ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪

রাজনীতি থেকে মহাপ্রাণের বিয়োগ

মিলটন রহমান :

প্রকাশিত : ১৪:৫৯, ৪ জানুয়ারি ২০১৯ | আপডেট: ১৫:৩২, ৪ জানুয়ারি ২০১৯

শপথ নিতে পারলেন না সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। চলে গেলেন তিনি। গত বছর স্ত্রী শীলা আহমেদের মৃত্যুর পর থেকেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। আমি থাকি পূর্ব লন্ডনের ইস্টহামে। এখান থেকে মাত্র পাঁচ মিনিটের দূরত্ব ব্যাকটন।

সেখানেই তিনি মেয়ের সঙ্গে থাকতেন। কয়েকবার দেখা করার উদ্যোগ নিয়েও যাওয়া হয় নি। আমার এমনই হয়। অনেক মহৎপ্রাণ মানুষ হারিয়েছি যাদের মহত্ব কেবল দূর থেকে দেখেছি। কাছে যাবো যাবো করে যাওয়া হয় নি।

আমার সেই তালিকায় শেষ মানুষটি রাজনীতিতে আমার প্রিয় নেতা সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। রাজনীতিতে আমার পছন্দের নেতার তালিকা একেবারে ছোট। এই ছোট তালিকায় অন্যতম হলেন তিনি। 

পূর্ব লন্ডনের ব্যাকটনে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের  নিজের বাড়ি। এ বাড়িতেই ছিলো তার স্ত্রী’র বসবাস। বিলেতে বাঙালী কমিউনিটিতে শীলা আহমদেরও ভূমিকা কম ছিলো না।

বিশেষ করে নারী আন্দোলনে বা চেতনায় ‘নারী জাগরণ‘ সেন্টারসহ বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। স্ত্রীর মৃত্যুর পর সৈয়দ আশরাফ লন্ডনে বসবাস করতে শুরু করলেও দেশ ও রাজনীতির টানে আবার দেশেই ফিরে আসেন। কিন্তু সেই যাত্রায় অসুস্থ হয়ে তিনি চিকিৎসা নিতে শুরু করেন ব্যাংককে। সেখান থেকে মহৎ রাজনীতিকের মহাপ্রাণ আর ফিরে আসলো না। তিনি এখন মহাকালের স্বাক্ষী হয়ে আমাদের মাঝে বিলীন হয়ে রইবেন।

১৯৭৫ সালের তিন নভেম্বর চার নেতা হত্যাকান্ডে পিতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম নিহত হওয়ার পর তিনি চলে আসেন লন্ডনে। এখানে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল এলাকায় বসবাস শুরু করেন। চাকুরীর পাশাপাশি সামাজিক-রাজনৈতিক কাজে তিনি নিজেকে যুক্ত করেন। বিশেষ করে বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনে তার ভূমিকা এখনো লোকমুখে ঘুরেফিরে।

জন্মগতভাবেই রক্তে রাজনীতির ধারা নিয়েই ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন সৈয়দ আশরাফ। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সন্তান। পিতার মতো সততা-নিষ্ঠা এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞা সবকিছুরই সম্মিলন ছিলো তার মধ্যে।

দেশে ফিরে ১৯৯৬ সালে কিশোরগঞ্জ সদর আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর আরো টানা তিনবার ২০০১, ২০০৮ এবং ২০১৪ সালেও এমপি নির্বাচিত হন।

দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি নিষ্ঠার সঙ্গে মন্ত্রীত্বের দায়িত্বও পালন করেন। এসব দায়িত্ব পালনে তার বিরুদ্ধে কখনো অসততার অভিযোগ ওঠে নি।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সংকটে তার ভূমিকা ছিলো অবশ্যই স্বীকার্য। এক এগারো’র সংকটে তিনিই ছিলেন আওয়ামী লীগের সঞ্চালক। আওয়ামী রাজনীতিতে তার নিরবচ্ছিন্ন অবদানের কথা ভুলেন নি আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ক্যান্সারক্রান্ত সৈয়দ আশরাফুলকে তাই তিনি এবারও প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেন।

নিজের অনুপস্থিতিতেও সৈয়দ আশরাফ বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। ভোট জয় করতে পারলেও জীবন জয় আর করতে পারলেন না তিনি। মহৎ প্রাণ ও মহৎ জীবন রেখে তিনি চলে গেলেন অন্য দেশে। যেখান থেকে কখনো কেউ ফিরে আসে নি। তাকে হারিয়ে লন্ডনের বাঙালী কমিউনিটিতেও চলছে শোকের মাতম।

দল-মত নির্বিশেষে সকল শ্রেনী-পেশার মানুষ তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। তিনি আর লন্ডনে অসবনে না, কিন্তু এখানে রেখে যাওয়া তার কাজ কমিউটিকে বারবার স্মরণ করাবে। আমার এ মুহুর্তে খুব মনে পড়ছে তাকে টেলিভিশন টক শোতে আনতে না পারার ব্যর্থতা। কোন টেলিভিশন টক শো’তে তিনি যান না।

আমি কখনো চেষ্টা করি নি তাকে আনার। কেবল একবার উদ্যোগ নিলাম। যোগাযোগ করলাম ফোনে। বুঝানোর পরে মৌন সম্মতি দিয়েছিলেন আসবেন বলে।

কিন্তু স্ত্রী’র অসুস্থতার দরুণ জার্মানে চলে যাওয়ায় তাকে বাংলা টিভিতে আমার উপস্থাপনায় আয়োজিত টক শো ‘জনতার মঞ্চ’-তে আনতে ব্যর্থ হয়েছিলাম। এ ব্যর্থতা আর কখনো পুরণ করার সুযোগ পাবো না।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের মতো নেতা বিরল। আমি হলফ করে বলতে পারি তার মতো ডজন খানেক নেতা রাজনীতিতে থাকলে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক চেহারা ভিন্ন হতো।

তিনি যে স্থান খালি করে গেলেন তা পুরণ হতে কতোগুলো বছর অপেক্ষা করতে হবে তার উত্তর জানতে সময়ের দিকেই চেয়ে থাকতে হবে। সৈয়দ আশরাফ বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে দর্শন এবং আদর্শ প্রতিষ্ঠা করে গেছেন তা আমাদের রাজনীতিকরা স্মরণ করবেন কিন্তু অনুসরণ করবেন কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ঠ সন্দেহ রয়েছে।

কেননা এখনতো রাজনীতিকে বাণিজ্য হিসেবেই নিয়েছেন অনেকে। আশরাফুল ইসলামের আদর্শ অনুসরণ করলেতো পকেট ভারী হবে না। ক্ষমতার অপব্যবহার করা যাবে না। রাজনৈতিক দূর্বৃত্ত হওয়া যাবে না।

সৈয়দ আশরাফ আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অত্যন্ত বিশ্বাসের মানুষ ছিলেন। তাকে হারানোর ক্ষত কখনো শুকাবার নয়। আমরা সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করি প্রধানমন্ত্রী, সৈয়দ আশরাফের মতো আরো রাজনীতিক তৈরী করবেন।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এমন প্রতিশ্রুতিশীল নেতা উপহার দিতে পারলে সোনার বাংলা সত্যিই সোনার বাংলায় রূপান্তরিত হবে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন যে অসহিষ্ণুতা বিরাজমান। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন যে অবক্ষয় ধাবমান। তা থেকে উত্তরণ ঘটাতে হলে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের মতো রাজনীতিক প্রয়োজন।

আজকের দিনের নতুন রাজনীতিকরা তাকে অনুসরণ করবে এটাই আমার বিশ্বাস। তা না হলে এই স্বাধীন ভূ-খন্ড একদিন বিরান ভূমিতে রূপান্তরিত হবে। এই সংকট থেকে উত্তরণে সৈয়দ আশরাফের সঙ্গে পরিচয় ঘটাতে হবে নতুন প্রজন্মের।

ইতিহাসে সঠিকভাবে তুলে ধরতে হবে তার ভূমিকা। বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্থিতিশীল ও টেকসই চর্চার জন্য এটি এখন অবশ্যই প্রয়োজনীয়। এর কোন বিকল্প নেই।

সংকট উত্তরণ করতে হলে সুষ্টু রাজনীতি চর্চা করতেই হবে। তাই আমরা আশা করতেই পারি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সৈয়দ আশরাফের রাজনৈতিক চিন্তা-দর্শন নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করবে।

লেখক : মিলটন রহমান, কবি, কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক, লন্ডন

এসএ/

 


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি