ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪

যোগচর্চার উৎপত্তি ভারত না নেপাল

আসিফ হাসান

প্রকাশিত : ১২:০৯, ২৪ জুন ২০২১ | আপডেট: ১৬:০৫, ২৪ জুন ২০২১

নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি ওলি শর্মা গত ২১ জুন আন্তর্জাতিক যোগ দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানে যোগাসন নিয়ে মন্তব্য করে বলেছেন, যোগচর্চার উৎপত্তি ভারতে নয়, বরং নেপালে। যোগচর্চার উদ্ভবের সময় ভারতের কোনো অস্তিত্বই ছিল না। তাঁর এ মন্তব্যে ভারতজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। এ অনুষ্ঠানে তিনি আরো বলেছেন, ভারত যখন বিভক্ত ছিল তখন তা একটি মহাদেশ কিংবা উপমহাদেশের মতো ছিল। আজকের মতো দেশটির তখন কোনো অস্তিত্বই ছিল না। 

প্রসঙ্গত, জাতিসংঘে সাধারণ সভায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সুপারিশের পর ২০১৫ সাল থেকে প্রতিবছর ২১ জুন সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিক যোগ দিবস পালিত হয়। ২০১৪ সালে ভারত জাতিসংঘে যোগ দিবস পালনের খসড়া প্রস্তাব রাখে এবং ১৭৫টি দেশের সম্মতিতে তা গৃহীত হয়। প্রস্তাব উত্থাপনকারী ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজেও একজন যোগ চর্চাকারী। জাতিসংঘের ৬৯তম সাধারণ অধিবেশনে আন্তর্জাতিক যোগ দিবসকে স্বীকৃতি প্রদানের আহ্বান জানিয়ে মোদি বলেন, ‘যোগ আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্যের এক অমূল্য উপহার।’ 

নেপালের প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্য কতটা তথ্যবহুল সে বিতর্কে না গিয়েও বলা যায়, ইয়োগা বা যোগচর্চার উদ্ভব মূলত ভারত উপমহাদেশেই। ইতিহাস বলে ইয়োগ বা যোগ প্রায় পাঁচ হাজার বছরেরও পুরনো। প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশের মুনি ঋষিরা তাদের স্বাস্থ্য ঠিক রাখা এবং দীর্ঘজীবনের জন্য বিভিন্ন কলা-কৌশল আবিস্কার বা আয়ত্ত্ব করেন। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে সর্বপ্রথম এই উপমহাদেশের ঋষি পতঞ্জলি কিছু আসনের কথা বলেন এবং এগুলো মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। পরে ধীরে ধীরে এই কলাকৌশল ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর সর্বত্র। উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর দিকে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাষায় ‘পতঞ্জলিআসনা’ নামে গ্রন্থটি ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে আরো অনেকেই যোগ এর ওপর বেশকিছু গ্রন্থ রচনা করেন। পতঞ্জলি ছিলেন হিন্দু যোগ দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণিক শাস্ত্রগ্রন্থ যোগসূত্র-এর সংকলক।

কোথাও কোথাও দেখা যায় প্রায় পাঁচ হাজার বছরের পুরাতন হরপ্পা সভ্যতার পোড়ামাটির একটি লিপিতে ইয়োগার সবচেয়ে সুপরিচিত ভঙ্গি পদ্মাসনের চিত্র খোদাই করা ছিল।এরও প্রায় ২,০০০ বছর পর সাধকগণ আসন, ধ্যান ও প্রাণায়াম অনুশীলন শুরু করেন।খ্রিষ্টপূর্ব ২০০ সালে সাধক পতাঞ্জলি ইয়োগার প্রাচীন সূত্রগুলো সংকলন করেন; তৈরি করেন একটি সমন্বিত দর্শন।শত শত বছর ধরে সাধকদের নিরবচ্ছিন্ন অনুশীলন আর ইয়োগার সাথে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্তকরণে ইয়োগা আজ পরিণত হয়েছে সার্বজনীন অভ্যাসে।

প্রাচীন গ্রন্থ বেদ, বেদান্ত, উপনিষদ, গীতার মতো শাস্ত্রীয় পুরাণগুলোতেও এর বহু উল্লেখ রয়েছে। তবে সুনির্দিষ্ট সময়কাল চিহ্নিত করা না গেলেও আনুমানিক খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে মধ্যবর্তী কোন এক সময়ে এর যোগের চর্চা শুরু হয়। ইতিহাসবিদগণ ভারতীয় আর্যঋষি পতঞ্জলিকে আধুনিক যোগশাস্ত্রের জনক বলে মনে করলেও এই স্বীকৃতি নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। কারণ পতঞ্জলি ছাড়া আরো অনেকে যোগ উন্নয়নে অবদান রেখেছেন। পতঞ্জলি একটি আদর্শ ও নৈতিক জীবন যাপন চর্চার মাধ্যমে সমৃদ্ধ জ্ঞানানুসন্ধানের নিহিত লক্ষ্য অর্জনে The Yoga Sutra of Patanjali বা ‘যোগসূত্র’র ১৯৫টি সূত্র সংকলন করেছেন। যার মাধ্যমে তিনি যোগশাস্ত্রসম্পর্কিত অর্জিত জ্ঞান পরিকল্পনা ও যাবতীয় ভাবনাগুলোকে কতকগুলো আবশ্যকীয় নীতিমালা বা গাইডলাইন আকারে প্রকাশ করেন। এগুলোই যোগসাধনার মৌলিক উৎস হিসেবে বর্তমানে স্বীকৃতি পেয়ে আসছে। যাকে পতঞ্জলি লক্ষ্যনিহিত সুষ্ঠু জীবন যাপন পদ্ধতির নিয়মাবলী হিসেবে চিহ্নিত করেন। তাঁর মতে ইয়োগা বা যোগসাধনা প্রচলিত বা উদ্দেশ্যহীন জাগতিক কর্মপ্রবাহে নিজেকে নিয়োজিত করতে প্রয়োজনীয় সামর্থ্য অর্জনের লক্ষ্যে গুরুগৃহে শুধুমাত্র কিছুক্ষণ আসন বা শরীরচর্চা করা নয়; বরং তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু। ইয়োগা হচ্ছে নিহিত লক্ষ্য নিয়ে দেহ মন ও আত্মশক্তিকে উৎকর্ষতায় উন্নীত করার একটি কার্যকর মাধ্যম। ৫ হাজার বছরেরও পূর্বে সিন্ধু নদীর তীরবর্তী ধ্বংস হয়ে যাওয়া প্রাচীন হরপ্পা সভ্যতা বা তারও আগে থেকে ইয়োগার অস্তিত্ব যে ছিলো তা প্রাপ্ত ইয়োগা-আসনের প্রত্ন-নিদর্শন থেকেই বোঝা যায়।

শরীরমাদ্যং খলু ধর্ম সাধনম- এর পথ হলো সুপ্রাচীন ভারতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের আধ্যাত্ম দর্শনের অন্তর্ভূক্ত যোগশাস্ত্রের একটি বিশেষ পথ। যাকে হঠযোগ বলা হয়। দেহকে গঠন করে, তাকে রোগমুক্ত করে, দীর্ঘায়ু করে তবেই যোগের কঠিন সাধনায় এগুতে হবে। নইলে ভঙ্গিল দেহ অসুস্থ কায়াযোগের নিত্য নতুন সম্পদ গ্রহণে সমর্থ হবে না। যোগফল লাভের পূর্বেই সে-দেহ বিনষ্ট হয়ে পড়বে। প্রাচীন যোগশাস্ত্রের সামগ্রিক ভাবনা এবং পরিকল্পনার একটা নির্দিষ্ট অংশ হলো এই হঠযোগ। যদিও এই সমৃদ্ধ দর্শনের উৎপত্তি ও লালন-পালন প্রাচীন ভারতেই, কিন্তু সময়ের বিবর্তনে এসে এর ব্যাপক চর্চা এখন ছড়িয়ে গেছে দেশকালের সীমানা ছাড়িয়ে গোটা মানববিশ্বে। পার্থক্য কেবল এর আধ্যাত্মিক বীক্ষণের রূপান্তরটুকুতেই। যা বহুবিধ ধারায় বিভক্ত হয়ে নতুন নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও সূত্র সমন্বিত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন পারফরমিং আর্ট বা মনোবীক্ষণিক পদ্ধতি হিসেবে একইসাথে অধ্যয়ন ও জনপ্রিয় চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছে। জুডো, ক্যারাটে, সু, জুজুৎসু, কুংফু ইত্যাদি মার্শাল আর্ট বা সম্মোহন, আত্মনিয়ন্ত্রণ, মেডিটেশন, হিলিং, কোয়াণ্টাম ম্যাথড, যোগ ইত্যাদি ইত্যাদি আরো কতো কী পোশাকী নাম। যন্ত্রসভ্যতার এক বিক্ষিপ্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে দেশকালের গন্ডিহারা বিচ্যুত ও একাকী হয়ে যাওয়া মানবসত্ত্বার কাছে হাজার বছরের পুরনো ভারতীয় আধ্যাত্মিক দর্শন আজ কার্যকর এক প্রায়োগিক দর্শনে রূপান্তরিত হয়ে গোটা বিশ্বে দিনকে দিন অত্যন্ত আগ্রহের ও চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছে।

যোগাসন না যোগব্যায়াম?
ইয়োগা বা যোগ একটি শাস্ত্রীয় কৌশল। ইয়োগা আসলে কী? কী এর রহস্য? এর উৎসই বা কোথায়? ‘ইয়োগা’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে ‘ই্য়ুজ’ যার অর্থ ‘নিয়ন্ত্রণ করা’। এটি মূলত সংস্কৃত শব্দ। বাংলায় ‘যোগ’। এর অর্থ হল ব্যক্তি সত্তার সঙ্গে বিশ্ব সত্তার মিলন। অন্য অর্থে বলা যায় গ্রন্থিভূক্ত করা বা সমন্বয় সাধন করা। কীসের সমন্বয় সাধন? অর্থাৎ মানুষের দেহ ও মনের যৌবন ধরে রাখার কৌশল। এটা নিয়ে অনেকে অনেক রকম মতামত প্রকাশ করেছেন। কেউ বলেছেন আত্মা বা মন ও শরীরকে একত্র করার কৌশলকে ইয়োগা বা যোগ বলে। 

যোগ বা ইয়োগাকে অনেকে যোগব্যায়াম বলে। কিন্তু এই শব্দটি ভুল। ব্যায়াম একটি ভিন্ন বিষয়। যদিও ব্যায়াম পরিশ্রম বা শরীরচর্চার মাধ্যমে দেহকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। পক্ষান্তরে যোগও একটি বিশেষ প্রক্রিয়া বা পদ্ধতি যার মাধ্যমে শরীর ও মনের মধ্যে একটি সমন্বয় সাধন করা হয়। এই সমন্বয় সাধিত হলে শরীর ও মন সুস্থ থাকে। বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা কমে যায়। মন সদা প্রফুল্ল থাকে। বার্ধক্য সহজে কাবু করতে পারে না। ব্যায়াম বহু প্রকার আছে। এর দ্বারা হাত, পা, কাঁধ প্রভৃতি অংশের পেশীর খুব ভালো ব্যায়াম হয়। ঐ সব ব্যায়ামে দেহের সব পেশীর ব্যায়াম হয় কি? যোগাসন ছাড়া অন্য কোন ব্যায়ামে হৃদপিণ্ড, ফুসফুস ও অন্ত্রের পেশীর ব্যায়াম হয় না।

হটযোগ শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা অনুযায়ী দেহযন্ত্রগুলোর কর্মক্ষমতাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত করে। স্নায়ুতন্ত্রের পূর্ণ পরিচর্যার মাধ্যমে মনোদৈহিক সম্পর্কসূত্রগুলোকে প্রকৃতিগতভাবেই একাত্ম করা। এর মৌলিক ধারণা হচ্ছে ‘শরীরমাদ্যং খলু ধর্মসাধনম’ অর্থাৎ, ‘শরীর মন সুস্থ না থাকলে জাগতিক বা পারমার্থিক কোনো কর্মই সুষ্ঠুভাবে করা সম্ভব নয়’। হঠযোগীর ধারণা কোনোরূপ শক্তিকে আয়ত্ত্ব করতে হলেই শরীরকে নিয়ন্ত্রিত করা প্রয়োজন। সাধনার পূর্বশর্ত হচ্ছে শরীরকে সুস্থ রাখা। ‘হঠযোগ’ হঠাৎ কোন আবিষ্কার নয়। প্রাচীন মুনি ঋষিরা যোগীশ্বর মহাদেবকে হঠযোগের ৮৪০০০ আসনের প্রকাশক বলে স্বীকার করে নিয়ে তাঁর ধ্যানে এই দুঃসাধ্য সাধনায় আত্মনিয়োগ করতেন।

ইয়োগা বা যোগ শুধু রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণই করে না; রোগ নিরাময়েও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ভারত উপ-মহাদেশে এর উদ্ভাবন হলেও আজ সারা বিশ্বে ইয়োগা চর্চা বিকাশ ও জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। বাংলাদেশেও এখন এর জনপ্রিয়তা বাড়ছে এবং চর্চা হচ্ছে। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন নব্বই দশকে এই চর্চা শুরু করে। বর্তমানে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ইয়োগা নিয়ে গবেষণা ও চর্চা করছে। দিন দিন এর সদস্যা সংখ্যাও বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রে দুই কোটি মানুষ ইয়োগা চর্চা করছেন। ইতিবাচক চিন্তা, প্রাণায়াম, নিউরোবিক জিম, মেডিটেশনের সমন্বয়ে ইয়োগার পরিপূর্ণ প্রয়োগ মানুষকে তার ভেতরের সুপ্ত অসীম শক্তিকে জাগিয়ে তুলতে পারে। যোগকে জীবনযাপনের অংশ করে তুলতে পারলে দেহ-মনের সুস্থতা ও শান্তি নিশ্চিত হবে। 
লেখক : প্রধান সম্পাদক, আমাদের মানচিত্র
mai2hasan@gmail.com

এসএ/


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি