ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪

রমজানের বরকত ছড়িয়ে যাক প্রতিটি ঘরে

প্রকাশিত : ১৩:২৫, ১৬ মে ২০১৯

আজ ১০ম রোজা। আর যেটুকু সময় সামনে আছে, যদিও জানি না জমিনে কার জন্যে কতটা বরাদ্দ আছে, তারপরও আশাবাদ ব্যক্ত করছি যেন এই সময়টুকু ঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারি। নিয়ত করে ফেলি যেন একাগ্রচিত্তে কাজ করতে পারি। এই সময়টাতে হৃদয় যেন থাকে স্রষ্টার দিকে ধাবিত আর হাত যেন থাকে কর্মের দিকে ধাবিত। তাহলেই যদি বেঁচে থাকি ঈদের আগের দিন, চান রাত বা চাঁদ রাতে আমাদের চেয়ে আনন্দিত আর কেউ হতে পারবেন না।

মানুষের ন্যূনতম চাওয়া হচ্ছে শান্তি। আসলে শান্তি শুধু এই রমজানে যে চাই তা নয়, সবসময়ের জন্যেই আমরা শান্তি চাই। আর শান্তিকে আকৃষ্ট করার জন্যে একটি বাক্য যদি উচ্চারণ করতে হয়, সেটি কী বলতে পারেন কেউ? জ্বী, আসসালামু আলাইকুম। এর উত্তরে আরও আন্তরিকভাবে বলা-ওয়া আলাইকুমুস সালাম। পরস্পর পরস্পরের জন্যে শান্তি কামনা করা। এবারের রমজান থেকে আমাদের প্রত্যয়ন হোক-সবাইকে আগে নিজে সালাম দেবো। অন্যের শান্তিকামনার মধ্য দিয়ে নিজের শান্তিকে আকৃষ্ট করব।

প্রিয় নবীজীর (স) একটি হাদীস বলা আছে, তোমরা রোজা রাখো যাতে সুস্থ থাকতে পারো। দৈহিকভাবে যেমন সুস্থতা আনে রোজা, তেমনি আত্মিকভাবেও। দৈহিক সুস্থতা কীভাবে আসে?

১. রোজা রাখলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে, ইনসুলিন দেহে ছড়িয়ে পড়ে ভারসাম্যপূর্ণ মাত্রায়। তাই ডায়াবেটিস থাকলে রোজা রাখা যায় না, এ ধারণা এখন আর কোনও গবেষণা বলছে না।

২. যারা ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে চান, তাদের জন্যে ডায়েটিংয়ের চেয়ে বেশি কার্যকরী রোজা বা উপবাস। এতে রক্তের অতিরিক্ত কোলেস্টেলরও কমে।

৩. উচ্চ রক্তচাপ, হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমে।

৪. স্মৃতিভ্রম-জাতীয় মস্তিষ্কের বয়সজনিত রোগগুলোর ঝুঁকি কমায়। কারণ, আমেরিকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব এজিংয়ের নিউরোসায়েন্স রিসার্চের গবেষক মার্ক ম্যাটসন ও তার সহকর্মীরা প্রকাশিত একটি গবেষণায় বলেছেন যে, মাঝে মাঝে না খেয়ে থাকলে মস্তিষ্কের বয়সজনিত রোগ যেমন অ্যালঝেইমার, হান্টিংটন ও পার্কিনসন্সের ঝুঁকি অনেক কমে যায়।

৫. অটোফেজি চলে পুরো মাত্রায়। আর সবচেয়ে বেশি শারীরিক উপকার যা হয় তা হলো দেহের টক্সিন দূর হতে শুরু করে। নবীজী (স) সেই তখন বলেছেন যে রোজা রাখলে সুস্থ থাকবে। আর সম্প্রতি জাপানের একজন চিকিৎসাবিজ্ঞানী ইউশিনোরি ওসুমি তার গবেষণার জন্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেছেন। তার গবেষণা ছিল অটোফেজি নিয়ে। অটোফেজি মানে কী? আমাদের শরীর যখন অনেকক্ষণ খাবার পায় না, তখন দেহকোষের অভ্যন্তরে যে টক্সিন জমা হয়, সেগুলোকেই খাবার মনে করে হজম করতে থাকে। হজম হতে থাকে মানে সেগুলোরই বিনাশ হতে থাকে। এবং এই বিনাশ হওয়ার প্রক্রিয়া সবচেয়ে বেশি সক্রিয় থাকে যখন ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত আমরা না খেয়ে থাকি। এটি আমাদের জন্যে সুখবর। কারণ, এবার আমরা কতক্ষণ পার করছি সেহরি থেকে ইফতার পর্যন্ত? ১৪ ঘণ্টারও বেশি সময়!

দীর্ঘ অনাহারের এই সময়টায় দেহে যে শুদ্ধি অভিযান চলে তা আমাদেরকে অনেক বেশি ঝরঝরে রাখতে পারবে যদি খাবারের সঠিক মেন্যুটা আমরা ঠিক করে নিতে পারি। খাবারের এই মেন্যু অনুসরণ করার সঙ্গে সঙ্গে নীতিগতভাবে আমরা সব ধরনের খাদ্য উৎসব থেকে বিরত থাকতে সচেষ্ট থাকব। সেহরি পার্টি এবং ইফতার পার্টি একেবারেই বর্জনীয়। আর আসলে এগুলো অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়। যে কারণে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে ইফতার পার্টির রেওয়াজ বহুকাল ধরে চলে এলেও ছন্দপতন ঘটিয়েছিলেন প্রয়াত সাবেক রাষ্ট্রপতি ড. এ পি জে আবদুল কালাম। তিনি যদিও ধর্মপ্রাণ মুসলমান ছিলেন, কিন্তু রাষ্ট্রপতি ভবনে তার আমলটি ছিল ইফতার পার্টিমুক্ত।

কেন তিনি রেওয়াজের ছন্দপতন ঘটিয়েছিলেন? তার ব্যাখ্যা পাওয়া গেছে তাকে নিয়ে লেখা তারই সাবেক সচিব অবসরপ্রাপ্ত আইএস কর্মকর্তা পি এম নায়ারের একটি লেখা ও সাক্ষাৎকারে। সেখানে পি এম নায়ারে উল্লেখ করেছেন, ২০০২ সালে ড. আবদুল কালাম যখন রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন, তখন রমজান এসেছিল জুলাই-আগস্টে। ভারতীয় রাষ্ট্রপতির জন্যে একটা নিয়মিত রেওয়াজ ছিল যে, তিনি রমজানে ইফতার পার্টির আয়োজন করবেন। সে অনুযায়ী এ আয়োজনের উদ্যোগ নেওয়ার পর ড. কালাম (তার সচিব নায়ারকে) প্রশ্ন করলেন, কেন তিনি একটি পার্টির আয়োজন করবেন? এ পার্টিতে যে অতিথিরা আসবেন, তারা তো সবসময় ভালো খাবার খেয়েই অভ্যস্ত। রাষ্ট্রপতি জানতে চান, একটি ইফতার পার্টির আয়োজনে কত খরচ পড়ে? তখন বলা হয়, প্রায় ২২ লাখ রুপি। ড. কালাম তখন নির্দেশ দেন, এই অর্থ দিয়ে খাদ্য, পোশাক ও কম্বল কিনে কয়েকটি এতিমখানায় দান করতে। এরপর নির্দিষ্ট এতিমখানা বাছাইয়ে রাষ্ট্রপতি ভবনের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি টিম গঠন করা হয়।

এতিমখানা বাছাইয়ের পর ড. কালাম আমাকে (নায়ারকে) তার কক্ষে ডাকলেন এবং এক লাখ রুপির একটি চেক দিলেন। তিনি জানালেন, তিনি তার ব্যক্তিগত সঞ্চয় থেকে কিছু অর্থ দান করছেন। কিন্তু এ তথ্য কারো কাছে প্রকাশ করা যাবে না। এতে ব্যথিত হয়ে নায়ার বলেন, ‘স্যার, আমি এখনই বাইরে যাব এবং সবাইকে বলব। কারণ, মানুষের জানা উচিত— এখানে এমন একজন মানুষ রয়েছেন— তার যা অর্থ খরচ করা উচিত, তিনি সেটা শুধু দানই করেননি, তিনি সেই সঙ্গে নিজের অর্থও বিলিয়েছেন।

আমরা যেখানে বলছিলাম, ইফতারের দাওয়াত, যদি কারো অনুরোধে একান্তই দাওয়াতে যেতে হয়, খেজুর পানি খেয়ে যদি দেখি যে, ভাজা-পোড়া তৈলাক্ত খাবার, মোগলাই, চাইনিজ ফুড, গরু ভুনা, খাসীর রেজালা সার্ভ করা হয়েছে, তাহলে পরিচিতদের সঙ্গে সংক্ষেপে আলাপ শেষ করে বাসায় ফিরে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খেয়ে নেব।

দেহের বিষাণু দূরের জন্যে সেহরি ও ইফতারের গ্রহণীয় ও বর্জনীয় খাবারদাবার নিয়ে এই হলো কয়েকটি বিষয়। এবার আসি মনের বিষাণু দূর করতে কী করব? কারণ, দেহ ও মনের সুস্থতা নিয়েই পরিপূর্ণ সুস্থতা আসতে পারে। তিনটি বর্জনীয় নিয়ে আমরা আজ বলতে চাই।

১. পরচর্চা ও গীবত নিজে করব না। অন্যরা করলেও অংশ নেব না। সরে আসার সুযোগ থাকলে সরে আসব সেই আসর থেকে।

২. অপ্রয়োজনীয় কথা না বলে মৌন থাকতে চেষ্টা করব। কেউ উত্তেজিত হয়ে কিছু বললে বা চ্যাঁচামেচি করতে থাকলে চুপ করে সরে আসব সেখান থেকে। কারণ রমজান মাস ধৈর্য ও সহনশীলতা অনুশীলনের মাস। আর ধৈর্যের প্রতিদান জান্নাত। তাই কেউ বিতর্ক করতে চাইলে বা গায়ে পড়ে ঝগড়া বাঁধাতে চাইলেও কৌশলে এড়িয়ে যাব। অন্যরা যা করছে করুক, আমি নিজে প্রশান্ত থাকব-এই সিদ্ধান্তে আমি নিজে যেন অটল থাকি সে জন্যে প্রার্থনা করব। মনে মনে তাদের জন্যে দোয়া করব। আর যতটা সম্ভব মুখে বা মনে মনে বার বার তাদেরকে বলব সালাম। সূরা ফোরকান-এর ৬৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, দয়াময়ের দাস তারাই, যারা জমিনের ওপর নম্রভাবে চলাফেরা করে। মূর্খরা তাদেরকে কথা বলে উত্ত্যক্ত (বা বিতর্ক সৃষ্টি) করতে চাইলে তারা বলে, তোমাদের প্রতি ‘সালাম’।

৩. আর খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি করণীয় হচ্ছে দুর্ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকা। তারপরও কথা আছে। শুধু দেহের শুদ্ধি হলে হবে না, আপনার দুর্ব্যবহার কমেছে কি না। ভুল করে ফেললে তা বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমা চাইতে পারছেন কি না। যদি তা-ই হয়, তাহলে বুঝতে হবে যে, রোজায় আপনার মধ্যে আত্মিক শুদ্ধি এসেছে। আপনার মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে আল্লাহ-সচেতনতা। আসলে এটিই রোজার মূল লক্ষ্য। আল্লাহ আছেন, তিনি আমাদেরকে দেখছেন, তিনি আমাদেরকে বলে দিচ্ছেন কোন কাজ কীভাবে করতে হবে, কী থেকে দূরে থাকতে হবে-অর্থাৎ এই যে মহান প্রভুর বিধিবিধান, এটি খেয়াল রাখা মানেই আল্লাহ-সচেতনতা।

আর এই সচেতনতা সৃষ্টির জন্যে প্রয়োজন কোরআন চর্চা। রমজান মাস যেহেতু কোরআন নাজিলের মাস, তাই এই মাসে যত বেশি কোরআনের বাণীর সান্নিধ্যে সময় কাটানো যাবে, তত আমাদের জন্যে মঙ্গল।

নবীজী (স) বলেছেন যে, হে মানুষ! তোমাদের কাছে এসেছে অত্যন্ত মর্যাদাসম্পন্ন ও বরকতপূর্ণ একটি মাস। …এ মাসের নফল ইবাদত ফরজ আদায়ের সমান সওয়াবের। আর একটি ফরজ ইবাদত ৭০টি ফরজ আদায়ের সমান সওয়াবের...।  তাই আত্মশুদ্ধি এবং দেহের শুদ্ধি দুই দিক দিয়েই আমরা যেন এই রমজানকে চমৎকারভাবে অতিবাহিত করতে পারি পরম করুণাময়ের কাছে এই প্রার্থনা আমরা করব আজ ইফতারের বরকতময় সময়ের আগে।


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি