ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪

বুক রিভিউ : এক ঝাঁক জীবন রঙের যাপন

প্রকাশিত : ১৩:০০, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ | আপডেট: ১৩:১১, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

প্রতিটি মানুষের বেঁচে থাকার আলাদা সংগ্রাম, আলাদা আলো ও অন্ধকার কিন্তু সেই বেঁচে থাকার একটাই নাম গল্প। গল্প হয়ে তা-ই থাকে যা কেবল সুখের বলে নয়, দুঃখ ফুরায়নি যে যাপনের গল্প হয়ে যায় তাও।

কিছুক্ষণ আগেই খুব বৃষ্টি হয়েছে। আকাশে এখনো পায়রা রঙের মেঘের ওড়াউড়ি। বারান্দায় বসে আছি। হাতে স্মৃতি ভদ্র-র নতুন গল্পের বই ‘অন্তর্গত নিষাদ ও পায়রা রঙের মেঘ’। গল্পকারের লেখার সাথে বেশ কয়েক বছর ধরে পরিচিত হলেও এক মলাটে দশটি গল্প এই প্রথম। যার গোটা বই জুড়ে সম্পর্কের এক বিভোর যাত্রা। মধ্যবিত্ত পরিবার ও তার টানাপোড়েনের গল্প। যাপনের মোড়ে একটি ছায়ার ভেতর কত জীবন বেঁচে থাকে। কখনো অনতিশরতের উজ্জ্বল কমলা রঙের বিকাল, আবার কখনো হেঁয়ালী ধুসরের বাড়ন্ত সকাল।

জীবনের প্রতিটি আনন্দে খুব নির্জনে জেগে থাকে  বেদনার সুর। নৈঃশব্দ্যের নিনাদ। সুষমামন্ডিত সেই নৈঃশব্দ্য সবসময় প্রতিধ্বনিময়, অনুভবে গতিময়, শাব্দিক আলোড়নে তোলপাড়। সেখানে একটি ছায়াও অনেক যাপনকে নীরবে লালন করে কিংবা সদ্য ষাটে পা দেওয়া সুনয়নার মায়াকে ধরে রেখেছে । সে শৈশবে ছেড়েছে প্রিয় গোলাপি ফ্রক ছোট বোনের জন্য। এরপর সেই ছোট বোনসহ বাবা-মাকে ছেড়ে এসেছে নিখিলকে ভালোবেসে। কোনো এক শ্রাবণের রাতে ঘুমন্ত সুনয়নাকে চিরতরে ছাড়তে হয়েছে নিখিলকে। কিন্তু আজ পেয়ারাগাছের ছায়াটুকু ছাড়তে কষ্ট হচ্ছে সুনয়নার, কিংবা এই ছায়া ঘিরে থাকা অজস্র স্মৃতিই আসলে গোটা জীবন। স্মৃতি আবার ভুলে যাবার ব্যবস্থাপনাও। কিছু মুছে গিয়ে যা বাকি থাকে, তাকেই আমরা স্মৃতি বলি। যা ভুলে গেলাম, তা তো বিস্মৃতি। গল্পকার স্মৃতি ভদ্রের গল্প তার প্রেক্ষাপট বড় চেনা আমাদের অন্তঃপুরের গল্প, ত্রিমাত্রিক জগতের গল্প। নির্জন দুপুর বা প্রায়ান্ধকার সন্ধ্যায় সে সব গল্প আয়েশি আসর জমায়। শোনায় মানবজীবনের অস্তিত্ব, জানায় মানব-অস্তিত্বের সৌন্দর্য। এর সঙ্গে সঙ্গে মানব-অস্তিত্বের অন্ধকারময়তার সাথেও পরিচয় করিয়ে দেয় সযতনে।

গুনগুন করে গাইতে গাইতে যখন রাধা বাবার পিছে পিছে বাড়ি যায় তখন পুর্ণিমার মতো আলো ছড়ায় রাধা। সে আলোয় অনেকেই অবগাহন করতে চায়। কত কত শুঁয়োপোকা সেই আলোতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এরপর পাখাবিহীন সেই পোকাগুলো রাঁধার আলোর তেজে পুড়তে থাকে। দূর থেকে সেই শুঁয়োপোকাদের পুড়তে দেখে একটি দু’টি ছায়া গাছের সাথে লেপ্টে যায়। শিবু রোহিদাস একটু পর পর মেয়েকে তাড়া দেয়,’পা চালাতি হবি মা।’ রাধা তাড়াতাড়ি হাঁটতে গিয়ে স্যান্ডেলের ফিতা ছিঁড়ে ফেলে। আর ঠিক তখনি ওর মনে পড়ে সেই সোনারঙের জুতার কথা। শব্দগুলো ইঙ্গিতে ইশারায় গল্প বলে মানবজীবনের।

অন্ধকারের সঙ্গে যুঝেই প্রতিটি যাপনে মানব সন্ধান পায় এক আলোকিত আকাশের। তখন অতশী,কবির দীর্ঘ সংসার যাপনের দূরত্ব পেরিয়ে রোদে গিয়ে মুখোমুখি বসে তাদের মনে হয় রঙধনু আর তখনই অরণী হয়ে ওঠে আয়নামহল এবং খালেক সাহেব নিজেকে খুঁজে পান মুখোশহীন অবয়বে নতুন করে। চতুষ্কোণ গল্পটি মানবিক সম্পর্কের জটিলতা নিয়ে লেখা। এমন জটিলতা অহরহ চোখে পড়ে কিংবা জটিলতার সুতো মুড়েই থাকে, আমরা বুঝে উঠতেই পারিনা কি হচ্ছে কেন হচ্ছে এমন।

গল্পের নারীদের গল্পকার খুব যত্ন দিয়ে তৈরি করেছেন। তার নারীদের অহংকার নেই জাদুকরী প্রবল ব্যক্তিত্ব আছে। “খাঁচা”গল্পে পড়া মিসেস সালামদের তো রোজ দেখা পাই সমাজে,নিজের স্বকীয়তা হারানো ওইসব নারীরাও মনের অন্তরালে কখনো কখনো মনের পোষা পাখি উড়িয়ে দিয়ে নিজের মুক্তি খোঁজে। বোধ করি সংসার স্বামী সন্তানের ভিড়ে তারাও আনমনে গায় ‘আমার মালতীলতা, ওগো কী আবেশে দোলে ...’

সময়ের শরীর হয়ে ওঠার পর সেই শরীরের ইন্দ্রিয় সংবেদন। আনন্দ-বেদনা তখন সময় আস্বাদনের অনুভূতি হয়ে ওঠে।

স্মৃতি ভদ্রকে তার প্রথম গল্পের বই “অলোকপুরীর ডাক” -এর পরে এই দ্বিতীয় বই পাঠ করতে গিয়ে মনে হয় তার রেজিম অফ আর্ট তথা শিল্পনানুশাসনের অন্যতম প্রধান আরক হলো তার সময় জ্ঞান।

‘বৃত্তের বাইরে’ গল্পটি পড়তে গিয়ে মনে হয়, আশাবরি ইসলামের প্রতীক্ষা চিরন্তন এক নারীর, মগ্ন সময়ের বৃত্ত ভেঙে দেয় যে ঋভু সে আরেক সময়ের নারী প্রতিনিধি। আবার ‘কাচের দেয়াল’ গল্পে সম্পর্কের জটিল সমীকরণ ঝুলে থাকে ঝুলন, রাতুল আর বৃতির সম্পর্কে সেখানে কেভিন এক আলোর নাম। বন্ধুতা প্রেম ও সংসারের রসায়নের ফাঁকে জেগে থাকে ‘কালপুরুষ’ গল্প। রিমঝিমের সাথে কবিরের কাটানো সময়, রিমঝিমের হাসির সাথে নিজের হাসির মিল যেন কবিরের দূর্লভ পাওয়া। বকুল চয়নকে নতুন করে আবিষ্কার করে। যেন অহরহ চেনাজানা সম্পর্কগুলোর পাশে লালন বসে গান ধরেছে। ‘বাড়ির কাছে আরশি নগর, সেখানে এক পড়শী বসত করে।আমি একদিনও না দেখিলাম তারে”...

সেই অন্ধকারময়তা অন্তর্নিহিত নিষাদ, অন্তর্গত নিষাদ আলোয় পরিশুদ্ধ হয়। চোখের সামনে তখন স্পষ্ট হয় একজন সৎ পিতার আনস্মার্ট যাপন, রাধার সোনারঙের জুতার কথা। গল্পকারের জীবনে স্থিরতার আকুলতা খুব প্রবল তাই হয়ত, প্রায় সব গল্পেই বাড়ি একটি চরিত্র হয়ে উঠেছে। মনে হয়, পরিপাটি ও সরলতা গল্পকারের বিশেষ মানবিক গুণ তা তার প্রতিটি লেখাতেও ছায়া ফেলেছে।

স্মৃতি ভদ্রের গল্পে সুপারঅ্যাড্রেসি, বিশ্বজনীন পাঠক, পরাশ্রোতা কে? কোন পরম সহৃয়ের কানে তিনি তার সকল ধ্বনি তুলে দিতে চান স্বীকৃতির আশায়? কেউ নেই কিছু নেই আশা নেই এমন কোনো নেতির দরবারে নিজেকে সমর্পণ করে উদ্দেশ ও উদ্দেশ্য ছাড়াই তিনি কথা বলে চলেছেন কেবলই নিজের সঙ্গে কিংবা বাড়িগুলোই তার পাঠক। সেই প্রতিধ্বনিত অন্তর্গত নিষাদ পায়রা রঙের মেঘ হয়ে ডানা মেলে আকাশে।

অন্তর্গত নিষাদ ও পায়রা রঙের মেঘ

স্মৃতি ভদ্র

প্রথম প্রকাশ: ২০১৯

প্রকাশক: পেন্সিল পাবলিকেশনস

স্বত্ব: লেখক

প্রচ্ছদ: নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

মূল্য: ১৭০/=

 

 

 


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি