ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ০৯ মে ২০২৪

‘লাশটাও ফিরতো না’

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৮:১৬, ১১ জুন ২০১৮

গেলাম হাসপাতালে কাজের জন্য। পেলাম বাসাবাড়ির কাজ। তাতেও দুঃখ নেই। বাসার কাজ করেও সুখে থাকা যায়। কিন্তু সে বাসা তো বাসা নয়, ছিল নির্যাতনের আখড়া। যেখানে আমাকে রাতদিন করতে হয় কাজ। হারাতে হয় সম্ভ্রম। তারপরেও নিস্তার নেই। প্রতিদিনই কোন না কোন নীপিড়ন। চড়-থাপ্পড়, লাথি, গুতা আর ধাক্কা।

এরপরে পায়নি একটি টাকা, পেটেও জোটেনি খাবার। খেয়ে না খেয়ে জীবন প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। ভেবেছিলাম আমার লাশটাও দেশে ফিরবে না। আর হয়তো দেখতে পাবো না মা-বাবা আর সন্তানদের মুখ। কথাগুলো বলছিলেন সৌদি আবর ফেরত রাজশাহীর সখিনা খাতুন।

স্বামী দুই সন্তান ও বাবা-মা নিয়ে সফিখান দিন বছর খানেক আগেও যাচ্ছিল ভালো। কিন্তু ৭ মাস আগেই তার স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটে। ডিভোর্সের পর সখিনা দুই সন্তান আর বাবা-মাকে নিয়ে চরম অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে যায়। ক্লাস থ্রিতে পড়ুয়া ছেলে ও শিশু মেয়েকে নিয়ে সখিনার দিন যেন আর কাটে না। খেয়ে না খেয়ে খুব কষ্টের মধ্যে যাচ্ছিল তার দিনগুলি। চরম অর্থকষ্টের এ যাতাকল থেকে বাঁচতে সখিনা পাড়ি জমিয়েছিলেন বিদেশ। আশা বুনেছিলেন নিজ হাতে অর্থ রোজগার করে মা-বাবা আর দুই সন্তানের মুখে হাঁসি ফোটাবেন। সংসারের স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনবেন। কিন্তু বিধিবাম। আশা তার পূর্ণ হলো না। বরং উল্টো তার জীবনটা যায় যায়। এমনকি লাশটাও দেশে ফেরার আশা তার ছিল না।

সখিনা বলেন, আমাকে মেডিকেলে কাজের কথা বলে সৌদি আরবের রিয়াদে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে কাজের জন্য মেডিকেলের পরিবর্তে নিয়ে যাওয়া হয় একটি বাসা বিাড়িতে। বাড়িগুলোর নাম ছিল বান্দু। সেখানে আমাকে গৃহের কাজ করতে দেওয়া হয়। কিছুদিন কাজ করার পর আমার ওপর শারীরিক নির্যাতন শুরু করে। আমি জানতাম না বাড়িওয়ালা খুব খারাপ। পরে জানলাম ওরা এতই খারাপ, যাদের কাছ থেকে সতীত্ব ফিরিয়ে আনা সম্ভব না। শারীরিক ও মানুষিক নির্যাতনের মধ্যে ১টি মাস চলে গেলেও ওরা আমার বাড়িতে কথা বলতে দেয়নি। বেতনও দেয়নি। এভাবে দুইমাস যাওয়ার পর ওরা আমার ওপর হাত তোলা শুরু করলো। প্রতিদিনিই মারধর করতো। ওদের রেখে দেওয়া বাঁশি খাবার খেয়ে জীবনটা বাঁচিয়ে রাখতে হতো। তবে প্রায়ই একটা থেকে ২টা খেজুর খেয়ে সকাল কাটাতে হতো। ওরা বাহিরে গেলে ঘরে তালা মেরে রেখে যেত। একবার ওরা পরিবার ধরে বেড়াতে গিয়েছিল। আমাকে বাসাই একা তালা বন্দী করে রেখে গিয়েছিল। তারপর আমি সবচেয়ে বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ি।

সৌদি আরব থেকে ফিরে এভাবে কষ্টের কথা আরও শোনায় মাদারিপুরের শারমিন আক্তার, ঢাকার শাহনাজ বেগম, নীলফামারীর শান্তনা রানী, ঢাকার সালমা, চাঁদপুরের রোকেয়া বেগম, যশোরের সবিরন বেগমসহ ২০ নারী। সোমবার রাজধানীর মহাখালীর ব্র্যাক ইন সেন্টারে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তারা এসব কথা বলেন।

সখিনার মতো সৌদি শেখদের হাতে নির্যাতিত হয়েছে মাদারিপুরের শারমিন আক্তার। শারমিন বলেন, দালাল শাজাহান আমাকে মেডিকেলের ভিসার কথা বলে সৌদি পাঠায়। ওখানে যাওয়ার পর জানতে পারি বাসা-বাড়ির ভিসা। যদি ফিরে আসি তাহলে মানুষ খারাপ বলবে-এই চিন্তা করে ওই বাসাতে কাজ করতে থাকি। বাসাতে জমজ ৫টি বাচ্চা ছিল। তাদের বড় ভাই ছিল সাতজন। সব মিলিয়ে তিন তলার বাড়িতে ১৫ জন মানুষ ছিল।

সারাদিন কষ্ট করে কাজ করতাম। কিন্তু ওরা আমাকে খেতে দিত না। খেতে দিত খেজুর আর রুটি। ওরা যখন খেত, তখন সেখান থেকে কিছুটা রুটি ছিড়ে আমাকে দিত। বাচ্চাদের গোছগাছ করা ও তিন তলা বাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে এভাবে খেজুর আর রুটি খেয়ে থাকতে খুব কষ্ট হতো। কিন্তু কিছুই করার ছিল না। তাই কাজ করে যেতাম।

তিনি বলেন, একদিন আমাকে বাড়িতে রেখে ওরা সবাই বাইরে চলে যায়। বলে যায় একদিন পরেই চলে আসবে। কিন্তু এক সপ্তাহ চল গেলেও কেউ আসে না। ফ্রিজে তালা মারা। ফলে কিছু না খেয়েই এক সপ্তাহ পার করি। ৮ দিনের মাথায় মালিকের বড় ছেলে বাসায় আসে। সে টেবিলের ওপর বাসার চাবি রাখে। এরপর সেই চাবি দিয়ে বাসা খুলে পালিয়ে আসি। না খেয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে অনেক কষ্ট হচ্ছিল। তারপরও প্রায় এক কিলোমিটার রাস্তা হেঁটে আসি। পথের মধ্যে পাকিস্তানের এক ট্যাক্সি চালকের সঙ্গে কথা হয়। সে আমার সব কথা শুনে বাংলাদেশ অ্যাম্বাসিতে নিয়ে যায়, বলেন শারমিন।

তিনি বলেন, অ্যাম্বাসি থেকে আমাকে সেফহোম নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে গিয়ে আমি আবাক। আমার মতো অসংখ্য মানুষ। একটি ঘরের মধ্যে সবাই গাদাগাদি করে থাকছে। তার মধ্যেই থাকলাম। চারদিন পর মাকে ফোন করি। মা দালালকে বিষয়টি জানালে, ওই দালাল বাড়ির মালিককে ফোন করে জানিয়ে দেয়। এরপর আমার মালিক সেফহোম এসে অভিযোগ করে আমি ৪টি মোবাইল চুরি করে নিয়ে এসেছি। কিন্তু সেফহোমের স্যাররা তার প্রমাণ না পাওয়ায় মালিকের কাছে ফিরিয়ে দেয়নি।

শারমিন বলেন, শেখদের নির্যাতনে পালিয়ে সেফহোমে আশ্রয় নিলেও নির্যাতন বন্ধ হয়নি। সেফহোমে কোনো রকমে লবণ-হলুদ দিয়ে রান্না করে খেতে দিত। এ নিয়ে কেউ কোনো কথা বললে দূতাবাসের স্যাররা অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করত। আর বলত- তোরা দেশে খারাপ কাজ করে এখানে আসছিস। আবার এখানে এসে বেডাগোর লগে এডি করে, এখন আমাদের জ্বালাস। তোদের থাকতে দিছি থাকবি, না থাকতে চাইলে গেট খুলে দিচ্ছি তোরা যা গা। বাইরে গিয়া মরলে কোনো রকমে তোদের লাশ এসে দেশে পাঠিয়ে দেব।

তিনি বলেন, ‘সৌদি মালিকদের কাছে অত্যাচারের শিকার হয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসে আসি সাহায্যের জন্য। কিন্তু উল্টো দূতাবাসের স্যাররা আমাদের ওপর অত্যাচার করা শুরু করে। বাথরুমে পানি না থাকলে স্যারদের জানালে বলে- পানি লাগব না, ওইভাবেই থাক। নানাভাবে এমন মানসিক নির্যাতন করত। কোনো মেয়ে চিল্লাচিল্লি করলে তাকে মানসিক ইনজেকশন দিয়ে দেওয়া হত। শতশত মেয়েদের এভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে। দূতাবাসের বড় স্যারের নির্দেশে এসব করা হয়।

এসএইচ/


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি