ঢাকা, সোমবার   ১৩ মে ২০২৪

বিলুপ্তির পথে হাওরের দেশিয় প্রজাতির মাছ ও জলজ উদ্ভিদ

মৌলভীবাজার প্রতিনিধি 

প্রকাশিত : ১৫:৩৮, ১ সেপ্টেম্বর ২০২০

ক্রমশ সংকুচিত হয়ে পড়ছে মৌলভীবাজারের দেশিয় মাছের অভয়াশ্রম হাইল হাওরের বিলগুলো। ছোট বড় মিলিয়ে ১১৪টি বিলের মধ্যে এখন অর্ধেকও নেই। প্রতিনিয়ত বিলগুলো ঘিরে গড়ে উঠছে ফিসারী আর চিরদিনের জন্য বিলীন হয়ে যাচ্ছে একের পর এক বিল ও দেশিয় প্রজাতির মাছের বংশ। অন্যদিকে বেকার হচ্ছে মৎস্যজীবীরা। আর শহরের ময়লা আবর্জনায় দূষিত হচ্ছে পরিবেশ।  

হাওর পাড়ের বাসিন্দা পশ্চিম ভাড়াউড়া এলাকার রুকাম মিয়া, জুয়েল মিয়া, আকাশ মিয়াসহ বেশ কয়েকজন জেলে বলেন, ‘চইড়া বিল এখন আর নেই। সেখানে ফিসারী (হাইব্রীড মাছের খামার) হয়ে গেছে।’

পশ্চিম ভাড়াউড়া এলাকার বাসিন্দা ৩নং শ্রীমঙ্গল ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আনার মিয়া জানান, ‘লাভের আশায় সরকারকে রাজস্ব দিয়ে সমিতির নামে চইড়া বিল লিজ নিয়ে ছিলেন দুই বছর আগে। প্রথমদিকে বিলে আসতে পারেননি। চইড়া বিলের ৯০ ভাগ জমির উপর বিশাল ফিসারী। এটি করেছেন তার একই গ্রামের সফাত মিয়া। প্রতিবাদ করতে গেলে হুমকির শিকার হতে হয়।’

ফিসারীর এক পরিচালক সফাত মিয়ার চাচাতো ভাই পশ্চিম ভাড়াউড়া এলাকার দিলু মিয়া জানান, ‘তারা ভূমিহীনের জমি ক্রয় করে ফিসারী করেছেন। কিছু দিন পর আনার মিয়া এসে এটি চইড়া বিলের জায়গা জানালে তারা কাগজ দেখে জানাতে পারেন এটি লিজের জায়গা (চইড়া বিলের)। তখন তারা গ্রামের জনৈক মুকিত মিয়ার মারফত আনার মিয়াকে কিছু টাকা দেন।’

এ ব্যাপারে আনার মিয়া জানান, ‘তাকে কোন টাকা দেওয়া হয়নি। তারা মিথ্যা বিলাপ করছেনি। এ ব্যাপারে প্রশাসনের দারস্থ হবো।’

সরেজমিনে দেখা যায়, চইড়া বিলের উপর ফিসারীর পাড়ে বেশ বড় বড় বৃক্ষ চারা। বেশ কয়েকটি টংঘর। এসেছে বিদ্যুৎও। নিমিষেই পরিবর্তন হয়ে গেছে চইড়া বিলের দৃশ্যপট। অথচ দু’বছর আগেও বর্ষায় এই চইড়া বিলের ভাসান পানিতে মাছ মেরে জীবিকা নির্বাহন করতেন অসংখ্য জেলে। 

এ সময় পশ্চিম ভাড়াউড়া এলাকার সুন্নত মিয়া নামে অপর এক মৎস্যজীবী জানান, ‘এরা অন্যাায়ভাবে সরকারি জমির শ্রেণী পরিবর্তন করেছে। এদের  ফিসারী করার কারণে হাওর সংকুচিত হয়েছে। এর ফলে এই বিলে থাকা দেশিয় মাছের বংশতো শেষ হয়েছেই সাথে এই বিলে পাওয়া যেত বিভিন্ন প্রজাতীর জলজ উদ্ভিদ। যা এই এলাকার কৃষকরা গবাধি পশুর খাবার হিসেবে সংগ্রহ করতেন।’

তিনি জানান, ‘এই চিত্র শুধু চইড়া বিলে নয় হাওরের অধিকাংশ বিলই এখন ফিসারী। এই খাস জমির সরকার বেশ কিছু অংশ ভূমিহীনদের দিয়েছেন। কিন্তু ভূমিহীন সেখানে যেতে পারেনা। সুবিধাবাদীরা কাগজ সংগ্রহ করে তাদের সাথে দেখা করে কৌশলে তাদের কাছ থেকে জমিগুলো নিয়ে নেয়। পরে এর সাথে খাস জমিগুলো তাদের আয়ত্বে নিয়ে ফিসারী করে।’  একই কথা জানান, নৌকার মাঝি সুইলপুরের সুলেমান মিয়া, পশ্চিম ভাড়াউড়া মুমিন মিয়া’ 

শ্রীমঙ্গল উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ দপ্তর সম্পাদক মামুন আহমদ জানান, ‘এই হাওরের হাজার হাজার একর বিলের জমি দখল করে ফিসারী করেছেন রাগব বোয়ালেরা। এরা এখন সমাজের মাথা।’

এ ব্যাপারে কথা হয় শ্রীমঙ্গল উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সহিদুর রহমান সিদ্দিকির সাথে তিনি জানান, ‘হাইল হাওরের আয়তন ১৪ হাজার হেক্টর। এর মধ্যে শ্রীমঙ্গল উপজেলায় পড়েছে ১০ হাজার হেক্টর। এর ভিতরে বিল রয়েছে ৫৯টি যার মধ্যে ২০ একরে নিচে ৩৯টি এবং ২০টি ২০ একরের উপরে। যা থেকে উপজেলার মাছের চাহিদা পূরণ হয়ে থাকে।’

তিনি জানান, ‘এই বিলগুলো হাওরের চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। অনেকের ব্যক্তিগত জমির সাথে খাস ভূমিও পড়েছে। ভূমি দখলদারের গহব্বরে ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি বিল সম্পূর্ণ বিলীন হয়েছে। অনেকগুলো বিলের জমি অল্প অল্প দখল আছে। তিনি জানান, এই হাওরের বিলে প্রায় শত প্রজাতির দেশিয় মাছ পাওয়া যেত। বর্তমানে প্রায় ৩০ প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে।’

এই হওরে এসে মিসেছে অর্ধশত ছড়া যা গোফলা নদীতে পড়েছে। অনেকে সেই ছড়াগুলোও দখল করে নিচ্ছে। এতে পানি প্রবাহ পরিবর্তন হচ্ছে। ক্ষতির মুখে পড়ছেন হাওরের বোরো চাষীরাও।

এ ব্যাপারে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার মৎস্য কর্মকর্তা সুলতান মাহমুদ জানান, ‘হাইল হাওরের মৌলভীবাজার সদর উপজেলায় পড়েছে ৪ হাজার হেক্টর জলাভূমি। যার মধ্যে বিল রয়েছে ৫৫টি। এর মধ্যে ১০/১২টি নিঃশেষ হয়ে গেছে।’

এ ব্যাপারে পরিবেশ নিয়ে কাজ করা সংগঠন বালিশিরা পাহাড় রক্ষা সোসাইটির চেয়ারম্যান সালাউদ্দিন আহমদ জানান, ‘দেশিয় মাছ রক্ষা করি সমৃদ্ধ দেশ গড়ি’ প্রধানমন্ত্রীর এই স্লোগানকে বাস্তবায়ন করতে হলে আমাদের হাওর ও উন্মুক্ত জলাশয়কে রক্ষা করতে হবে। জলাভূমি তৈরি করে ফিসারী তৈরী করা রাঘব বোয়ালদের কঠোর হাতে দমন করতে হবে। একইসাথে হাইল হাওরে জমির শ্রেণী পরিবর্তন করা শতভাগ বন্ধ করতে হবে। তা না হলে সামনে বড় রকমের বিপর্যয় আসবে।’

প্রায় ১৪ হাজার হেক্টর এলাকাজুড়ে অবস্থিত হাইল হাওর। যার অধিকাংশ পড়েছে শ্রীমঙ্গল উপজেলায় এবং এর কিছু অংশ পড়েছে মৌলভীবাজার সদর উপজেলায়। এখানে রয়েছে মাছর অভয়াশ্রম বাইক্কা বিলসহ প্রায় ১১৪টির মতো বিল। কিন্তু আজ অধিকাংশ বিলের অস্তিত্ব নেই। এতে শঙ্কায় পরিবেশ প্রেমীরা। 

পরিবেশবিদ সিতেশ রঞ্জন দেব জানান,  ‘পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পেতে এখনই হাইল হাওরের বিলগুলো খনন করা প্রয়োজন। প্রত্যেকটি পাহাড়ি ছড়ার নিচের অংশ খনন করে গোফলা পর্যন্ত পানি চলাচলের পথ পরিস্কার করতে হবে।’
 
পরিবেশবাদী সংগঠন পাহার রক্ষা সোসাইটির সাথে সম্পৃক্ত সাংবাদিক মোনায়েম খান বলেন, ‘দখলদারদের উচ্ছেদ করে বিলকে বিলে রুপান্তরিত করতে হবে। এরা যতবড় ক্ষমতাধরই হোক না কেন জমির শ্রেণী পরিবর্তন করলে তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে।’

এ ব্যাপারে মৎস্যজীবী পশ্চিম ভাড়াউড়া এলাকার মুমিন মিয়া জানান, ‘হাইল হাওরের চার পাশে প্রায় ১০ হাজারেরও অধিক জেলে পরিবারের বসবাস। যেখানে জনসংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার। ইতিমধ্যে অর্ধেকের জীবিকা পরিবর্তন হয়েছে। আর পেশা ছাড়ার অপেক্ষায় আছেন বর্তমানে আরো কয়েক হাজার।’

এদিকে ফিসারীজের কারণে বন্ধ হচ্ছে বিভিন্ন ছড়ার পানি প্রবাহের পথ। পর্যটকরা বঞ্চিত হচ্ছেন উন্মুক্ত জলাশয়ে ঘুড়ে বেড়ানো থেকে। ফিসারীর কারণে হাওরের যে অল্প জায়গা ভাসান থাকে সেখানে শহরের ময়লা আবর্জনায় ভরপুর থাকে।

জানতে চাইলে হাইল হাওরে নিয়ে কাজ করা সিএনআর এস এর সাইট অফিসার মনিরুজ্জামান বলেন, ‘তাদের অনুসন্ধানে হাইল হাওরে ১৩১টি বিলের অস্তিত্ব খুঁজে পান তারা। এর মধ্যে ১০১টি বিল ইজারার রেকর্ড রয়েছে। ৩০টি বিলের কোন হদিস নেই। যেগুলো আছে সেগুলোরও অধিকাংশ দখলে।’

তিনি জানান, ‘দখল দৌড়াত্বে হাওরের এমন অবস্থা যে, এখন বিশাল হাওরে গরু চরানোর একটু খালী জমি নেই। নেই গরু রাখার ভাতান। সবই দখলে। এক সময় খাস জায়গায় কৃষকরা দলবদ্ধভাবে ধান মারাই করতেন এখন সে সুযোগটিও নেই।’

তবে শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম জানান, ‘দখলদারদের উচ্ছেদ করে তা আবার বিলে রুপান্তরিত করা হবে এবং যারা সরকারি জমি দখল করবেন তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এ ব্যাপারে মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান জানান, ‘হাইল হাওরের ভরাট হওয়া বিলগুলো খননের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট বিভাগের নজরে আনা হবে।’

আর হাইল হাওরের পুরোনো ঐতিহ্য ধরে রাখতে সরকারি জমি দখলমুক্ত ও  এর শ্রেণি পরিবর্তনকারীদের কঠোর আইনের আওতায় আনার দাবি প্রকৃতি প্রেমীদের।
এআই/এসএ/


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি