ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪

বিশ্ব দর্শন দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

প্রকাশিত : ১৩:০৩, ১৭ নভেম্বর ২০১৭ | আপডেট: ২২:৫১, ২০ নভেম্বর ২০১৭

বর্তমানে বিশ্বে বিভিন্ন দিবসের প্রচলন রয়েছে। তবে উচ্চতর পর্যায়ের পাঠ্য বিষয়ের নামে দিবসের প্রচলন করা বিষয়টা গভীর চিন্তার উদ্রেগ করে। কেন পাঠ্য বিষয়ের নামে দিবস ঘোষণা। শিক্ষা জগতের মধ্যে আমরা নানা বিষয়ের সন্ধান পেয়েছি এবং বর্তমানেও নিত্য নতুন বিষয় আমাদের সামনে আসছে যা আমাদের কারিকুলামে অন্তর্ভূক্ত হয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও জ্ঞানের জগতের পরিধি বৃদ্ধি করছে। তবে দর্শন বিষয়ের নামে কেন দিবস ঘোষণা এবং পালন করা হয়, তা নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে বলেই মনে হয়।

কেন এই বিশ্ব দর্শন? এর উত্তরে ইউনেস্কো বলেছে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নয়ন ও অভিযাত্রা বর্তমান বিশ্বে অস্থিতিশীলতা, অশান্তি, সন্ত্রাস, অন্যায়, সহিংসতা, অনৈতিকতা, নিরাপত্তাহীনতা মোটেই কমাতে পারেনি। তাই এসব বিষয় থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে পারে দর্শন বিষয়ের শিক্ষ ও অনুশীলন। কেননা দর্শনের জীবনবোধ নীতি নৈতিকতা, মানবিকতা, নান্দনিকতা, যুক্তিবোধ ও মননশীলতা বর্তমান বিশ্বের নানাবিধ সংকট ও সমস্যা থেকে মানবজাতিকে দিতে পারে কাক্ষিত লক্ষ্যের সন্ধান। আর এ লক্ষ্যেই জাতিসংঘের ইউনেস্কো ২০০২ সালের ২১ নভেম্বর প্রথমবার দর্শন দিবস ঘোষণা করে। ইউনেস্কোর তৎকালীন ডাইরেক্টর জেনারেল কইচিরো মাতুসুয়ারা বিশ্ববাসীর প্রতি এক বার্তা প্রেরণ করেন যাতে ফুটে উঠেছে দর্শন বিষয়ের গুরুত্ব ও তাৎপর্য।

তিনি মানবাধিকার, ন্যায়-নীতি,  গণতন্ত্রকে সমাজ ব্যবস্থার ভিত্তি হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, দারিদ্র্য, বিশ্বশান্তি, মানবাধিকার, সাংস্কৃতিক অধিকার, নারী অধিকার, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি সমকালীন বিভিন্ন বৈশ্বিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা এবং এসব সমস্যা সমাধানে বিশ্লেষণের গভীরে প্রবেশ করে দার্শনিক বিশ্লেষণ বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরাই ইউনেস্কোর কাজ। এই দর্শন দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য তরুণ সমাজ তথা বিশ্ববাসীর মাঝে যে প্রভাব ফেলে তা পর্যবেক্ষণ করে ২০০৫ সালের ইউনেস্কোর সাধারণ সম্মেলনে নভেম্বর মাসের তৃতীয় বৃহস্পতিবার বিশ্ব দর্শন দিবসে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এরপর থেকে ইউনেস্কোর আমন্ত্রণে যথাযোগ্য মর্যাদায় প্রতিবছর নভেম্বর মাসের তৃতীয় বৃহস্পতিবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব দর্শন দিবস। এবছর ১৭ নভেম্বর পালিত হয় দিবসটি।

শিক্ষার বিষয় হিসেবে দর্শন খুবই একটি প্রাচীন বিষয়। যে দেশ যত ধনী এবং যত শিক্ষিত সেই দেশে বর্তমানে দর্শন বিষয়ের কদর বেশি। দর্শনকে এসব দেশ সব শিক্ষার মাতৃরূপে গ্রহণ করেছে। তাই আমরা দেখি যেসব দেশের দর্শন চর্চা যত বেশি সেসব দেশের সভ্যতা, সংস্কৃতি ও মানবিকতা তত বেশি উন্নত।

দার্শনিক কোঁতে ও পলসনের মন্তব্য এখানে উল্লেখ করা যায়, ‘দর্শন হলো সব বিজ্ঞানের বিজ্ঞান। ‘দর্শন হলো সমস্ত বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সমষ্টি’।

(Philosophy is the science of all sciences. Philosophy is the sumtotal of all Scientitic Knowledge.)

আর বর্তমান পৃথিবীতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যে বিষ্ময়কর উত্থান ও প্রসার এর যাত্রা শুরু হয়েছিল দার্শনিক ফ্রান্সিস বেকন ও রেঁনে দেকার্তের হাত ধরে।

বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কার আমাদের জীবনযাত্রা আমূল পাল্টে দিলেও সঠিকভাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে যদি আমরা কাজে না লাগাই, তাহলে তা মানব সভ্যতার জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিবে। বিশ্বে সাধিত হবে বিশ্ব ধ্বংসলীলা। এক্ষেত্রে দর্শনের হাতে নিয়ন্ত্রণ তুলে দিলে মানবজাতি রক্ষা পাবে বর্তমানের দ্বন্দ্ব-সংঘাত, অনিশ্চয়তা, আশান্তিময় পরিস্থিতি থেকে।

দর্শন দিবস ঘোষণার কারণে দর্শনের প্রচার-প্রসার হচ্ছে বা হবে তা নয়। বিশ্ববাসী বর্তমান বিশৃঙ্খলাপূর্ণ ও অস্থির বিশ্ব থেকে মুক্তি পেতে দর্শনের কাছে সাহায্যে প্রর্থনা করছে। দর্শনের কাছে চাচ্ছে সঠিক পথে অগ্রসর হওয়ার দিকনির্দেশনা। কেননা পৃথিবীতে দর্শন এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক বিষয়, যেখানে নীতি নৈতিকতা, যুক্তি, নান্দনিকতা, মানবতা, চিন্তা-চেতনা তথা জ্ঞান নিয়ে আলোচনা করা হয়। দর্শন মানুষের আত্মসত্তাকে জাগিয়ে তোলে, প্রশ্ন করতে শেখায় কে তুমি? পৃথিবীতে কি তোমার দায়িত্ব ও কর্তব্য?

বিশ্ববরেন্য দার্শনিক সক্রেটিসের মনে করেন-

বিষ্ময়, কৌতুহল, সংশয়, জিজ্ঞাসা, প্রয়োজনবোধ এবং জ্ঞানপ্রীতি থেকে দর্শন চিন্তার উৎপত্তি। দর্শন চিন্তার মূলে কাজ করেছে মানুষের মহান মানবিক মূল্যবোধ। এই মানবিকতা মূল্যেবোধের মধ্য দিয়ে মানুষ পৃথিবীতে তার শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করে আসছে যুগ যুগ ধরে। আর দর্শনের তিনটি কাজ- অনুধ্যানমূলক, সমালোচনামূলক ও গঠনমূলক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মানুষ তার শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখতে সচেষ্ট।

দর্শন বিষয় সম্পর্কে সঠিক ধারনার অভাবে বিষয়টির অবমূল্যায়ন এবং অপপ্রচারও হয়ে থাকে। বিশ্বদর্শন দিবসের প্রেক্ষাপট, গুরুত্ব ও তাৎপর্য সাধারন ও শিক্ষিত মানুষের মধ্যে জীবনের সর্বস্তরে নৈতিকতা প্রয়োগ ও পরিব্যাপ্তির ধারনাকে প্রসার ঘটাবে বলে আমরা আশা রাখি। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় মানবজাতির বিকাশের ধারায় যত সভ্যতার সংকট সামনে এসেছে তার মূলে রয়েছে মূলত নীতি নৈতিকতার সংকট। মানব জীবনে সব  ধরনের দুঃখ দুর্দশার মূলেও রয়েছে নৈতিক সংকট। সভ্যতার সঙ্কট, মানব সঙ্কট থেকে উত্তরনের পথ বিজ্ঞান প্রযুক্তি, পারমানবিক অস্ত্র, ইন্টারনেট, কম্পিউটার কিংবা অফুরন্ত সম্পদ দিতে পারবে না।

এই সঙ্কট থেকে উত্তরনের একমাত্র পথ নৈতিক শিক্ষা। নৈতিক শিক্ষা ব্যতীত একদিকে যেমন বিজ্ঞান প্রযুক্তির উৎকর্ষতা ও সাফল্য কোন ভাল ফল বয়ে আনবে না, অন্যদিকে তেমনি পৃথিবীর অফুরন্ত সম্পদ মানুষের কোন কাজে আসবে না। তাই পৃথিবীর সর্বস্তরে সুখ, শান্তি ও কল্যানের জন্য মানবজাতিকে নৈতিক শিক্ষার মাতৃভূমি দর্শনের কাছে আসতে হবে। প্রসঙ্গক্রমে এখানে পাশ্চাত্যের  প্রভাবশালী দার্শনিক এফ এইচ ব্রাডালির বক্তব্য উল্লেখ করা যায়।

তিনি  বলেছেন, মানুষ যেদিন তার শ্রেষ্ঠত্ব, বিবেক, মর্যাদা, স্বতন্ত্রতা হারিয়ে অমানবিক ও পশুর পর্যায়ে নিঃপতিত হবে সেদিনই সে কেবল দার্শনিক জ্ঞান ও সত্য অনুসন্ধানের মহৎ পথ থেকে নিজেদের পরিহার করতে পারবে। ব্রাডলির এই বক্তব্য মানব জাতির জন্য একটা বড় ম্যাসেজ। কেননা জ্ঞান ও সত্যের অন্বেষণ ছাড়া পৃথিবীর বুকে মানবজাতির টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। তাই একথা নিশ্চিত করে বলা যায় উন্নত মানবিক জীবনের যৌক্তিক, নৈতিক ও নান্দনিক দিকের অনুসন্ধানের জন্য দর্শন শিক্ষা অপরিহার্য।

আমাদের সমাজ ব্যবস্থা থেকে প্রায় দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের বিবেকবোধ, স্মৃতি, দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ। সর্বত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে বিচারহীনতার সংস্কৃতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবক্ষয়। সমাজ ব্যবস্থা যেন অসচেতন ও অসংবেদনশীল হয়ে পড়ছে, হারিয়ে ফেলছে তার মূল্যবোধ ও নৈতিকতা। ব্যক্তি মানুষ দিন দিন দয়া, মায়া, মমতা, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, বন্ধন, সহমর্মিতা, সহযোগিতা, মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলছে।

সঠিক শিক্ষা তথা নৈতিকতা সম্পৃক্ত মানবিক আদর্শিক শিক্ষার অভাবে এমনটি হচ্ছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। এরূপ বাস্তবতা থেকে উত্তরনের পথ হবে দর্শনের শিক্ষাগ্রহণ অনুশীলন ও তার প্রয়োগ। দর্শনবিমুখ শিক্ষাব্যবস্থায় অর্থনৈতিক দিক থেকে খাদ্য, শিল্প, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ব্যবসায়, প্রযুক্তিক দিক থেকে প্রাচুর্য আসবে কিন্তু কখনো সুখ বা শান্তি আসবে না। তাই একটি দেশ বা সমাজের শিক্ষা ব্যবস্থার মৌলিক বিষয় দর্শনের বিষয়ের অন্তর্ভূক্তি, অনুশীল ও প্রয়োগ আজ সময়ের দাবী।

পরিশেষে বলা যায় দর্শনের বিষয়বস্তু ও নির্দেশের প্রতি মানুষের মনোযোগ ও দৃষ্টি আকর্ষণই এই দিবসের মূল লক্ষ্য। ইউনেস্কো বুঝতে পেরেছে যে দর্শনের বিষয়বস্তুর চর্চা ও প্রসারের মাধ্যমে আসবে মানব জাতির প্রকৃত মুক্তি। সে লক্ষ্যেই ইউনেস্কো বলছে সব দেশের সব মানুষের জন্য বিশ্ব দর্শন দিবস। তাই আজ সময় এসেছে দর্শনের মর্মবানী উপলব্ধি করে বিশ্ব বিবেককে জাগ্রত করে মানব কল্যাণের মহান পথে অগ্রসর হওয়া।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

 

এসএইচ/


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


টেলিফোন: +৮৮ ০২ ৫৫০১৪৩১৬-২৫

ফ্যক্স :

ইমেল: etvonline@ekushey-tv.com

Webmail

জাহাঙ্গীর টাওয়ার, (৭ম তলা), ১০, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

এস. আলম গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান

© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি