ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪

শেখ হাসিনা: একজন মানবিক নেতা ও ফেনী নদী চুক্তি

ড. গোলাম সাব্বির সাত্তার

প্রকাশিত : ১০:৩০, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২০

২৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিন। জন্মদিনে তাঁর প্রতি অনিঃশেষ শুভেচ্ছা ও প্রাণঢালা অভিনন্দন জ্ঞাপন করছি। ১৯৪৭ সালে টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের ঘরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর অবিসংবাদিত নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠা পায় আধুনিক বাংলাদেশ রাষ্ট্রের। এই দেশের সফল ও সার্থক সরকার প্রধান বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি এক দশকের অধিক সময় ধরে বৈশ্বিক ব্যবস্থাপনায় এক সার্বজনীন স্থিতিশীল উন্নয়নকামী মধ্যেম আয়ের দেশ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁর অভিষ্ঠ লক্ষ্য বাংলাদেশের মানুষকে মর্যাদাশীল রাষ্ট্রের অংশীদার করা। তিনি সেই পথেই চলেছেন, দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে নির্দৃষ্ট লক্ষ্যর দিকে দেশকে এগিয়ে নিচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্ব ও সাফল্যে আমাদের অনেককেই বিস্মিত করে। কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে নৈর্ব্যক্তিক হলে এমনটা হই না- কারণ এটি সময়ের ইতিহাসের এক অনিবার্যতাই বটে। শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর যোগ্য উত্তরসূরি। 

বঙ্গবন্ধুর লিখিত পুস্তকাদি পড়লে এবং বিভিন্ন সময়ের ভাষণগুলো মন দিয়ে শুনলে, যথাযথভাবে অনুধাবন করলে বিষয়টি সহজেই অনুমেয় হয়। এ প্রসংগে ১৯৭২ সালে জানুয়ারি মাসে বৃটিশ সাংবাদিক ডেভিট ফ্রস্টকে দেয়া সাক্ষাৎকার এবং ১৯৭৪ সালে ২৫শে সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে প্রদত্ত ভাষণটি রেফারেন্স হিসেবে আমরা স্মরণ করতে পারি। এবং যৌক্তিকভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ হাসিনাকে আবিষ্কার করতে গেলে তা হৃদয় ও মস্তিষ্ক দিয়ে অনুধাবন করতে হবে; অধীত জ্ঞানকে প্রবহমান জীবনধারায় প্রোথিত করে চেতনার জগৎকে আলোকিত করতে হবে আমরা যদি উদেশ্যেপ্রণোদিত ও লক্ষহীনভাবে ধাবমান হলে, নিষ্ফলা স্মৃতিচারণে কিংবা নিজ কৃতিত্বের রোমন্থনে নিমগ্ন হলে- তাঁদের দীপ্যমান আলো নিষ্প্রভই রয়ে যাবে।
 
বাংলাদেশে রাজনীতির অঙ্গনে শেখ হাসিনার অভ্যূদয় হয়েছিল এক ভয়াবহ বেদনাদায়ক বিয়োগান্তক পরিপ্রেক্ষিতে। বলা যেতে পারে ইতিহাসের অলক্সঘনীয় পূনরাবৃত্তির ঘটনাচক্রে। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের পূর্বেই বঙ্গবন্ধুর পরামর্শে ছোট বোন শেখ রেহানা, পুত্র জয়, কন্যা পুতুলসহ জার্মানিতে অবস্থানরত স্বামী প্রখ্যাত পরমাণু বিজ্ঞানী ওয়াজেদ মিয়ার কর্মস্থলে যান। এই নৃশংস ঘটনার সময় শেখ হাসিনা বেলজিয়ামে অবস্থান করছিলেন। পরবর্তীতে সপরিবারে জার্মানী হয়ে ভারতে আসেন। বাঙ্গালীর আত্মবন্ধু শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর পরম মমতায় ও নিরপত্তায় ১৯৮১ সাল পর্যন্ত দিল্লিতে অবস্থান করেন। তিনি ভারতে থাকা অবস্থায় বাংলাদেশের আওয়ামীলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন অতঃপর ১৯৮১ সালের ১৭ মার্চ দেশ প্রত্যাবর্তন করেন। এর পর পরেই সকল ঘটনা রূপকথার মত হলেও সত্যের চেয়ে বেশি সত্য হয়ে ওঠে। আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক দৈন্যতায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত একটি জাতি ও রাষ্ট্রকে কি প্রাজ্ঞতায় এত উঁচুতে নিয়ে এসেছেন, অতীত ও বর্তমানের তুলনাতেই তা সবার কাছে স্বচ্ছ হয়ে ওঠে। আমরা জানি, রাজনীতি শেখ হাসিনার জন্য নতুন কিছু নয়, জন্মসূত্রে পাওয়া এক উত্তরাধিকার। শৈশব থেকেই তাঁর পিতা বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক-সংগ্রামী জীবনকে দেখেছেন। 

নিজে বাবার হতে প্রয়াশই বঞ্চিত হয়েছেন কিন্তু তাঁর দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়েছেন। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে প্রথমে আজিমপুর গার্লস স্কুল এরপর ইডেন গালর্স কলেজে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী থাকাকালীন সময়ে তিনি সক্রিয় ছাত্ররাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। গত একদশকে বাংলাদেশের সবক্ষেত্রেই আকাশছোয়া উন্নয়ন-অগ্রগতি দেশজ ও বৈশিক বিবেচনায় উন্নয়নশীল দেশসমূহে তিনি এক অননুকরনীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাঁর দীপ্ত পদচারণা ও মানবিক উদ্যোগে তিনি দূরদর্শী ক‚টনীতির এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। বিগত সময়ে দশ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীর আশ্রয় প্রদানে ও ভারতের দক্ষিণ ত্রিপুরার সাব্রæম এলাকার সাত হাজারের অধিক জনগোষ্ঠির সুপেয় পানির জন্য ফেনী নদী হতে ১.৮২ কিউসেক পানি প্রদান তারই উদাহরণ।
 
ভারত বিভাজনের সময় প্রাকৃতিক ভূগোলকে উপেক্ষা করে জিন্নাহ-র‌্যাডক্লিফ-মাউন্টব্যাটেনত্রয় এমনভাবে সীমানা নিধারণ করেছিল যাতে সর্বদাই ভাতৃপ্রতিম দুটিদেশে জল-স্থলের সীমানা নিয়ে সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ফেনী নদী মূলত বাংলাদেশেরই অর্ন্তগত। গত শতাব্দীর চল্লিশ দশক হতে ফেনী নদীর মালিকানা নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি তদানীন্ত পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে টানপেড়েন শুরু হয়। ১৯৫৮ সাল থেকে ভারত সরকার নদীটির মধ্যভাগ নিজেদের দাবি করে আসছে। ১৯৫৮ সালে দু’দেশের সচিব পর্যায়ে বোঝাপড়ায় কোন সমঝোতায় পৌছতে ব্যার্থ হয়। সমস্যাটি পাকিস্তান সরকার হতে বাংলাদেশের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত।
 
ফেনী নদী বাংলাদেশের দক্ষিণপূর্বে প্রবাহিত একটি আন্তঃসীমান্ত নদী। বাংলাদেশের বিলোনিয়ার উত্তরে ভারতের দক্ষিণ ত্রিপুরা রাজ্যের মধ্যবর্তী পবর্তশ্রেণী থেকে উৎপন্ন হয়ে রামগড় পর্যন্ত দক্ষিণ পশ্চিমে প্রবাহিত। পরে তা ত্রিপুরা ও পার্বত্য চট্টগ্রামের মধ্যকার সীমানা দিয়ে পশ্চিমে প্রবাহিত হয়েছে। এরপর সমতলভ‚মিতে নেমে নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম জেলাকে পৃথক করে কিছুটা পশ্চিমে প্রবাহিত হয়। পরে দক্ষিণমুখী হয়ে ফেনী জেলার পূর্বভাগ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গপসাগরে পড়েছে। উৎসমুখ থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত নদীটির দৈর্ঘ্য প্রায় ১১৬ কি.মি.। বাংলাদেশের প্রবেশমুখ থেকে বঙ্গপসাগরে পতিত স্থান পর্যন্ত দৈর্ঘ্য প্রায় ৮০ কি. মি.। এই ৮০ কি.মি. নৌপথে সারা বছর ছোট-মাঝারী নৌযান চলাচল করে। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে ৭০ কি. মি. অংশ রয়েছে নদীর। নীদিটির গড় গভীরতা ও প্রস্থ যথাক্রমে প্রায় ১০ মি. ও ১৫০ মি.। নদী অববাহিকার আয়তন প্রায় ১২৫ বর্গ কি. মি.।
 
খাগড়াছড়ির রামগড় সীমানার উত্তর-দক্ষিণ ত্রিপুরায় সাব্রুম নগরের অবস্থান। শহরটির দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে সুপ্রসিদ্ধ শ্যাক্যমনি বৌদ্ধবিহার অবস্থিত। ছোট-খাটো ঝিমছাম পাহাড়ী শহরটি সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে ২৬ মি. উচ্চতায় অবস্থিত। বর্তমান জনসংখ্যা আনুমানিক সাত হাজার। ১৯৮০ সালের গোড়ার দিক হতে সাব্রæম নগরতলীতে সুপেয় পানির সংকট দেখা দেয়। সেই সময় হতে সাব্রুম বাজার সংলগ্ন এলাকায় (নো-ম্যানস ল্যান্ডে) হতে ভারতীয় জনগণ উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎ চালিত লো-লিফট পাম্প মেশিনের মাধ্যমে অবৈধভাবে নদীর পানি তোলা শুরু করে এবং স্থায়ী পাম্প হাউজ নির্মাণ করে। ১৯৮২ সাল থেকে ২০০২ সালের মধ্যে প্রায় ৩৬টি পাম্প স্থাপন করা হয়। বিষয়টি অবশ্যই আন্তর্জাতিক সীমান্ত আইনের বরখেলাফ। আইনে উল্লেখ আছে সীমান্তের ১৫০ গজের মধ্যে কোন অবকাঠামো নির্মাণ অবৈধ। বিষয়টি নিয়ে ২০১০ সালে ৪-৫ জানুয়ারি বাংলাদেশ ও ভারতের পানি মন্ত্রণালয়ের সচিব পর্ষদের বিস্তারিতভাবে আলোচনা হয়। আলোচনায় ভারত আইনসিদ্ধভাবে সাব্রুম শহরের বাসিন্দাদের খাবার পানির জন্য শুষ্ক মৌসুমে ১.৮২ কিউসেক পানি সরবরাহের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের কাছে আবেদন রাখে। 

পরবর্তীতে ৫ মার্চ ২০১০ তারিখে অনুষ্ঠিত ‘যৌথ-নদী কমিশনের’ (জেআরসি) সচিব-সভার ভারতীয় প্রস্তাবটি আমলে নিয়ে ফেনী নদীর পানি সরবরাহের বিষয়ে চ‚ড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়। এরপর ২০১২ সালে যৌথনদী কমিশনের সভায় পানি সরবরাহের বিষয়ে বাংলাদেশের পক্ষ হতে ৭টি শর্ত আরোপ করা হয়। শর্তগুলি : (১) পানি উত্তোলনের অবস্থানের প্রশস্ততা ৪.৫ মিঃ হবে (ভারতের দাবি ছিল ৭.৬৫ মি.), (২) সকল বিষয়ে চ‚ড়ান্ত করে বাংলাদেশ পাম্প সরবরাহ করবে, (৩) কোন অবস্থায় পানি ১.৮২ কিউসেক এর বেশি হবে না, (৪) দুইদেশের সংশ্লিষ্ট প্রধান প্রকৌশলীবৃন্দ পাম্পের সক্ষমতা নিরীক্ষা করে পানি উত্তোলনের বিষয়টি নিশ্চিত করবে, (৫) একটি মাত্র পাইপের মাধ্যমে পানি উত্তোলন করতে হবে, (৬) সংশ্লিষ্ট প্রধান প্রকৌশলীগণ যৌথভাবে উত্তোলন ক‚পের (রহঃধশব বিষষ) অবস্থান নির্ধারণ করবে, (৭) উত্তোলন ক‚পের কারণে বাংলাদেশের প্রান্তের নদী সংলগ্ন এলাকায় কোন নদী ভাঙ্গন দেখা দিলে, ভারত তার সুরক্ষার ব্যাবস্থা করবে।
 
এহেন শর্তে ভারত রাজী হলে পরিশেষে গত ১৯ আগস্ট ২০১৯ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত যৌথ নদী কমিশনের সচিব পর্যায়ের সভায় ফেনীসহ আর ছয়টি, অর্থাৎ মোট সাতটি আন্তঃসীমান্ত নদীর পানির হিস্যার বিষয়ে চুক্তিতে উপনীত হবার জন্য তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের বিষয়ে ঐক্যমত্য স্থাপিত হয়। নদীগুলি যথাক্রমে মনু, মুহুরী, খোয়াই, গোমতি, ধরলা, দুধকুমারি ও ফেনী নদী। ফেনী নদীর পানি দেওয়ার বিষয়ে দীর্ঘ সময় ধরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও আলোচনা এবং যথাযথ পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। অবশেষে গত ৫ অক্টোবর ২০১৯ সালে দিল্লিতে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে সাময়িক সমঝোতা স্মারকটি সাক্ষরিত হয়।
 
বাংলাদেশের জন্য এটি একটি অন্যন্য মানবিক কুটনৈতিক সাফল্য। ঘটনাক্রমে এই সাময়িক চুক্তিটি দক্ষিণ এশিয়া বিগত দুই দশকের ইতিহাসে প্রথম বন্ধুত্বের স্মারক হিসাবে স্থান করে নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী হিসাবে এখানেই শেখ হাসিনার কৃতিত্ব। তাঁর এই বুদ্ধিদীপ্ত মানবিক বিষয়টিকে অনেকেই ভারতের কাছে দেশ বিক্রির অচল পুরানো জিগির তুলে অপপ্রচারে লিপ্ত হয়েছিল সঙ্গত কারণে মোটেই তা ধোপে টেকেনি। একটি বিষয় মনে রাখতে হবে আওয়ামী লীগের জন্ম জনগণের হৃদয়ের ভালোবাসা হতে। বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থ রক্ষাই এই দলের আরোধ্য বিষয়। ১৯৭৫ হতে ১৯৯৫ এবং ২০০১ হতে ২০০৬ পর্যন্ত বিভিন্ন তথাকথিত রাজনৈতিক দলের অপশাসনে এই দেশ বিপর্যস্ত হয়েছে। 

দেশের হিতকার্যতো দূরের কথা সীমান্তবর্তী বিতর্কিত সীমানা ও নদীর পানি সামস্যার বিষয়ে কোন উদ্যোগেই ঐ সকল দল গ্রহণ করেনি। কোন এক সময়ে এক সরকার প্রধান ভারত সফর শেষে দেশে ফিরে সাংবাদিকদের গঙ্গা নদীর পানির হিস্যার সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন ‘ওহ! আমিতো বিষয়টি ভুলেই গেছি’। ১৯৯৬ সালের গঙ্গা চুক্তি, ২০১২ সালে মায়ানমারের সাথে সমুদ্র সীমানা চুক্তি, ২০১৫ সালে ছিটমহল চুক্তি এবং সর্বশেষ ২০১৯ সালে ফেনী নদীর পানি প্রত্যাহার সংক্রান্ত সাময়িক চুক্তি সবই জনগণের নেতা, জননেত্রী শেখ হাসিনার ¯^অর্জিত যোগ্য নেতৃত্ব ও দৃঢ়তার কারণে।
 
এটি সত্য যে কোন উন্নয়নের সাথে প্রকৃতির সম্পর্ক বিপরীতমুখী। নদী হতে উত্তোলিত মাত্র ১.৮২ কিউসেক পানি কি উজানের ‘মুহুরী’ প্রজেক্টের ক্ষতি করবে? পরিবেশ প্রতিবেশের ক্ষতি হবে? এক কথায় না। এ বিষয়ে বাংলাদেশের দুইজন প্রতিষ্ঠিত পানি বিশেষজ্ঞ প্রফেসর আইনুন নিশাত এবং প্রফেসর একেএম সাইফুল ইসলাম সহমত প্রকাশ করে বিবৃতিও দিয়েছেন। পরিবেশগত দিক ছাড়াও মানবিক এবং কুটনৈতিক দিক থেকে এটি সঠিক সিদ্ধান্ত। এছাড়াও পূর্বে যেভাবে অবৈধ পানি তোলা হতোÑ তা বন্ধ হবে এবং সবকিছুই একটি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকবে।
 
বর্ষা মৌসুম বাদে ফেনী নদীর স্ভাবাবিক গড় প্রবাহ ১০২৫ কিউসেক। পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক ২০১১ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশের নদ-নদী রিপোর্টে উল্লেখ আছে, শুকনো মৌসুমে ফেনী নদী ন্যূনতম প্রবাহ থাকে ৪৭.৭২ কিউসেক। কাজেই এই পরিমাণ পানি হতে মাত্র ১.৮২ কিউসেক পানি দিলে ভাটিতে কোন প্রভাই পড়বে না বরং উজানের প্রায় সাত হাজারের অধিক মানুষের জীবন বাঁচবে। ৯ অক্টোবর ২০১৯ বঙ্গভবনে এক সাংবাদ সম্মেলনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশ ফেনী নদী পানির একটি সামান্যতম অংশ ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সাব্রæম এলাকায় সরবরাহ করবে। এটি আসলেই একটি আমানবিক ব্যাপার যখন কেউ পানি চাচ্ছে অথচ তাকে তা দিতে অস্বীকার করা’। 

এখানেই শেখ হাসিনার সাথে অন্যদের পার্থক্য। এজন্যই তিনি মানবতার আধার, একজন অতুল্য মানবিক ব্যক্তিত্ব। মানবিক আচারণ ক‚টনৈতিক কৌশলকেও পরাভ‚ত করে এই চুক্তিটি তারই উদাহরণ। বির্তক শুধু সংঘাতময় পরিস্থিতীই নয় বরং সদ্ভাব ও বন্ধুত্বের দুয়ারও উন্মোচন করে। মনে রাখতে হবে তিস্তাসহ আরো ৫টি নদীর হিস্যা আমাদের বুঝে নিতে হবে। ভবিষ্যতের আলোচনায় এই সামান্য উপহার আমাদের কয়েক ধাপ এগিয়ে রাখবে। কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হয়। এই পানি চুক্তি ভারতের কেন্দ্রীয় ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের জন্য বিশাল চাপ। এটি এখন ভারতের জন্য নৈতিক দায়িত্ব হয়ে গেছে অমীমাংসিত নদীগুলির পানি সরবরাহের বিষয়ে এগিয়ে আসার। 

পাকিস্তান থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত যাবতীয় বির্তকিত বিষয় সমূহের সৌহার্দ্যপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে। এ বিষয়ে ভারতকেই এগিয়ে আসতে হবে যেমনটি করে এগিয়ে এসেছিল ১৯৭১ সালে। বাংলাদেশের ৫৭টি আন্তঃসীমান্ত নদীর মধ্যে ৩টি বাদে সবকটিরই উৎস্থল ভারতে । উজানের দেশ হিসাবে ভারতের প্রধান দায়িত্ব ভাটির দেশের মানুষকে তাদের জীবন-জীবিকার অন্যতম ও সভ্যতার বিকাশের অতুরভূমি নদী ও নদী অববাহিকার মানুষের জন্য পানি সরবরাহ করা। ইতোমধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথাও হয়েছে। নরেন্দ্র মোদি বলেছেন যত দ্রুত সম্ভব তার সরকার সংশ্লিষ্ট সবার অংশগ্রহণের মাধ্যমে তিস্তার পানি চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য কাজ করবে।
 
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর্ন্তজাতিক আন্তঃনদী আইন হেলসিস্কী আইন ১৯৬৯, জাতিসংঘ পানি প্রবাহ সনদ ১৯৯৭ ও বার্লিন আইন ২০০৪ ভালোভাবেই জানেন এবং বোঝেন। নদীর পানি সংক্রান্ত ওই সকল আইনের বিভিন্ন বিধিতে বারংবার পারস্পরিক বোঝাপড়া ও সমঝোতার উপর গুরুত্ব দেবার কথা বলা হয়েছে। সু-সম্পর্কের ক্ষেত্রে একে অপরকে বুঝতে পারাটাই শান্তি স্থাপনের প্রথম ও একমাত্র শর্ত। মানুষের জন্য যে কোন সমস্যা দ্রুত সমাধানের মধ্যেই প্রকৃত মানবকল্যাণ নিহিত। তবে হ্যাঁ, দেশের মানুষের স্বার্থ সবার আগে, আবার এটাও ঠিক নিজের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে অন্যকে বিপদাপন্ন করাও অনুচিত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশাল ছায়া আজ ক্রমশই বিস্তারিত হচ্ছে। দেশ ছাড়িয়ে বিশ্বকে শান্তির সুবাতাস বিলাচ্ছে। তাঁর ত্যাগব্রতী কন্যা শেখ হাসিনা সকল বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে প্রাজ্ঞ মানবিক আলো ছড়াচ্ছেন। এই আলো ক্রমশই দেশ ছাড়িয়ে বিশে^র মানুষকে করছে আলোকিত যা বাঙালির শ্লাঘার বিষয়।
 
লেখক: পরিচালক, পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ও সহ-সভাপতি, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

এমবি//


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি