ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪

মানবতা বোধের আলো দেখিয়েছিলেন শ্রী চৈতন্য

ডা. উজ্জ্বল কুমার রায়

প্রকাশিত : ২০:১৩, ২৯ মার্চ ২০২০ | আপডেট: ২১:৩৭, ২৯ মার্চ ২০২০

শ্রী চৈতন্য

শ্রী চৈতন্য

১৪৮৬ সালে অশিক্ষা, কুশিক্ষা, কুসংস্কার, দারিদ্র ও জাতিভেদের সংকীর্ণতায় ধর্মের প্রাণকেন্দ্র জাতি যখন পথ হারিয়ে ফেলেছে, সেই যুগসন্ধিক্ষণে ভবিষ্যৎ মানবের অভ্রান্ত পথনির্দেশকরূপে শ্রীচৈতন্য আবির্ভূত হয়েছিলেন। পাশ্চাত্য শিক্ষার আলোকে ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলায় নবজাগরণ ঘটেছে। আর জ্যোতির্ময় পুরুষ শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাবে পঞ্চদশ শতকের শেষভাগ থেকে বাংলায় নবজগরণ ঘটেছে। সেই আলোকছটা সারা ভারতবর্ষকে জাগ্রত করেছে। 

ঊনবিংশ শতকের জাগরণ মুষ্টিমেয় শিক্ষিত সমাজের মধ্যেই সীমাবন্ধ ছিল। তাকে যথার্থ জনজাগরণ বলা যায় কি না, তা নিয়ে আলোচনার অবকাশ আছে। কিন্তু চৈতন্যের আবির্ভাবে ধনী-দরিদ্র-জাতি-বর্ন-ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষ তাঁদের দুর্বলতা, অদৃষ্ট নির্ভরতা, ভেদ-ব্যাধি ত্যাগ করে দ্রুত এক যুক্তিনির্ভর সুমহান আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে যথার্থ কল্যাণের পথে অগ্রসর হয়েছেন। 

শ্রী চৈতন্য যে মনুষ্যত্বের উদ্বোধন ঘটিয়েছিলেন তার প্রভাব শুধু হিন্দু সমাজেই সীমাবদ্ধ ছিল না, এদেশের মুসলমান সমাজেও তিনি শ্রদ্ধার পাত্র হয়েছিলেন। শ্রীচৈতন্যের প্রভাবে শুধু ধর্মীয় জীবনই নয়, সাহিত্র, শিল্প, স্থাপত্য, চিত্রকলা ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রই বিকশিত হয়েছে। শ্রীচৈতন্যের প্রভাবে বাংলা সাহিত্যে সুবর্ণযুগ প্রবেশ করেছে। ভক্ত কবিগণ মহাপ্রভুর দিব্যকান্তি ও অলৌকিক জীবনকাহিনি বর্ণনার জন্য অতি নিষ্ঠার সঙ্গে বাংলাভাষাকে উচ্চভাব প্রকাশে সক্ষ করে তুলেছেন। কবি-পদকর্তারা শ্রীচৈতন্যের মধ্যে রাখার ভাব ব্যাকুলতাকে প্রত্যক্ষ করে অসংখ্য রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক পদাবলি রচনা করেছেন। প্রায় চারশোরও বেশি বছর ধরে রচিত এই পদাবলি সাহিত্য শুধু বাংলা ভাষারই নয়, বিশ্ব সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। তাকে কেন্দ্র করেই বাংলা সাহিত্যে প্রথম জীবনীকাব্য রচিত হল। এগুলো একাধারে কাব্য, জীবনী, ইতিহাস ও দর্শন। গৌরচন্দ্রিকা পদগুলোও অপূর্ব কাব্য সুষমামন্ডিত। 

এছাড়া মহাপ্রভুর প্রভাবে বাংলার নাটক, লোকসাহিত্য, মঙ্গলকাব্য সমূহ সুসমৃদ্ধ হয়েছে। সমৃদ্ধ হয়েছে সংগীতের অন্যতম ধারা সংকীর্তন। চৈতন্য রেনেসাঁসের ব্যাপ্তি তাই আপামর জনসাধারণকে যে স্পর্শ করেছিল, এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। 

শ্রী চৈতন্যের ধর্মের নাম প্রেমধর্ম। মানুষকে ভালোবাসার চেয়ে বড় ধর্ম হতে পারে না। জন্মগতভাবে সব মানুষই সমান। কিন্তু এই মানুষ নিজেই নানা স্বার্থবুদ্ধি, বৈষম্য ও ঘৃণার সৃষ্টি করেছে, বিভেদ সৃষ্টি করেছে। জাতিভেদ প্রথা স্বার্থপর মানুষের সৃষ্টি। শ্রীচৈতন্য পর্বতপ্রমাণ ভেদবুদ্ধির এই অচলায়তনকে সবলে অস্বীকার করেছেন। মানুষের দুর্গতিতে কাতর শ্রীচৈতন্য মানুষকে সব ভেদাভেদ ভুলে যেতে অনুরোধ করেছেন। বলেছেন, মানুষে মানুষে, বর্ণে বর্ণে, জাতিতে জাতিতে কোনও পার্থক্য নেই। মানুষকে ভালোবাসো, ভগবানকে ভালোবাসো। উচ্চারণ করলেন সেই অমোঘ বাণী ‘চন্ডালোহপি দ্বিজশ্রেষ্ঠ হরিভক্তিপরাষণ।’ চন্ডালও দ্বিজোত্তম হতে পারে যদি হরিভক্তিপরাষণ হতে পারে। এইভাবেই সমাজিক বৈষমের মূলে আঘাত হানলেন চৈতন্য। একথা শুনে সবচেয়ে অভিভূত হল সমাজরে দীর্ঘদিনের অবহেলিত নির্যাতিত নিরীহ মানুষ। এ এক যুগান্তীকারী সামাজিক শুভ পরিবর্তন। 

শ্রীকৃষ্ণকে পাওয়ার ব্যাকুলতায় শ্রীচৈতন্য সন্ন্যাস গ্রহণ করেছিলেন কিন্তু মানুষকে ত্যাগ করেননি। নিদ্ধর্ধায় দুঃস্থ বেদনার্ত মানুষকে বুকে টেনে নিয়েছেন। যাদের স্থান সমাজে ‘সবার পিছে, সবার নীচে, সবহারাদের মাঝে।’ তাদের সান্তনা দিয়েছিলেন, রক্ষা করেছিলেন। একইসঙ্গে মানুষও ভগবানকে ভালো বেসেছেন, ভালবাসতে শিখিয়েছেন। এ দেশের অসংখ্য নিম্নবর্ণের মানুষ যখন একদিকে স্বধর্মের তথাকথিত উচ্চবর্ণের দ্বারা অবহেলিত ও অন্য দিকে মুসলমান শাসকের দ্বারা অত্যাচারিত হয়ে অসহায়, পথভ্রষ্ট তখন চৈত্যদেব শুধু তাদে রক্ষাই করেননি, তাদের সহজ সরল অথচ পবিত্র, মর্যাদাপূর্ণ জীবনের পথ দেখিয়েছেন। 

লেখক- ডা. উজ্জ্বল কুমার রায়

চৈতন্যদেব ধর্মের পথে ধর্মীয় গোঁড়ামিমুক্ত চলার পথনির্দেশ করেছেন। চৈতন্যবিপ্লব যে পরিবর্তনের ধারা বয়ে এনেছিল তা রক্ষণশীল ধর্মপ্রনেতাদের রোষের কারণ ছিল, যদিও চৈতন্যদেবকে তা প্রতিহত করতে পারেনি। চৈত্যদেব সমকালীন নাদিয়া তথা বাংলার জাতিপ্রথা প্রাচীরকে ভেঙে দিলেন তাই নয়, এর প্রভাব উত্তর ও দক্ষিণ ভারতেও প্রসারিত হয়েছিল। তাঁর মতবাদ সকলকে ধর্ম ও সাম্প্রদাষিক অত্যাচার থেকে মুক্তির পথ দেখাল। সমস্ত ধর্ম ও মতবাদের ঊর্ধ্বে মানুষকে স্থাপন করে তিনি জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের মিলনভূমি রচনা করতে চাইলেন। কীর্তনের মধ্যে দিয়েই অদ্বিজ চন্ডালে প্রেম প্রচার করে ধনী-দরিদ্র, উচ্চ-নীচ, মুর্খ-বিদ্বান, পাপী-পুণ্যবান সকলকে এক অখন্ড সূত্রে বাঁধলেন।

 শ্রীচৈতন্য ব্রাহ্মণের ব্রাহ্মণত্বকে অস্বীকার করেননি। বেদ, ব্রাক্ষণ, শাস্ত্রকে তিনি সম্মান দিয়েছেন অথচ অব্রাক্ষণ মনুষ্যকুলের অসম্মান দূর করেছেন। লক্ষণীয় বিষয় হল, মহাপ্রভু তৎকালে প্রচলিত হিন্দুবর্ণাশ্রম বা মুসলমান বা অন্য কোনও ধর্মনিন্দা করেননি বা কাউকে ধর্মান্তরিত করার জন্য কখনও চেষ্টা করেননি। কিন্তু তিনি এমন এক বিশুদ্ধ ও উদার পরমধর্ম বা আত্মধর্মের বাণী প্রচার করেছেন যার মধ্যে হিন্দুর বর্ণাশ্রমী অন্ত্যজ, মুসলমান, বৌদ্দ অন্যান্য ধর্মাবলম্বীর স্থান আছে এবং কারও প্রত্যাখ্যান নেই। শ্রীচৈতন্যদেবের ভক্তি আন্দোলন নিছক ভক্তি আন্দোলনে সীমাবদ্ধ ছিল না। এক সাধারণ ভক্তি-আন্দোলনের গৌরবে প্রতিষ্ঠিত করলেন শ্রীচৈতন্যদেব।

গণ-আন্দোলনে বহুবিধ শর্ত থাকতে পারে, যেমন জনসংযোগ, সর্বস্তরের মানুষের অংশ্রগহণ, অত্যাচারের বিরুদ্ধে একত্র প্রতিবাদ, আকষ্মিক চরম বিক্ষোভ, দলনেতা থাকলেও মূলত সম্মিলিত মানুষের আন্দোলন প্রভৃতি। লক্ষ করলে দেখা যায়, গণ-আন্দোলনের সব কয়টি ধাপ তিনি অতিক্রম করেছেন। উচ্চঃস্বরে হরিণাম নেয়ার মধ্যে ফুটে ওঠে শ্রীচৈতন্যের গণভাবনা আর নগর পরিক্রমার মধ্যে দিয়ে জনসংযোগ গড়ে তুলেছেন। মানুষের মাঝে থেকে পরিভ্রমণ করেছেন পদব্রজে আসমুদ্রহিমাচল, দেখেছেন নিপীড়িত মানুষের জীবন-যাপন, শুনেছেন প্রান্তিক মানুষের আর্তি এবং মানবিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছেন জনসাধারণকে। ভারতে অহিংস ধারার তিনি অন্যতম পথিকৃৎ। গণতন্ত্রের দু‘টি বিশিষ্ট দিক হল সামাজিক সচলতা এবং পশ্চাৎপদ শ্রেণির পুনরুজ্জীবন। 

সেক্ষেত্রে বলতেই হয়, ভক্তিবাদী আন্দোলন এই দুই বৈশিষ্ট্যকে সমন্বিত করেছিল। মানুষকে কৃপা বা দয়া নয়, তার মনুষ্যত্বকে সম্মান, তার সুখ-দুঃখে একাত্ম হয়ে তার দুঃখ দূর করার আন্তরিক চেষ্টাই হল প্রকৃত মানবতাবোধ। শ্রীচৈতন্য তার সমগ্র জীবনের আচরণের মধ্যেই এই মানবতাবোধ প্রোজ্জ্বল করে তুলেছেন।

লেখক: সাংবাদিক

এনএস/


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি