ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪

বাঘা যতীন: নজরুলের কবিতা-উপন্যাস-ধুমকেতুর অগ্নিনায়ক

ড. রকিবুল হাসান

প্রকাশিত : ১৬:৫২, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯

ব্রিটিশ-শাসিত ভারতবর্ষে স্বাধীনতার মন্ত্রে অগ্নিযুগের সশস্ত্র সংগ্রামের মহানায়ক বিখ্যাত বিপ্লবী বাঘা যতীন। আর কলমে আগুন ঝরিয়ে গণজাগরণ তৈরির মহান কবি-বিদ্রোহী অভিধায় জ্বলজ্বল কাজী নজরুল ইসলাম।

ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে এই দুই মনীষীর অবদানই অবিশ্বাস্যরকম। দুজনের নামই আকাশ-সমান উঁচু। একজন বাংলা সাহিত্যে সূর্য-তেজস্বী বিদ্রোহী কবি, অন্যজন সশস্ত্র সংগ্রামের পুরোধা ব্যক্তিত্ব। বাঘা যতীনের জন্ম ১৮৭৯ সালের ৮ ডিসেম্বর, মৃত্যু ১০ সেপ্টেম্বর ১৯১৫। আর নজরুলের জন্ম ১৮৯৯ সালের ২৪ মে, মৃত্যু ২৯ আগস্ট ১৯৭৬। দুজনের বয়সের ব্যবধান প্রায় বিশ বছর। নজরুলের যখন জন্ম বাঘা যতীন তখন দেশমাতৃকাকে স্বাধীন করার প্রত্যয়ে গোপন-আন্দোলনে পুরোপুরি যুক্ত। নজরুলের বয়স যখন মাত্র ১৬ বছর, যুগান্তর দলের প্রধান বাঘা যতীন তখন ব্রিটিশদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধ করে গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে নিজের শরীরের ব্যান্ডেজ নিজে হাতে ছিঁড়ে আত্মাহুতি দেন। এই মৃত্যুতে গোটা ভারতবর্ষ শোকে মূহ্যমান হয়ে পড়ে। 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, বিপ্লবী ভূপেন্দ্রকুমার দত্তসহ বিখ্যাত ব্যক্তিগণ এই মৃত্যুতে গভীর শোকাভূত হয়েছিলেন। কাজী নজরুল ইসলামের মনেও এ মৃত্যু ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলে। পরবর্তীতে বাঘা যতীন এবং তাঁর বীরত্বপূর্ণ মৃত্যু নিয়ে নজরুল তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘নব-ভারতের হলদিঘাট’ রচনা করেন। ‘কুহেলিকা’ উপন্যাসের বজ্রপাণি চরিত্র বাঘা যতীনের চরিত্র অবলম্বনে তৈরি করেন। ধুমকেতুতে বাঘা যতীনের ছবি দুবার ছেঁপেছিলেন। ভারতবাসীর কাছে বাঘা যতীনের এ মৃত্যু ছিল গৌরব ও অহংকারের। বাঘা যতীনকে নিয়ে অনেক কবি-সাহিত্যিক সাহিত্য রচনা করেছেন। নাটক-সিনেমা তৈরি করেছেন। কিন্তু বাঘা যতীনকে নিয়ে নজরুলের সাহিত্য বিশেষভাবে গুরুত্বের দাবি রাখে।

নজরুল ইসলাম তাঁর ‘ধুমকেত’ পত্রিকায় অষ্টম সংখ্যায় বাঘা যতীনের একক ছবি পৃষ্ঠা জুড়ে ছেঁপেছিলেন। একটি প্রবন্ধে বাঘা যতীন সম্পর্কে তিনি লেখেন ‘বাংলার বিপ্লব-যুগের প্রথম সেনানয়াক পুরুষ সিংহ, যতীন্দ্রনাথ’। ১২তম সংখ্যায় তিনি অন্যান্য বিপ্লবীদের ছবির সাথে বাঘা যতীনের ছবি আবারও ছাঁপেন। বাঘা যতীনের প্রতি নজরুলের যে কী অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা ছিল, এটা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

নজরুলের তৃতীয় উপন্যাস কুহেলিকা। এটিকে বিপ্লবী উপন্যাস হিসেবে আখ্যায়িত করা যেতে পারে। কুহেলিকায় প্রমত্ত’র নেতা বজ্রপাণি যে চরিত্রটি পরোক্ষভাবে উপন্যাসে উপস্থিত, তার মধ্যে বাঘা যতীনের চরিত্রটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যদিও আরও কিছু চরিত্রের মধ্যে বাঘা যতীনের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের পরিচয় ফুটে উঠেছে। নজরুলের বিপ্লবী জীবনে বাঘা যতীনের প্রভাব যে স্পষ্ট তা তাঁর কবিতাতেও লক্ষণীয়। নজরুলের প্রলয়-শিখা কাব্যগ্রন্থে ‘নব-ভারতের হল্দিঘাট’ কবিতাটি বাঘা যতীনের বীরত্বাগাথাকে কেন্দ্র করে তিনি রচনা করেছিলেন। 
ব্রিটিশ-বাহিনীর সঙ্গে বীরত্বপূর্ণ এবং প্রথম সম্মুখযুদ্ধ করে বাঘা যতীনের আত্মাহুতি দানের মাধ্যমে ভারত-স্বাধীনতা যে মহাকাব্য রচিত হয়েছিল, তার ভেতর ফুটে উঠেছিল নতুন এক ভারতের স্বপ্ন-বীজ, যার অঙ্কুরোদগম ঘটে বালেশ্বরের বুড়িবালাম নদীর তীরে। কাজী নজরুল ইসলামের মনে বিপ্লবী বাঘা যতীনের বীরত্বপূর্ণ আত্মাহুতি ব্যাপক প্রভাব ফেলে। 

এ কারণে নজরুল তাঁর উপন্যাসেও বাঘা যতীনকে গ্রহণ করে থাকতে পারেন এটি খুবই স্বাভাবিক। আরও একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে যাবার আগে নজরুল বিপ্লববাদী যুগান্তর দলের যোগাযোগে এসেছিলেন তাঁর শিক্ষক নিবারণ ঘটকের সান্নিধ্য লাভ করে। যুগান্তর দলের প্রধান নেতা ছিলেন বিপ্লবী বাঘা যতীন। তিনি ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে থাকা ছোট ছোট বিপ্লবী দলগুলোকে একত্রিত করে যুগান্তর দল গঠন করে তার নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন। যুগান্তর নামে একটি পত্রিকা ছিল। সেই পত্রিকাটি ছিল বিপ্লবীদের কর্মকাণ্ডের মূলকেন্দ্র। 

‘যুগান্তর নামে দৈনিক সংবাদপত্রে স্বাধীনতার মর্মবাণী প্রসারের ব্যবস্থা করেন স্বামী বিবেকানন্দের অনুজ ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের সম্পাদনায়। পত্রিকাটির নামকরণেই যুগান্তর দল প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। এর আগে অনুশীলন সমিতির মাধ্যমে বিপ্লবীরা তাঁদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন। 

প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, অনুশীলন সমিতি অবৈধ ঘোষণা করার সময় যতীন ও নরেন যুগান্তরে কাজ করতেন। আলিপুর মামলার সময় যতীন-নরেন যুগান্তর গ্রুপের পরিচালকরূপে পরিচিত হন। এই পরিচয় হতেই পরবর্তীকালে যুগান্তর সমিতি অনুশীলন সমিতির উত্তরাধিকার হয়। এর একটি বড় কারণ ছিল সে-সময় বিপ্লবী নেতারা বিশেষ কারণে বাঘা যতীন ও এম.এন. রায় অনুভব করেন বিপ্লবী শক্তিকে একক নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ করতে হবে। বিপ্লবীদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে সেই শক্তিকে গোটা ভারতে সম্প্রসারিত করতে হবে। আত্মত্যাগী বিশ্বস্ত বিপ্লবী তৈরি করতে হবে এবং বিপ্লবের মূল উদ্দেশ্যের কথা ভারতবাসীর মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। এই কঠিন দায়িত্বটি গ্রহণ করেন বাঘা যতীন। আর বাঘা যতীনের ডান হাত হিসেবে তাঁর পাশে দাঁড়ান এম.এন. রায়। এঁরা জার্মানি থেকে অস্ত্র এনে ভারত স্বাধীন করার পরিকল্পনা করেন। সে-মোতাবেক কাজও করেন। জার্মান গিয়ে ফলপ্রসু আলোচনা করেছিলেন। 

জার্মান থেকে আসা ম্যাভেরিক জাহাজ-ভর্তি অস্ত্রের ব্যাপারটি ফাঁস হয়ে যাওয়ায় বাঘা যতীনরা অস্ত্র খালাস করতে পারেননি। খালাসের আগেই অপরিকল্পিত এক সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয় বাঘা যতীনদের। সে যুদ্ধে গুলিবিদ্ধ বাঘা যতীন একদিন (৯ সেপ্টেম্বর গুলিবিদ্ধ হন, মৃত্যুবরণ করেন ১০ সেপ্টেম্বর ১৯১৭ ) পরেই মৃত্যুবরণ করেন। নজরুল কুহেলিকাতে লিখেছেন, ‘বিপ্লবীদের সেই ভীষণ জার্মান-ষড়যন্ত্র প্রকাশ হইয়া পড়িয়াছে। সারা দেশ ব্যাপিয়া পুলিশ জাল ফেলিয়াছে।’ 

বজ্রপাণি ও প্রমত্ত দুটি চরিত্র বাঘা যতীন ও এম.এন. রায়-এর চরিত্র অবলম্বনে সৃষ্টি, তা এখন অনুমেয়। নজরুল বাঘা যতীনের বিপ্লবী কর্মকাণ্ড দ্বারা যে প্রভাবিত হয়েছিলেন তা তাঁর সাহিত্যে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান। ভারতমাতাকে মুক্ত করার জন্য বাঘা যতীন ও এম.এন. রায় যে সশস্ত্র বিপ্লবী প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন, কুহেলিকার বজ্রপাণি এবং প্রমত্ত-র ভেতর তা লক্ষণীয়। 

বজ্রপাণি আর প্রমত্তর সম্পর্ক ও বিপ্লবী কর্মপন্থা ছিল বাঘা যতীন আর নরেনের অনুরূপ। প্রমত্ত  বিপ্লবী কর্মকাণ্ড পরিচালনা ও আন্দোলনকে সংগঠিত করার লক্ষে বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের  লেবাস গ্রহণ করতেন। অসংখ্য ভাষাতেও কথা বলতে পারতেন। অন্য দেশে গিয়েও সে দেশের মানুষের মতো হুবহু নিজেকে তৈরি করে নিতে পারতেন এবং সে দেশের ভাষা তাদের মতো করে বলতে পারতেন। সে কারণে তিনি যে ভিন দেশি এটা বোঝা মুশকিল ছিল। তাঁকে গ্রেফতারের জন্যে বিভিন্ন দেশে নানাভাবে চেষ্টা করা সত্ত্বেও তাঁর বহুরূপী রূপ ধারণের কারণে বারবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ এড়িয়ে নিজের বিপ্লবী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পেরেছিলেন। যেটি শরৎচন্দ্রের সব্যসাচী এবং নজরুলের প্রমত্তর ভেতর লক্ষণীয়। অনেকে  এক্ষেত্রে নিবারণ ঘটকের পক্ষে। কিন্তু বাস্তবতার প্রেক্ষিতে প্রমত্তর চরিত্র অঙ্কনে চরিত্র কাঠামো-বিন্যাস-ভাষাদর্শী-বহুরূপ-বহু নামধারী ও রাজনৈতিক কারণে বিভিন্ন দেশ পরিভ্রমণ এসব বিচারে এম. এন. রায়ের চরিত্রই প্রমত্ত চরিত্র নির্মাণে প্রভাব রেখেছে। প্রমত্তের নেতা বজ্রপাণি, ফলে এম এন রায় প্রমত্ত হলে বজ্রপণি নিঃসন্দেহে বাঘা যতীন। 

আরও একটি প্রসঙ্গ উল্লেখ করা যেতে পারে, পিণাকীর ফাঁসির ঠিক আগ-মুহূর্তে ম্যাজিস্ট্রেট তৎক্ষণাৎ মাটির টুপি খুলে তাকে যে অভিবাদন জানিয়ে বলেছিল, ‘আমি তোমায় প্রণাম করি বালক! মৃত্যু-মঞ্চই তোমার মতো বীরের মৃত্যুঞ্জয়ী সম্মান। তোমার মত বীরের বন্দনা করবার সম্মান জীবনের নাই।’ বাস্তবে তা পরিলক্ষিত হয় বাঘা যতীনের ক্ষেত্রে। বাঘা যতীনের মৃত্যুর আগ-মুহূর্তে চার্লস টেগার্ট তাঁকে বিচলিত কণ্ঠে বলেছিল, Tell me Mukherjee, What can I do for you? বাঘা যতীনের মৃত্যুর পর চার্লস টেগার্ট মাথার ক্যাপ খুলে তাঁকে স্যালুট করে বলেছিলেন, ÔI have high regard for him. I have met the bravest Indian, but- I had to perform my duty. বাঘা যতীনের বিপ্লব-পন্থা ও মৃত্যু এ উপন্যাসে নানাভাবে পরিগৃহিত হয়েছে তা অনুমান করা যেতে পারে। 

নজরুল তাঁর অবিশ্বাস্য আত্মদানের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা অর্পণ করে রচনা করেছিলেন, ‘নব-ভারতের হলদিঘাট’ নামক বিখ্যাত কবিতা। ‘প্রলয়-শিখা’ কাব্যের অন্তর্ভুক্ত এ কবিতাটি। দুর্ভাগ্যক্রমে, এদেশে বাঘা যতীনের মতো বিখ্যাত বিপ্লবী যেমন মূল্যায়িত হননি, এরকম এক মহান বিপ্লবী সাধারণ মানুষের জানা শোনার বাইরে চলে গেছে, তেমনিভাবে নজরুলের এই বিখ্যাত কবিতাটিও প্রায় একই করুণ পরিণতি বহন করেছে।

ব্রিটিশ-বিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামের মহানায়ক বিপ্লবী বাঘা যতীন। বালেশ্বরের বুড়িবালাম নদীর তীরে ১৯১৫ সালে ৯ সেপ্টেম্বর বিশাল ব্রিটিশ-বাহিনীর সঙ্গে বাঘা যতীন মাত্র চারজন কিশোর সহযোদ্ধা নিয়ে যে অসম সম্মুখযুদ্ধ ঘটান তা ছিল গোটা ভারতবর্ষের স্বাধীনতাকামী মানুষের কাছে অভিনব এক ঘটনা। এ যুদ্ধে বাঘা যতীন বগলে ও পেটে গুলিবিদ্ধ হন। বালেশ্বর হাসপাতালে নিজের শরীরে সমস্ত ব্যান্ডেজ নিজে হাতে ছিঁড়ে তিনি ১০ সেপ্টেম্বর আত্মাহতি দেন। এ-মৃত্যুর ভেতর দিয়েই রচিত হয় ভারতমাতার স্বাধীনতা মূলমন্ত্র। বাঘা যতীন চার্লস ট্রেগাট-এর নেতৃত্বাধীন বিশাল ব্রিটিশ বাহিনীর সঙ্গে অসম সম্মুখযুদ্ধ করে  ভারত-স্বাধীনতা আন্দোলনে তিনি যে মহাকাব্য রচনা করেছিলেন, সেদিনের ১৬ বছরের তরুণ নজরুলের মনে তা অগ্নিমশাল জ্বালিয়ে দেয়। তাঁর রক্তে জ্বলে ওঠে আগুন।

ব্রিটিশ-বাহিনীর সঙ্গে বীরত্বপূর্ণ এবং প্রথম সম্মুখযুদ্ধ করে বাঘা যতীনের আত্মাহুতি দানের মাধ্যমে ভারত-স্বাধীনতা যে মহাকাব্য রচিত হয়েছিল, তার ভেতর ফুটে উঠেছিল নতুন এক ভারতের স্বপ্ন-বীজ, যার অঙ্কুরোদগম ঘটে বালেশ্বরের বুড়িবালাম নদীর তীরে। কাজী নজরুল ইসলামের মনে বিপ্লবী বাঘা যতীনের বীরত্বপূর্ণ আত্মাহুতি ব্যাপক প্রভাব ফেলে। তাঁর গৌরব-গাথা এই আত্মাহুতি বারুদের মতো ভয়াবহ কবিতা হয়ে ওঠে বিদ্রোহী কবির কলমে। নজরুলের ভেতর এই বিশ্বাস গ্রোথিত হয়েছিল যে, বালেশ্বরের বুড়িবালামের তীরে ব্রিটিশ-সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে বাঙালি বিপ্লবীদের যে প্রথম সম্মুখযুদ্ধ সংঘটিত হলো, এর মাধ্যমেই ভারতের স্বাধীনতা-অর্জনে হলদিঘাট হিসেবে পরিগণিত হতে পারে এই বুড়িবালাম নদীর তীর। এ কারণেই নজরুল বাঘা যতীনের মরণ-যুদ্ধের এই স্থানটিকে নব-ভারতের হলদিঘাট বলে অভিহিত করেছেন। 

উল্লেখ্য, ১৭৫৭ খ্রি. সম্রাট আকবরের সৈন্যের বিরুদ্ধে রানা প্রতাপসিংহ-এর প্রবল যুদ্ধ হয়। সে-যুদ্ধে মেবারের রানা প্রতাপসিংহ পরাজিত হন। পরে প্রতাপসিংহ পুনরায় যুদ্ধ সংঘটিত করে তাঁর হারানো রাজ্যের অনেকখানি উদ্ধার করতে সক্ষম হন। 

কবি স্পষ্ট করে বলেছেন হল্দিঘাট থেকে নতুন ভারতের যাত্রা শুরু ‘দৈত্যপুরীর প্রাসাদে’ ‘বজ্রপাত’ ঘটানোর মাধ্যমে। আর এই বজ্রপাত ঘটলো ‘শ্মশান মৃত্যু-নাট’ উৎসবে। আর এ মৃত্যু-উৎসবের নায়ক বাঘা যতীন ও তাঁর সঙ্গী চিত্তপ্রিয়, মনোরঞ্জন, নীরেন। উল্লেখ্য, কবিতায় তিন জন যুদ্ধসঙ্গীর উল্লেখ আছে, জ্যোতিষের নাম উল্লেখ নেই। জ্যোতিষও এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। বাঘা যতীনকে নজরুল অভিহিত করেছেন ‘নবীন প্রতাপ নেপোলিয়ন’ অভিধায়। এসব যুদ্ধসঙ্গীরা বয়সে বালক, কিন্তু তাঁদের সাহস ব্যাঘ্রতুল্য। ব্যাঘ্রসাহসী এই চার বালককে নিয়ে ৩৫ বছরের তরুণ বাঘা যতীন বালেশ্বরের যুদ্ধে প্রথম ‘স্বাধীন-ভারত-মন্ত্র পাঠ’ করেন। এঁরা চার হাজার ব্রিটিশ-সৈন্যের সঙ্গে মরণ-যুদ্ধ করে ভারতমাতার সন্তানদের কাছে বলে গেলেন, ‘রক্ত সোপানে’ আরোহী হয়ে পরাধীনতার পাপ মুছতে। পরাধীন ভারতবাসীকে এই বিপ্লবীরা উদাত্তকণ্ঠে যে আহ্বান জানিয়েছিলেন নজরুলের কবিতায় তা অগ্নিরূপ লাভ করে। 

‘নব-ভারতের হলদিঘাট’ অন্তর্ভুক্ত কাব্য ‘প্রলয়-শিখা’ প্রকাশিত হয় আগস্ট ১৯৩০, ব্রিটিশসরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত হয় ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩০, নজরুলের বিরুদ্ধে মামলা হয় একই বছরে ১১ ডিসেম্বর। এরপর ৬ মাসের কারাদণ্ড। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৩০ সালে নজরুলের জামিন লাভ এবং আপিল। ১৯৩১ সালের ৪ মার্চ অনুষ্ঠিত গান্ধী-অরউইন চুক্তির ফলে সরকার পক্ষের অনুপস্থিতিতে ৩০ মার্চ ১৯৩১ কোলকাতা হাইকোর্টের রায়ে মামলা থেকে অব্যাহতি লাভ করেন। কিন্তু ‘প্রলয়-শিখা’ নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত থাকে। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয় ভারত স্বাধীনতা লাভ করার পর। অর্থাৎ ১৯৪৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি।

বিপ্লবী বাঘা যতীন যে নজরুল মানসে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত ছিলেন, তাঁর সৃষ্টিকর্মই সে প্রমাণ বহন করে। তিনি তাঁর বিখ্যাত পত্রিকা ‘ধুমকেতু’তে বাঘা যতীনের পৃষ্ঠাজুড়ে ছবি ছেপে তরুণসমাজকে তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত হওয়ার মেসেজটিই মূলত দিতে চেয়েছিলেন। উপন্যাস ও কবিতাতেও বাঘা যতীনকে উজ্জ্বলতর ও প্রধান হিসেবে উপস্থাপন করে, এই বীরের প্রতি নজরুল যে অকুণ্ঠ সম্মান ও শ্রদ্ধা দেখিয়েছেন, তা এককথায় অসামান্য ও অভাবনীয়। আর বাঘা যতীন দেশের জন্য নিজের সবচেয়ে মূল্যবান যে জীবন, তা সশস্ত্র যুদ্ধেও মাধ্যমে আত্মাহুতি দিয়ে যে অবিশ্বাস্য দেশপ্রেম দেখিয়ে গেছেন-তারও কোনো তুলনা নেই। এবং এই বিপ্লবীর বিপ্লব-আদর্শেই ভারত তার শৃঙ্খলভাঙার মন্ত্র পেয়েছিল এবং সে পথেই শৃঙ্খল ভেঙেছিল ভারতবর্ষ লাভ করেছিল বহু কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। যে স্বাধীনতা বাঘা যতীন ও নজরুলের চিরকাঙ্ক্ষিত ছিল। 

লেখক: কবি-কথাসাহিত্যিক-গবেষক। বিভাগীয় প্রধান, বাংলা বিভাগ, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ।


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি