ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪

শেখ হাসিনা: দুর্গম পথযাত্রী

নাসির উদ্দীন ইউসুফ

প্রকাশিত : ০৯:৫১, ২৮ অক্টোবর ২০২০

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা সম্পর্কে এই স্বল্প পরিসরের নিবন্ধে বিশেষ কিছু লেখা সম্ভব নয়। তার দীর্ঘ ৪০ বছরের রাজনৈতিক জীবনের বিচিত্র ঘটনাবলি, সাহসিকতা ও সাফল্য একটি গবেষণাধর্মী গ্রন্থের দাবি রাখে। তিনি যে ভগ্ন অবস্থা থেকে বাংলাদেশকে একটি উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তর করেছেন সেটা নিয়েও বিভিন্ন গ্রন্থ রচনার দাবি রাখে। শেখ হাসিনা এমন এক সময় বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন সেটা ছিল কৃষ্ণপক্ষ। 

১৫ আগস্ট ১৯৭৫, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর বাংলাদেশ রাষ্ট্র মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে যেভাবে বিচ্যুত হয়েছিল, সেটা আজকের দিনে বসে ভাবাও যায় না। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ দৈবাৎ বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। তারপর শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার এক অনির্দিষ্ট জীবন। অনেকটা শরণার্থী জীবন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর গুণমুগ্ধ শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী দু’বোনকে দিল্লিতে আশ্রয় দেন। 
ইন্দিরা গান্ধী কন্যার মতো তাদের দু’বোনকে বুকে তুলে নিয়েছিলেন। কিন্তু তারপরও আমাদের বুঝতে হবে সেটা হচ্ছে পরবাস। সেটি ৩২ নম্বরের প্রিয় গৃহ নয়। স্নেহ নীড় নয়। সেটি বেগম ফজিলাতুন্নেছার মাতৃকোল নয়। সেটি পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের বিশাল হৃদয়ের বক্ষ নয়। পরবাসে সম্মান ছিল, আদর ছিল। কিন্তু সব থেকেও আবার কিছুই ছিল না।

সেই শূন্যতা থেকে যাত্রা শুরু মানুষ দুজনের। ছোট বোন শেখ রেহানা লন্ডনে, বড় বোন শেখ হাসিনা ভারতের দিল্লিতে। জীবনের দাবিতে দু’বোন দুই ভিন্ন দেশে প্রবাস জীবনযাপন শুরু করেন। সেটা ভিন্ন একটা অসহনীয় সংগ্রাম বটে। মানুষের জীবনে এই রকম সংগ্রাম সচরাচর হয় না। একদিকে বিদেশ বিভুঁইয়ে আশ্রয়, অন্যদিকে সন্তানদের মানুষ করা। আরেকদিকে রয়েছে তার রাজনীতি এবং পিতৃহত্যার বিচার। এসব কিছু মিলিয়ে তাদের জন্য যখন একটি জটিল সময় উপস্থিত হয়েছিল। কিন্তু আমরা কি অবাক হয়ে লক্ষ করি ধীর-সুস্থির তারা, স্থিত হয়ে তাদের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সচেষ্ট হন। প্রবাস জীবনের কষ্ট, হত্যাকারীদের দুই বোনকে হত্যার ষড়যন্ত্র এই সকল কিছুকে মাথায় নিয়ে তারা পথ হাঁটছিলেন। 

শেখ হাসিনার সম্বল তার পিতার জীবনের শক্তি ও সাহস এবং প্রজ্ঞা। শেখ হাসিনা তার জীবনের শ্রেষ্ঠধন ছোট বোন শেখ রেহানার সাথে পরামর্শ করে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন দেশে ফিরে আসবেন। সেটি একটি দুঃসাহসী সিদ্ধান্ত। কেননা তখন বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা রাজনীতি, সমাজ, ব্যবসা সকল কিছুতেই অধিষ্ঠ। ’৭১-এর পরাজিতরা তখন রাষ্ট্র ক্ষমতার অংশীদার। বঙ্গবন্ধু হত্যাকারী ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত যুদ্ধাপরাধীরা তখন রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। সে এক অসম্ভব সময়, দেশে গণতন্ত্র নেই, ধর্মনিরপেক্ষতা নেই। সংবিধান থেকে চার মূলনীতি গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ উৎপাতিত। এবং জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের নামটি সংবিধান থেকে মুছে দিয়েছিল। একটি নির্দিষ্ট ধর্মকে সংবিধানের প্রধান নিয়ন্ত্রক করা হয়েছিল। সেই রকম একটি দুঃসময়ের ১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনা স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করলেন। তারপর থেকে শুরু হলো তার এক নতুন জীবন। শেখ হাসিনার জন্য বিপদসংকুল জীবন আর বাঙালি জাতির জন্য আশাবাদী জীবন।

দেশে ফিরে এসে তিনি তার পিতার প্রাণপ্রিয় সংগঠন আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠিত করার কাজে হাত দিলেন। পাশাপাশি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন শুরু করলেন। তার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনায় রাষ্ট্রের চার মূলনীতি প্রতিষ্ঠা করে তিনি বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশে রূপান্তর করার প্রত্যয় ঘোষণা করলেন। তারপর আমরা দেখেছি কি এক কঠিন দুর্গম পথ তাকে পাড়ি দিতে হয়েছে। কিন্তু তিনি থেমে থাকেননি, থমকে যাননি। তিনি জানতেন বাংলার মানুষ তার পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে যে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার আসনে বসিয়েছিল সেটা ক্ষণিকের জন্য হয়তোবা দৃশ্যমানতার বাইরে যেতে পারে। কিন্তু সেটি চিরদিনের জন্য মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায়, স্মৃতিতে ও চেতনায় স্থাপিত রয়েছে। এখন শুধু তাকে আবিষ্কার করার পালা এবং সেই কাজটি তিনি করেছেন। 

ছাত্রদের সংগঠিত করেছেন, কৃষকদের সংগঠিত করেছেন, রাজনৈতিক কর্মীদের সংগঠিত করেছেন, বুদ্ধিজীবীদের সংগঠিত করেছেন, সংস্কৃতি কর্মীদের সংগঠিত করেছেন, নারীদের সংগঠিত করেছেন। এসব কিছু মিলিয়ে তিনি জনগণের যে আস্থা অর্জন করেছেন তার শক্তিতে যে সংগ্রাম সূচনা করেন সেই সংগ্রাম হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তিকে বাংলার মাটি থেকে চিরদিনের জন্য উচ্ছেদ করা। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা, স্বৈরাচারের পতন ঘটানো। ধর্মান্ধ মৌলবাদী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে তার অনমনীয় মনোভাব বাংলাদেশ এবং বিশ্বকে বিস্মিত করেছে। এটি একটি চমৎকার উদাহরণ হতে পারে ১৯৮১ থেকে ২০২০ সাল, ৪০ বছর নিরন্তর মৃত্যু ফাঁদের মধ্য দিয়ে তিনি নির্ভীক পথে চলেছেন।

নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়ে তিনি ’৯২-তে জাহানারা ইমামের আহ্বানে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গণ-আদালতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তার প্রতিশ্রুত প্রতিটি কথা তিনি রেখেছিলেন। আমাদের সেই সংগ্রামী দিনগুলোর কথা মনে করলে যে দুজন মানুষের চেহারা আমাদের সামনে সবচেয়ে বেশি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, তারা হচ্ছেন- কবি বেগম সুফিয়া কামাল এবং শেখ হাসিনা। এই দুজন শহিদ জননী জাহানারা ইমামকে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা দিয়েছেন এবং সর্বতো সাহায্য করেছেন। যার মধ্য দিয়ে গণ-আদালতের মতো একটি ঐতিহাসিক আদালত গঠন সম্ভব হয়। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ২৬ মার্চ ১৯৯২ আমরা যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে মৃত্যুদ-তুল্য একটি অপরাধের জন্য শনাক্ত করতে পেরেছিলাম। 

সেই আদালত থেকে সরকারকে আহ্বান জানিয়েছিল গোলাম আযমসহ সকল যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের বিচার করতে হবে। কিন্তু তখন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত জাতীয়তাবাদী শক্তি যুদ্ধাপরাধীর বিচার না করে উল্টো গণ-আদালতের সংগঠকদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। শেখ হাসিনা এর প্রতিবাদে সারাদেশে সরকার প্রতিরোধের ডাক দেন। যুদ্ধাপরাধীদের কৃতকর্ম নিরূপণে যে কমিশন হয় সেখানেও শেখ হাসিনার একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। আমরা যখন সারা বাংলাদেশ ঘুরে বেড়িয়েছি ‘ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’র পক্ষ থেকে। তখন আমরা দেখেছি কীভাবে তিনি প্রতিটি জেলা-উপজেলায় আমাদের পক্ষে সংগঠিত করেছেন আওয়ামী লীগকে এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দলগুলোকে। 

গণ-আদালতের প্রতি তার প্রশ্নহীন শর্তহীন সমর্থন ছিল। তিনি জানতেন এটিকে তিনি ক্ষমতার জন্য ব্যবহার করবেন না। এই আদালত মানবতার ইতিহাসে বাঙালির ভূমিকাকে উজ্জ্বল করবে। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এই গণ-আদালত একটি বড় ভূমিকা পালন করবে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এবং মানব মুক্তির আন্দোলনের যে সংগ্রাম পৃথিবীব্যাপী চলছে সেখানে আমাদের গণ-আদালত একটি বড় অনুঘটক হিসেবে কাজ করবে। একটি অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে। এটি শেখ হাসিনা বুঝেছিলেন এবং বুঝেছিলেন বলেই তিনি সমর্থন দিয়েছিলেন।

তারপর দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য জনগণ কর্তৃক ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়। দীর্ঘ ২১ বছর পর বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকারী শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। ২১ বছরের সেনাশাসন স্বৈরশাসন, অপশাসনে বিপর্যস্ত বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক এবং জনগণের কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে পরিণত করার ক্ষেত্রে তিনি মহাচ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন। একদিকে প্রশাসনে পাকিস্তানের ভূত। অন্যদিকে ভঙ্গুর অর্থনীতি ও আইন-শৃঙ্খলার বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি, বিচারহীনতা সব মিলিয়ে বিপর্যস্ত বাংলাদেশ। শেখ হাসিনা ভীত হলেন না। 

বরঞ্চ উদ্যমী হলেন মৃতপ্রায় বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে পুনরুজ্জীবিত করতে। অর্থনৈতিক সংস্কারের কর্মে হাত দিলেন প্রথমে। একইসাথে বিচার ব্যবস্থা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা আনায় সচেষ্ট হলেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শিক্ষা কার্যক্রমকে পাল্টিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শিক্ষা কার্যক্রম পুনরায় চালু করলেন। ২১ বছরের জঞ্জাল সরিয়ে ব্যর্থ প্রায় রাষ্ট্র বাংলাদেশকে সাফল্যের মহাসড়কে উঠিয়ে এনে সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচন করলেন। জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার বিচার কার্যক্রম শুরু করার উদ্যোগ নিলেন। তাকে অনেকে পরামর্শ দিলেন বঙ্গবন্ধু-হত্যার বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে। তিনি তা নাকচ করে দিলেন। এবং সাধারণ আদালতে প্রচলিত আইনি প্রক্রিয়ায় তিনি তার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শাহাদাতবরণকারী পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডের বিচার কার্যক্রম শুরু করার পদক্ষেপ নিলেন।

আইনের শাসনের প্রতি এবং সংবিধান সৃষ্ট বিচার প্রক্রিয়ার প্রতি তার অবিচল আস্থা ও আনুগত্য ইতিহাসে উদাহরণ হয়ে থাকবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য প্রস্তুতি তিনি গ্রহণ করলেন। সংস্কৃতি চর্চার জন্য সারাদেশে নতুন পরিসর সৃষ্টির উদ্যোগ গ্রহণ করলেন। কৃষি ও শিল্প-কলকারখানায় উৎপাদন সৃষ্টিতে উদ্যোগী হলেন। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্র নতুন করে সচল হলো। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা বসে ছিল না। প্রশাসনসহ রাষ্ট্র এবং সমাজের সর্বত্র যুদ্ধাপরাধী ও বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের ব্যাপক অবস্থান শেখ হাসিনার দুর্গম পথ চলাকে স্তব্ধ করে দিতে চাইছে। বারংবার তার ওপর, তার জীবনের ওপর হামলা হয়েছে। তিনি বেঁচে গেছেন। নির্ভীক হাসিনা তার লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য অবিচল থাকলেন। ভীতসন্ত্রস্ত ষড়যন্ত্রকারীরা প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে ২০০১-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে পরাজিত করে। সে এক মহাষড়যন্ত্রের ইতিহাস। দেশে নেমে এলো কৃষ্ণপক্ষ। বিশৃঙ্খলা, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, প্রশাসনকে দলীয়করণ ইত্যাদির মাধ্যমে দেশে সৃষ্টি হলো নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি। 
জীবনের ওপর হুমকি নিয়ে শেখ হাসিনা বেরিয়ে পড়লেন বাংলাদেশের ৬৪ হাজার গ্রামে। দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সংগঠিত করতে লাগলেন জনগণকে। এর মাঝে ঘটে গেল ২১ আগস্টের ভয়াল সেই হত্যাকাণ্ড। সরকারে অধিষ্ঠিত জাতীয়তাবাদী দল ও ধর্মান্ধ জঙ্গিগোষ্ঠীর যৌথ ‘শেখ হাসিনা হত্যা মিশন’ পরিচালিত হলো ২১ আগস্ট। ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে শেখ হাসিনার সভা চলাকালে মুহুর্মুহু গ্রেনেড ও গুলির আক্রমণে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় মানুষের শরীর। ২২ জন সাধারণ মানুষ নিহত হয়। ২০০-র বেশি মানুষ আহত হয়ে পঙ্গুত্ববরণ করেন। হত্যাকারীদের মূল লক্ষ্য শেখ হাসিনা দৈবক্রমে বেঁচে যান। এই বেঁচে যাওয়ায় যেন-বা নতুন জীবন সিদ্ধি। এ যেন পুরাণের ‘কাকুনুস পংখী’ আগুন ও ভস্ম থেকে যার জন্ম হয় পুনঃপুন।

অসংখ্য হত্যা আক্রমণকে ব্যর্থ করে দিয়ে শেখ হাসিনা এমনভাবে পুরো জাতিকে সংগঠিত করলেন যে ২০০৮ সালের নির্বাচনে তিনি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে পুনরায় রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। ১৯৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যেমন জনগণ বাংলাদেশের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পাকিস্তানের শেষ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রদান করেছিল। তেমনিভাবে ২০০৮ সালের নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ শেখ হাসিনাকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আধুনিক উন্নয়নশীল বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য নিরঙ্কুশ ক্ষমতা প্রদান করেন।

আমরা পেলাম এক নতুন শেখ হাসিনাকে। গত এক দশকে বঙ্গবন্ধু-হত্যার বিচার সম্পন্ন করলেন। যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের বিচারের লক্ষ্যে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করেছেন। যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে জামাত আদালত কর্তৃক নিষিদ্ধ হয়েছে। ’৭২-এর সংবিধানকে সংবিধানের পুনঃস্থাপিত করেছেন। কিন্তু সেনা ও স্বৈরশাসক কর্তৃক সংবিধানের যে দুটি ক্ষত সৃষ্টি করেছিল। সেই দুটি ক্ষত এখন পর্যন্ত বিমোচন করা সম্ভব হয়নি। নিশ্চয়ই শেখ হাসিনা সেই ক্ষত সারিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় রচিত ১৯৭২-এর সংবিধান পূর্ণাঙ্গরূপে জাতিকে উপহার দেবেন। এই দশকে শেখ হাসিনা দেশের অবকাঠামো ও তথ্যপ্রযুক্তির বিস্ময়কর উন্নয়ন ঘটিয়েছেন। রাস্তাঘাট, ব্রিজ নির্মাণ থেকে শুরু করে সকল রকম অবকাঠামোগত উন্নয়নের রেকর্ড তিনি করেছেন। ফসল উৎপাদনে বিল্পব ঘটিয়েছেন। 

৭ কোটি মানুষের দেশে যখন মঙ্গা-দুর্ভিক্ষ অবস্থা ছিল। সেই বাংলাদেশে আজকে ১৬ কোটি মানুষ তিন বেলা খেয়ে-পরে উদ্বৃত্ত ফসলের বিনিময়মূল্যে শৌখিনতা উপভোগ করছেন। প্রাথমিক শিক্ষা ও নারী শিক্ষায় তিনি যে কর্মপরিকল্পনা নিয়েছেন তা যুগান্তকারী। নারীদের স্নাতক পর্যন্ত অবৈতনিক করেছেন। প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক করেছেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতি বছর ৩৪ কোটি বই পহেলা জানুয়ারি বিনামূল্যে ছাত্রদের মধ্যে বিতরণ করা হয়, যা বিশ্ববাসীকে বিস্মিত করেছে। জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করেছেন। গ্রামে গ্রামে স্বাস্থ্য কেন্দ্র নির্মাণ করে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করেছেন। মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, বয়স্ক ভাতা ও বিধবা ভাতার ব্যবস্থা করেছেন। বীরাঙ্গনাদের সম্মানের সাথে সমাজে প্রতিষ্ঠা করেছেন।

আজ বাংলাদেশের গড় আয়ু ৭১ বছর। জাতিসংঘ কর্তৃক নির্ধারিত উন্নয়নের ৫টি সূচকে আজ বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার সকল দেশ থেকে এগিয়ে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্বপ্নের পদ্মাসেতু প্রায় সম্পন্ন হওয়ার পথে। রাজধানী ঢাকাকে ঘিরে মেট্রোরেল ও এক্সপ্রেস-এর কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে নিচ্ছেন। বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল।

অবকাঠামোগত উন্নয়নে এবং মানব উন্নয়নে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ যে অবারিত সাফল্য দেখিয়েছে তা এক কথায় বিশ্বনন্দিত। জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় তার সাহসিকতা সারাবিশ্বে প্রশংসিত। কিন্তু মাদ্রাসা শিক্ষা অনিয়ন্ত্রিত থাকার কারণে জঙ্গিবাদ মৌলবাদের হুমকি বাংলাদেশে থেকেই যাচ্ছি। কেননা প্রতিদিন পবিত্র ধর্মগ্রন্থের নানারকম অপব্যবহারের মাধ্যমে তরুণদের বিভ্রান্ত করছে। এই নিষ্পাপ তরুণরা জঙ্গিবাদকে তাদের একমাত্র করণীয় বলে মনে করছে। তাই একমুখী শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে জাতিকে সমূহবিপদ থেকে রক্ষা করা এখনও সম্ভব। বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভাষা, সংস্কৃতি, সমাজ, ধর্ম সকল কিছু একটি শিক্ষা পাঠ্যক্রমের আওতায় এনে, ওই শিক্ষা পদ্ধতিতে পরিচালিত করাই আজকের দিনে দাবি। এটা একমাত্র বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার পক্ষেই সম্ভব।

ধর্ম বাদ দেওয়ার কথা হচ্ছে না। ধর্মকে রেখেই এসব কথা হচ্ছে। সকল ধর্মের সম-অধিকার থাকবে এই দেশে। অর্থাৎ সকল ধর্মের শিক্ষার নিশ্চয়তা আমাদের স্কুলগুলোতে আমাদের শ্রেণিকক্ষে থাকতে হবে। সেই দাবিটি অন্তত শেখ হাসিনার কাছে তার জন্মদিনে করতে পারি।

আর আমাদের দেশে যেই ব্যাধিটা রয়েছে, সেই ব্যাধিটা আমরা সবাই জানি। সেটা হচ্ছে দুর্নীতি। সেই দুর্নীতি থেকে আমরা মুক্ত হতে পারেনি। সুতরাং উন্নয়নের যে জোয়ার উঠেছে, সেই জোয়ারে ওই দুর্নীতি একটি বড় বাধা হিসেবে দাঁড়িয়েছে। এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র রয়েছে এর পেছনে। যেমন ’৭৪-৭৫ সালে এই দেশে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র এবং দেশীয় ষড়যন্ত্রের কারণে আমরা জাতির পিতাকে হারিয়েছি। ঠিক তেমনি করে এখনও সেই ষড়যন্ত্র রয়েছে। বৃহৎ শক্তিগুলো বাংলাদেশের দিকে তার চোখ নিবন্ধ করেছে। কেননা এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ জনগোষ্ঠী এবং ভৌগোলিক অবস্থানে রয়েছে। এবং এর রাষ্ট্রক্ষমতায় এমন এক নারী রয়েছেন যিনি পৃথিবীর যে কোনো বিশ্বনেতার সমকক্ষ। প্রজ্ঞায়, জ্ঞানে, ভবিষ্যৎদ্রষ্টা হিসেবে তিনি এক অভূতপূর্ব নজির তৈরি করেছেন। তারা জানেন যে এই মানুষটি যেভাবে বিশ্ব নেতায় পরিণত হচ্ছেন, তাতে করে স্বার্থন্বেষী মহলসমূহের অস্বস্তির সৃষ্টি হচ্ছে। তাই শেখ হাসিনার জীবনের হুমকি রয়েই যাচ্ছে।

কিন্তু আমরা জানি যে শেখ হাসিনা সকল ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে, সকল বাধা অতিক্রম করবেন। নিশ্চিতভাবে এই রাষ্ট্রটিকে এমন একটি রাষ্ট্রে পরিণত করবেন যে রাষ্ট্রটি ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে সংগতিপূর্ণ। যে রাষ্ট্রটি স্বপ্ন তার পিতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেখেছিলেন।

আমরা একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক মানুষের সম-অধিকারের এবং বাঙালি সংস্কৃতির আবহে দুর্নীতিমুক্ত একটি সমাজ এবং রাষ্ট্র চাই। এবং সেটি শেখ হাসিনার জীবনদশায় তার নেতৃত্বেই প্রতিষ্ঠা করতে চাই।

শেখ হাসিনা দীর্ঘজীবী হোক। বাংলাদেশ দীর্ঘজীবী হোক।

জয় বাংলা

জয় বঙ্গবন্ধু।

লেখক: সংস্কৃতিজন

সূত্রঃ উত্তরণ (বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মুখপত্র)

এমবি//


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি