ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও সাংবাদিক সাইমন ড্রিং

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৩:৪৩, ১২ জানুয়ারি ২০২০ | আপডেট: ১৪:০১, ১২ জানুয়ারি ২০২০

১৯৭১। মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন নানা দেশের অজস্র সহমর্মী মানুষ। যুদ্ধের মাঠে, রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে, শরণার্থী শিবিরে, প্রতিবাদে বা জনমত গঠনে কঠিন সেই সময়ে তাঁরা ভূমিকা রেখেছিলে নিজ নিজ জায়গা থেকে। যাদের মধ্যে অন্যতম একজন ছিলেন বিলাতি দৈনিক দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ–এর রিপোর্টার সাইমন ড্রিং।

তিনি তখন কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেনে কাজ করছেন। লন্ডনের সদর দপ্তর থেকে ফোন করে তাঁকে বলা হলো, -‘পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত। সেখানে বড় কিছু ঘটতে যাচ্ছে, তুমি ঢাকা যাও।’

সাইমন অনেক বছর ধরে সাংবাদিকতা করছিলেন লাওস, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম অঞ্চলে। পাকিস্তান বা পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে তাঁর কোনো ধারণাই ছিল না। তবু তিনি মার্চের ৬ তারিখে কম্বোডিয়া থেকে ঢাকায় আসলেন। পরদিন ৭ মার্চ। রেসকোর্স ময়দানে আওয়ামী লীগের জনসভা। যেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণটি প্রত্যক্ষ করলেন তিনি। যদিও একটি বাংলা শব্দও তাঁর বোধগম্য ছিল না, কিন্তু লাখ লাখ জনতার প্রতিক্রিয়া, তাদের চোখমুখের অভিব্যক্তি দেখে অনুভব করলেন, তিনি উপস্থিত হয়েছেন বিরাট এক রাজনৈতিক ঘটনার মধ্যে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ভীষণ বিক্ষুব্ধ, তারা ‘জয় বাংলা’ চায়। সংকল্প ও আশায় উদ্দীপিত চোখে তারা চেয়ে আছে শেখ মুজিবের দিকে।

সপ্তাহখানেকের জন্য ঢাকা এসে সাইমন ড্রিং আর ফিরে যাওয়ার কথা ভাবতে পারলেন না। পাকিস্তানের রাজনীতি ও পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের আন্দোলন–সংগ্রাম সম্পর্কে তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা শুরু হলো। শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগের অনেক নেতার সঙ্গে তাঁর পরিচয় হলো। সখ্য গড়ে উঠল অনেকের সঙ্গে। সর্বশেষ রাজনৈতিক ঘটনাবলি নিয়ে তিনি নিয়মিত প্রতিবেদন পাঠাতে লাগলেন লন্ডনে।

সাইমন উঠেছিলেন ঢাকার শাহবাগে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী হত্যাযজ্ঞ শুরু করার আগেই ঢাকায় সে সময় অবস্থানরত সব বিদেশি সাংবাদিককে ওই হোটেলে অবরুদ্ধ করে ফেলা হয়। সেনা কর্তৃপক্ষ তাঁদের বলে, শহরের পরিস্থিতি খুব খারাপ, নিরাপত্তার স্বার্থে তাঁদের হোটেলের ভেতরেই অবস্থান করতে হবে। অবরুদ্ধ বিদেশি সাংবাদিকেরা সারা রাত গোলাগুলির শব্দ শুনতে পান, কেউ কেউ জানালা দিয়ে দেখতে পান আগুন। পরদিন সকালেই তাঁদের বিমানবন্দরে নিয়ে তুলে দেওয়া হয় উড়োজাহাজে। কিন্তু পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ সাইমন ড্রিংকে খুঁজে পায়নি। তিনি প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে হোটেলেই লুকিয়ে ছিলেন। ২৭ মার্চ সকালে কারফিউ উঠে গেলে হোটেলের কর্মচারীদের সহযোগিতায় ছোট্ট একটি মোটরভ্যানে করে ঘুরে ঘুরে দেখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল, রাজারবাগ পুলিশ ব্যারাক ও পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকা। তারপর লেখেন ‘ট্যাংকস ক্র্যাশ রিভোল্ট ইন পাকিস্তান’ শিরোনামের এক প্রতিবেদন।

ঢাকায় দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর চালানো প্রথম দফার গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের প্রত্যক্ষ চিত্র উঠে আসে ওই প্রতিবেদনে। লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ৩০ মার্চ সেটা ছাপা হয়। এই প্রতিবেদন থেকেই বিশ্ববাসী জানতে পারে পাকিস্তানি বাহিনীর সেদিনের বর্বরতার কথা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত সঞ্চারের প্রাথমিক মুহূর্ত ছিল সেটি।

৩০ মার্চ সাইমনকে লন্ডন চলে যেতে হয়। তারপর কলকাতায় আসেন নভেম্বরে; সেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধের খবরাখবর সংগ্রহ করে পাঠিয়ে দিতেন লন্ডনের টেলিগ্রাফ পত্রিকায়। ১৬ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীর সঙ্গে ট্যাংকে চড়ে ময়মনসিংহ হয়ে প্রবেশ করেন মুক্ত বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়।

১৬ ডিসেম্বরের পর ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল সাইমনের। সাইমন তাঁকে জানান, ২৫ মার্চ বিদেশি সাংবাদিকদের বের করে দেওয়ার সময় তিনি লুকিয়ে থেকে গিয়েছিলেন। এরপর প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আমাকে খুঁজে পেলে তোমরা কী করতে?’ সিদ্দিক সালিক বলেছিলেন, ‘গুলি করে মারা হতো।’

এরপর সাইমন ড্রিং স্বাধীন বাংলাদেশে আবারও এসেছিলেন ২০০০ সালে। দেশের প্রথম বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল একুশে টিভি গড়ে তোলার প্রধান কারিগর তিনি। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর একুশে টিভি বন্ধ করে দেয়। ২০০২ সালের অক্টোবরে সরকার সাইমন ড্রিংয়ের ভিসা ও ওয়ার্ক পারমিট বাতিল করে তাঁকে অবিলম্বে বাংলাদেশ ত্যাগের আদেশ দিলে তিনি চলে যান।

সাইমন ড্রিংয়ের জন্ম ইংল্যান্ডে, ১৯৪৫ সালে। তিনি সংবাদপত্র ও টেলিভিশনের সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছেন ১৮ বছর বয়স থেকে। দেখেছেন ২২টি যুদ্ধ, অভ্যুত্থান ও বিপ্লব। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ভূমিকা ছিল প্রকৃত সহযোদ্ধার। ১১ জানুয়ারি ছিল তার জন্মদিন। একুশে টেলিভিশনের পরিবারের পক্ষ থেকে তার প্রতি শুভেচ্ছা।
এসএ/

 


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি