ঢাকা, রবিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

বোনাস লভ্যাংশ এবং আয়ের ওপর করারোপ বাতিল হোক

প্রকাশিত : ২২:৫৪, ২৬ জুন ২০১৯

Ekushey Television Ltd.

পুঁজিবাজারে প্রণোদনার নামে তালিকাভুক্ত কোম্পানির বোনাস লভ্যাংশের ওপর ১৫% এবং কোম্পানিগুলোর পুঁঞ্জিভুত আয়ের (পরিশোধিত মূলধনের ৫০ শতাংশের বেশির) ওপর ১৫% হারে করারোপের জন্য ২০১৯-২০ অর্থ বছরের ঘোষিত বাজেটে প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে। এ ধরনের আইন বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। এ আইন বাস্তবায়ন হলে বাজারে ভয়ানক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, বিনিয়োগকারীরা হবে ব্যাপক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।

ঘোষিত বাজেটে এ ধরনের বিভ্রান্তিকর প্রণোদনার প্রস্তাব করার পর থেকেই ক্ষুদ্র পুঁজির বিনিয়োগকারীরা চিন্তিত এবং শঙ্কিত। বাজারেও পড়েছে এর নেতিবাচক প্রভাব। অথচ- প্রস্তাবিত এই ক্ষতিকর আইনের বিরুদ্ধে উচ্চ মহলের কেউ মুখ খুলছেন না।

দুঃখজনক হলেও সত্য যে, খোদ ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষ এই ক্ষতিকর প্রস্তাবনা সম্বলিত ঘোষিত বাজেটকে সাধুবাদ জানিয়েছে। একমাত্র লিস্টেড কোম্পানি ছাড়া দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠন এফবিসিসিআই, ডিসিসিআই ব্যবসায়ী নেতাদের কাউকে এর বিরুদ্ধে কথা বলতে শোনা যায়নি। তারা এই আইনের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জানেন না, তা বলা হয়তো ভুল হবে। আসলে তারা কেউ অর্থমন্ত্রী বা সরকারের সমালোচনা করে বিরাগভাজন হতে চান না। নিজেদের পদ-পদবি রক্ষা করতেই তারা সদা ব্যস্ত।

ভালো মৌলের কোম্পানির পুঁঞ্জিভুত আয় বা সঞ্চিতি তার প্রবৃদ্ধি অর্জনে অত্যন্ত সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তা বোঝার জন্য অর্থমন্ত্রীর মতো মহাজ্ঞাণী পন্ডিত বা বিশেষ পদবি প্রাপ্ত এফসিএ হওয়ার প্রয়োজন নেই- লেখাপড়া জানা সাধারণ বিনিয়োগকারীরাও তা ভালো জানেন।

উচ্চ প্রবৃদ্ধি সম্পন্ন কোম্পানিগুলোকে ভবিষ্যত প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে নগদ লভ্যাংশের পাশাপাশি স্টক বা বোনাস শেয়ার প্রদান করতে হয়। স্টক ডিভিডেন্ডের ওপর প্রস্তাবিত ১৫% করারোপের ফলে ভালো মৌলের কোম্পানির প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হবে, আয় ও লভ্যাংশের হার কমবে। এতে শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক ভাবে কমে যাবে, বিনিয়োগকারীরা হবে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, বাজারে পড়বে দীর্ঘস্থায়ী নেতিবাচক প্রভাব। তাই কোনো কোম্পানির ডিভিডেন্ড পলিসি বা লভ্যাংশ নীতি স্বস্ব কোম্পানির একান্ত নিজস্ব ব্যাপার হওয়া প্রয়োজন। এখানে আরোপিত করহার লাভের পরিবর্তে ক্ষতি ডেকে আনবে। বড়জোর তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো আয়-প্রবৃদ্ধির সক্ষমতা অনুসারে লভ্যাংশ নীতিমালা প্রণয়নের বিধান জারি করা যেতে পারতো।

বাজেট ঘোষণায় অর্থমন্ত্রী বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে তালিকাভুক্ত সব কোম্পানির ক্ষেত্রে নগদ লভ্যাংশ প্রদানে যে যুক্তি তুলে ধরেছেন তা সঠিক নয়, বরং সরকারের বিদ্যমান নীতির সাথে সাংঘর্ষিক। কেননা অনেক ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তি দূর্বল হওয়ায় অন্যতম নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক গত কয়েক বছর যাবৎ বেশ কয়েকটি ব্যাংককে নগদ লভ্যাংশ প্রদানে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এসব কোম্পানিগুলো শুধু স্টক ডিভিডেন্ড প্রদান করতে পারছে। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে- বাংলাদেশ ব্যাংককে উপেক্ষা করে বাজেটে স্টক ডিভিডেন্ডের ওপর প্রস্তাবিত ১৫% করারোপের বিধান জারি করেছেন মহা ক্ষমতাধর অর্থমন্ত্রী। তারপর পুঞ্জিভুত আয়ের ওপর ১৫% হারে করারোপের ফলে দূর্বল ভিত্তির ব্যাংকগুলোর অবস্থা অদূর ভবিষ্যতে কেমন হবে তা আল্লাহই ভালো জানেন।

অপরদিকে নতুন আইন কার্যকর হলে বহুজাতিক কোম্পানির সিংহভাগ বিনিয়োগকারকে তাদের সঞ্চিত অর্থ বৈদেশিক মুদ্রায় প্রদান করলে শুধু কোম্পানিগুলোর নয়, দেশের অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এসবের দায় সরকারকেই বহন করতে হবে।

কোম্পানির আর্থিক বিবরণী প্রনয়ণ এবং নিরীক্ষণের ক্ষেত্রে বিশেষায়িত জ্ঞানের অধিকারী এবং অত্যন্ত অভিজ্ঞতা সম্পন্ন অর্থমন্ত্রী দায়িত্ব গ্রহণের পর পুঁজিবাজার সম্পর্কে অনেকটা অসংলগ্ন এবং অসঙ্গতিপূর্ণ কথা বলে যাচ্ছেন। বিএসইসি আয়োজিত বিনিয়োগকরীদের এক অনুষ্ঠানে দম্ভোক্তির সাথে বলেছিলেন- ‘বাজারের সূচক কোথায় গিয়ে নামতে পারে তা দেখতে চাই।’ তার এ বক্তব্যের পর দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ডিএসই ৪০০ পয়েন্ট সূচক হারায়। তাছাড়া শবে বরাতের বন্ধের দিন বিএসইসি‘র কার্যালয়ে গিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘পুঁজিবাজারের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ নাই। বাজার চলে পত্রিকার খবরে, এখানে ভালো কোম্পানি নাই, ভালো কেউ আসলে তারাও খারাপ হয়ে যাবে।’ দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে দায়িত্ব প্রাপ্ত একজন মন্ত্রীর এভাবে প্রকাশ্যে ঢালাও নেতিবাচক মন্তব্য পুঁজিবাজারের প্রতি চরম উদাসীনতার বর্হিপ্রকাশ।

তারপরও বিনিয়োগকরীরা আশায় বুকবেধেঁ ছিলেন-আসন্ন বাজেটে সরকার পুঁজিবাজারের জন্য বিনিয়োগ সহায়ক ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। বিনিয়োগকরীদের সে আশায় ভর করে পুঁজিবাজারের সূচক পতন থেকে খানিকটা উত্থানের ধারায় এগোতে থাকে। প্রস্তাবিত বাজেটে বেশ কিছু প্রণোদনা দেয়া হয়েছে তা নিঃসন্দেহে বিনিয়োগ সহায়ক এবং ইতিবাচক। কিন্তু এসব ভালো প্রণোদনার সাথে বোনাস লভ্যাংশের এবং কোম্পানিগুলোর পুঞ্জিভুত আয়ের ওপর করারোপের বিধানটি বিনিয়োগকারীদের বাড়া ভাতে শুধু ছাঁই নয়, অনেকটা বিষ ঢেলে দেয়ার মতো অবস্থা হয়েছে।

আসলেই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে আমরা সাধারণ বিনিয়োগকরীরা যেন ভয়ানক অপরাধ করে ফেলছি। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়ে স্বচ্ছতার সাথে ব্যবসা করে নিয়মিত কর পরিশোধের পর ভবিষ্যত বিনিয়োগের জন্য সঞ্চিতি জমা রেখে বড় অপরাধ করেছেন সৎ এবং দক্ষ শিল্পোদ্যোক্তারা। যার কারণে এদেরকে দ্বৈত করারোপের মাধ্যমে প্রণোদনার নামে শাস্তি দিতে চাচ্ছেন পুঁজিবাজারে প্রবল প্রতাপশালী দন্ডমুন্ডেরকর্তা অর্থমন্ত্রী।
আসলে দেশের পুঁজিবাজারের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকরীরা সত্যিকার ভাবেই অভিভাবক শূণ্য হয়ে পড়েছে। তাদের পক্ষে সত্য কথা বলার মতো কেউ নেই। জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে এই ভয়ানক ক্ষতিকর আইনের বিরুদ্ধে কাউকে একটি কথা বলতেও শোনা যায়নি। অথচ জনস্বার্থের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়-এমন অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনায় দীর্ঘ সময় সরব থাকে জাতীয় সংসদ।

আমার জানা মতে, পুঁজিবাজারের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত ক্ষমতাসীন দলের দুইজন এবং জাতীয় পার্টির একজন সন্মানিত সংসদ জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছেন। তাদের জ্ঞান, প্রজ্ঞা এবং প্রতিভার প্রতি যথাযথ সম্মান রেখেই বলতে হচ্ছে- বিভ্রান্তিকর প্রণোদনার বিরেুদ্ধে বাজেট অধিবেশনে জাতীয় সংসদে তারা একটি কথাও বলেননি। কিসের ভয়ে অর্থমন্ত্রী বাহদুরের বিরাগভাজন হতে চাননি তারা? নাকি এই প্রণোদনার পক্ষে তাদেরও মৌন সমর্থন রয়েছে?

মাননীয় অর্থমন্ত্রী অবশ্য বলেছেন- অভিজ্ঞ বিনিয়োগকারীদের সাথে আলোচনা করেই তাদের স্বার্থ রক্ষায় নগদ লভ্যাংশ প্রদানে উৎসাহিত করার জন্যই এই বিধান জারি করা হয়েছে। আসলে যারা এই পরামর্শ দিয়েছেন- তারা বাজার স্থিতিশীলতা রক্ষা এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য নয়, বরং বাজার ব্যাপক ভাবে অস্থিতিশীল করতে বা কোটারি স্বার্থ রক্ষার জন্য এই ধরনের ক্ষতিকর পরামর্শ দিতে পারেন। প্রবাদ আছে- উলট-পালট করে দে মা লুটেপুটে খাই।

সুতরাং সরকারকে বুঝতে হবে- দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি পুঁজিবাজার বিপর্যয়ের শিকার হলে তার দায় সুবিধাভোগী দুধের মাছিরা নেবে না। তাদের স্বার্থ উদ্ধার হলে তারা আস্তে সটকে পড়বে। আর সমস্ত দায় পড়বে সরকারের কাধেঁ। জাতীয় বাজেটে ক্ষতিকর বিধান জারি রেখে অসংখ্য সাধারণ বিনিয়োগকরারীর স্বার্থে আঘাত করে, পুঁজিবাজারকে আরো বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়ে অর্থনীতিকে নাজুক করার দায় সরকার বহন করবে কেনো? সাধারণ বিনিয়োগকরীদের আশা সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হবে। বাতিল করা হবে বাজেটে জারি করা ক্ষতিকর বিধান।

আরকে/


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি