিক্ষার্থীদেরকে সময়ের দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন।  

রিলায়াবেল কানেক্টিভিটি, রিলায়েবল ওয়ার্কফোর্স  এবং রিলায়েবল কমিউনিকেশন

এই বিষয়গুলি যদি আমরা প্রতিষ্ঠা না করতে পারি তাহলে একই সুবিধা নিয়ে বিদেশি উদ্যোক্তা বা ফরচুন প্রতিষ্ঠানগুলি  বরং চীন, ভারত ও হংকং এ যাবে। 

একটি ফরচুন প্রতিষ্ঠান যদি এখানে বিনিয়োগ করে তাকে যদি যোগ্য কর্মী আবার বিদেশ থেকে নিয়োগ দিতে হবে, তাহলে তারা কেন আসবে? সুতরাং দক্ষ জনশক্তি বড় বড় কোম্পানিগুলোর বাংলাদেশে আসার পেছনে একটি বড় নিয়ামক। এর বাইরে আরো যেসব বিষয় মনে রাখা দরকার সেগুলি নিম্নরুপ: 

লোকাল ইন্ডাস্ট্রি ফোকাস: 

আপাতত বড় বড় কোম্পানিগুলি বাংলাদেশে তাদের প্রকল্প বা প্রজেক্ট অফিস তৈরির আগে, স্থানীয়ভাবে এবং দেশীয় উদ্যোক্তাদেরকে কাজের সুযোগ দিতে হবে। যেমন বাংলাদেশের কোন মন্ত্রণালয় বা প্রকল্পের আইটি ম্যানেজমেন্ট এ আমরা দেখি বিদেশী ফার্মকে তারা সুযোগ দেন বেশি। এতে করে বিদেশীরা, তাদের নিজেদের লোকজনকে নিয়োগ দিয়ে নিজেরাই টাকা পয়সা নিয়ে যাচ্ছে। এ কথা সত্য যে টেণ্ডারের মাধ্যমে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলিকে না আনলে দেশে প্রযুক্তি জ্ঞানের বিস্তার ঘটবে না। তবে টেন্ডারের সময়  স্থানীয় এজেন্ট বা মধ্যস্থতাকারী কোম্পানিগুলোর জন্য  শতকরা ভাগে দেশীয় ছেলে-মেয়েকে নিয়োগ দেয়ার শর্ত থাকা উচিৎ। 

বাংলাদেশে দেশীয় ইন্ড্রাস্টির সাথে ইউনিভার্সিটিগুলোর যোগাযোগ একেবারেই নেই বললেই চলে। অথচ বাংলাদেশের শিল্প বিকাশ, অবকাঠামো উন্নয়নের প্রযুক্তিতে বাংলাদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনেক বেশি ভূমিকা রাখার সুযোগ থাকা দরকার ছিল। 

তাতে করে একটি দেশীয় প্রতিষ্ঠান নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সুযোগ হারাচ্ছে। মনে রাখতে হবে দেশীয়ভাবে কোন প্রতিষ্ঠান যদি নিজেদের প্রজেক্ট পরিচালনার মাধ্যমে ভুল ত্রটি শোধরানোর সুযোগ না পায় তবে তারা আমেরিকা বা বিশ্বের অন্যন্য দেশে নিজদেরকে গ্লোবাল কোম্পানি হিসেবে প্রতিষ্ঠার সুযোগ অর্জন করবে না। এক্ষেত্রে আইটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভারতের  ইনফোসিস, উইপ্রো, টিসিএস, টেকমাহিন্দ্রাসহ বেশ কিছু ফার্মের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। তারা নিদেজের দেশে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে, সেগুলি দেখিয়েই এখন আমেরিকা সহ ইউরোপের নানা দেশে বাণিজ্য সম্প্রসারণ করছে। চতুর্থ বিপ্লব করতে হলে শুধু দক্ষ জনশক্তি দিয়ে হবে না, দেশীয় আইটি প্রতিষ্ঠান গুলিকে বড় হওয়ার সুযোগ করে দিলে, তারাই বাণিজ্য নিয়ে আসবে দেশের জন্য। 

ঋণ প্রদানে শীথিলতা:  

আমাকে প্রায়শই আমার ছাত্ররা বাংলাদেশে অভিযোগ করেন সরকারী স্বল্প শর্তের ঋণ তাদের বেলায় জোটে না। একটি গার্মেন্টস শিল্প প্রতিষ্ঠা করতে গেলে সহজেই ঋণ পাওয়া যায়, কিন্তু একটি আইটি শিল্প প্রতিষ্ঠা করতে গেলে কোথাও্ টাকা চেয়ে পাওয়া যায় না। আইটি কে চতুর্থ স্তম্ভে রুপ দিতে হলে ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে, নিয়ম এবং অগ্রাধিকার এসব বিষয়ে যুগান্তকারী নীতি অবলম্বন করতে হবে। 

এর বাইরে, আমাদের নানা রকম নিরাপত্তা সুচকে উন্নয়ন ঘটাতে হবে। রাজনৈতিক স্থীরতা, নিরাপত্তা, ইন্টারনেট বা ডাটা নিরাপত্তা, ব্যাঙ্কিং নিরাপত্তা সেই বিষয়ে যত আর্ন্তজাতিক সুচক আছে ,সেগুলিতে ক্রমাগত উন্নতি ঘটাতে হবে।  এসব বিষয়ে দুর্নীতি এবং আমলাতান্ত্রিকতার অবসান ঘটানো গেলেই  কাঙ্খিত চতুর্থ স্তম্ভ খুব ভালভাবেই সম্ভব। 

পরিশেষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের স্লোগান আমাদের তরুণ প্রজন্ম, উদ্যোক্তা ও পরিকল্পনাকারীদের মনজগতে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে। ইন্টারনেটের সহজলভ্যতায় গ্রামের সাধারণ একজন ব্যবসায়ীও এখন আইটি ব্যবসায় নাম লেখাচ্ছেন বা প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করছেন। এটাই মাইন্ডসেট বা মনগজতের পরিবর্তন। এই পরিবর্তন সুচিত করার মূল স্থপতি হিসেবে পেছন থেকে কাজ করছেন প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়। আর বিস্বস্ত সেনাপতির মত প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক সেটির বাস্তবায়নে দিনান্ত পরিশ্রম করছেন। ‌

এই সকল কর্মকান্ডের উদ্দেশ্য হলো বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চতুর্থ একটি স্তম্ভ যোগ করা। কেননা, এখন পর্যন্ত কৃষি, গার্মেন্টস আর রেমিটেন্স এই তিন স্তম্ভেই দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশের অর্থনীতি । 

সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল বা এসডিজি অর্জনের পথে আমাদের দরকার আরো একটি স্তম্ভ। চতুর্থ বিপ্লবের যুগে এই চতুর্থ স্তম্ভের সফল হওয়াটা এখন সময়ের দাবী। সেই দিকেই ধাবিত হচ্ছে বাংলাদেশ। হাইটেক পার্কগুলি চতুর্থ স্তম্ভ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিপ্লব ঘটাতে পারলেই  উন্নত বিশ্বের কাতারে স্বগৌরবে উড়বে বাংলার লাল সবুজ পতাকা।  

লেখক: আইটি বিশেষজ্ঞ ও প্রধান নির্বাহী ও প্রতিষ্ঠাতা, পিপলএনটেক।


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি