ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৮ মার্চ ২০২৪

শেখ হাসিনার ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য : একটি আপাত পর্যবেক্ষণ

অধ্যাপক ড. মোঃ শামসুদ্দীন ইলিয়াস

প্রকাশিত : ০৮:৪৭, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ | আপডেট: ১৬:০৮, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০

শালুক-শাপলার স্নিগ্ধতায় ভরা, নদী-খাল-বিল বিধৌত ধানক্ষেতের ঢেউ তোলা হাওয়া, আর ছায়াঘেরা সবুজ গ্রাম টুঙ্গীপাড়ায় জন্ম নেয়া ছোট্ট শিশু হাসু’র পুতুল খেলার সময়গুলো কেটেছে মাটি ও মানুষের নিবিড় সান্নিধ্যে। দাদা-দাদী আর বাবা-মা’র হাত ধরে ঘুরে বেড়ানো, গ্রামের ছেলেমেয়েদের সাথে ক্ষেতের আইল ধরে স্কুলে যাওয়া-আসা, খেলাধুলা করা, আর সাতার কাটা- এগুলো ছিলো তার নিত্য সঙ্গী। দাদা-দাদি, বাবা-মায়ের একান্ত আদরে বেড়ে ওঠা ছোট্ট মেয়েটি শৈশব না পেরোতেই তার অতি প্রিয় গ্রাম, স্কুল, খেলার সাথী, আপনজন এবং চিরচেনা পরিবেশ ছেড়ে পাড়ি জমালো ঢাকা শহরে, মায়ের হাত ধরে। ভর্তি হলো আজিমপুর গার্লস হাইস্কুলে। 

এখান থেকে মাধ্যমিক শেষ করে ঐতিয্যবাহী ইডেন কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক; অতপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙলা ভাষা ও সাহিত্য’ বিভাগে প্রথম বর্ষ অনার্সে ভর্তি। অনার্স ফাইনাল পরীক্ষার আগেই বরমাল্য। বিয়ে হয়ে গেল মেধাবী বিজ্ঞানী ওয়াজেদ মিয়ার সাথে। স্বামী, সন্তান ও সংসার সামলেও অবশেষে পাস করলেন স্নাতক ডিগ্রি। ভর্তি হলেন মাস্টার্সে- কিন্তু উচ্চশিক্ষার্থে স্বামীর বিদেশ গমন এবং বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকান্ড পরবর্তী বৈরী পরিবেশের কারণে শেষ করা সম্ভব হলোনা তাঁর কাঙ্ক্ষিত মাস্টার্স ডিগ্রি। এ আক্ষেপ তাঁর রয়েছে নিশ্চয়ই, এখনো।

সেদিনের শিশু শেখ হাসিনা স্বাভাবিকভাবেই জন্মের পর থেকে তাঁর পারিবারিক পরিমন্ডলের ভেতরে বেড়ে ওঠেছে। পরিবারের সদস্যদের সাথে তাঁর সার্বক্ষণিক মিথস্ক্রিয়া, প্রতিবেশী ও আত্মীয়-সজনের সাথে মিথস্ক্রিয়া, শৈশব-কৈশোরে খেলার সাথী ও স্কুলের সহপাঠিদের সাথে মিথস্ক্রিয়ার ভেতর দিয়ে তাঁর নানামুখী বিকাশ তরান্বিত হয়েছে। খাদ্য, বাসস্থান ও নিরাপত্তা প্রদানের মধ্য দিয়ে পরিবার শিশু হাসিনার শারীরিক ও মানসিক তথা বুদ্ধিগত বিকাশে বিশেষ অবদান রেখেছে। পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশ, বিদ্যালয় এবং নানামুখী মিথস্ক্রিয়ার প্রকৃতি সমষ্টিগতভাবে নির্ধারন করেছে তাঁর সামাজিক বিকাশ, আবেগমূলক বিকাশ, এবং নৈতিক বিকাশের ধারা। বিদ্যালয় এক্ষেত্রে পালন করেছে অনুঘটকের ভূমিকা। সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক পরিবেশে এবং পরিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিমন্ডলের মধ্যে বেড়ে ওঠেছে বলেই তাঁর মধ্যে সংঘটিত হয়েছে প্রত্যাশিত নানামুখী বিকাশ।

যে কোন মানুষের শিক্ষাজীবন পূর্ণতা পায় পারিবারিক ও সামাজিক পর্যায়ে যথাযথভাবে সংঘটিত ইন-ফরমাল ও নন-ফরমাল শিক্ষা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক ফরমাল শিক্ষা লাভের ভেতর দিয়ে। বিদ্যালয়কেন্দ্রিক শিক্ষা জ্ঞানের আলোকরশ্মির সন্ধান দেয়। অন্যদিকে, বাস্তব জীবন থেকে দেখে, শুনে, ঠেকে শেখা অর্থাৎ অপ্রাতিষ্ঠানিক এই শিক্ষাই মানুষকে করে সমৃদ্ধ, দেয় পূর্ণতা। অনুশীলনের মাধ্যমে আচরণের পরিবর্তনকে শিক্ষণ বলা হলেও সব শিক্ষণই শিক্ষা নয়; শিক্ষা হতে হলে পরিবর্তনটি ধনাত্মক হতে হয়। শেখ হাসিনার ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্যে আচরণের ধনাত্মক পরিবর্তন তথা শিক্ষার প্রভাব সুস্পষ্টভাবেই লক্ষণীয়।

ছোট বেলায় গ্রামীণ পরিবেশে সামাজিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দেখা এবং পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশে বিভিন্ন বয়সী এবং বিভিন্ন ধরণের মানুষের সাথে মেলামেশা ও মিথস্ক্রিয়ার সুযোগ পেয়েছেন শেখ হাসিনা। ঢাকায় লেখাপড়া ও অবস্থানের সুবাদে এবং পারিবারিক বৃহৎ রাজনৈতিক পরিমন্ডলের কারণে বিভিন্ন বয়সের ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সাথে মেলামেশা ও জানাশোনার সুযোগ তাঁর হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর সামাজিক-রাজনৈতিক জীবন ও শাসন আমলে বহু দেশি-বিদেশি মানুষের সান্নিধ্যে আসা এবং তাদের সাথে আলাপচারিতার সুযোগ শেখ হাসিনা পেয়েছেন। 

পরবর্তীতে স্বামী ডঃ ওয়াজেদ মিঞার সাথে বিদেশে অবস্থান কালে তাদেরকে বাস করতে হয়েছে ভিন্ন সাংস্কৃতিক বলয়ে। বিদেশীদের সাথে মেলামেশা ও মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পেয়েছেন আন্ত-সাংস্কৃতিক ভেদাভেদ। এছাড়া ’৭৫-ট্রাজেডি পরবর্তী সময়ে তাঁকে চলতে হয়েছে নানামুখি ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে; সম্মুখীন হয়েছেন বিরুপ পরিস্থিতির, সঞ্চয় করেছেন বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা। তাই তাঁর সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়াটি পেয়েছে দৃঢ় ভিত্তি, তিনি হয়েছেন অনেক বেশি সমৃদ্ধ।

একজন ব্যক্তির সামগ্রিকতাই তাঁর ব্যক্তিত্ব। সাধারণ ভাবে ব্যক্তিত্বকে অর্ন্তমুখি ও বর্হিমুখি- এ দু’ভাগে ভাগ করা যায়। শেখ হাসিনার ব্যক্তিত্বে বহির্মুখিনতার প্রভাব অনেক বেশি মাত্রায় লক্ষ্যনীয় । তিনি মানুষের সাথে মিশতে, আলাপচারিতায় মেতে থাকতে পছন্দ করেন; তিনি যা চিন্তা করেন, যা বিশ্বাস করেন, অকপটে তা বলতে দ্বিধা করেন না। এ জাতীয় বৈশিষ্ট্যের অধিকারী মানুষ আত্মপ্রেমে মগ্ন থাকেনা, বরং সহমর্মিতা, সহযোগিতা, মমত্ববোধ, এবং অন্যের বিপদে কাতর হয়ে পাশে দাড়ানোর ইচ্ছা ও প্রচেষ্টায় লিপ্ত থাকে- যা শেখ হাসিনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভাবে দেখা যায়।

আমাদের ইন্দ্রিয়সমূহের মাধ্যমে আমরা প্রতিনিয়ত অজস্র সংবেদন গ্রহণ করি; সংবেদন কখনো অর্থবহ মনে হয়, আবার কখনো কোনো সংবেদন কোনই অর্থ বহন করে না। অর্থবহ সংবেদনকে প্রত্যক্ষণ বলা হয়ে থাকে। পর্যবেক্ষণ ও প্রত্যক্ষণ হতে প্রাপ্ত তথ্যসমূহকে যত সিস্টেমেটিক ভাবে কাজে লাগানো যাবে, তা তত বেশি সুফল বয়ে আনবে। একজন সফল রাজনীতিক বা নীতি নির্ধারকের জন্য ব্যক্তি প্রত্যক্ষণ এবং সমাজ প্রত্যক্ষণ এ দু’টি বিষয়ই অতি প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসাবে বিবেচিত হয়। ব্যক্তি শেখ হাসিনা এবং রাজনৈতিক নেত্রী শেখ হাসিনার মধ্যে ব্যক্তি এবং সমাজ এই দু’টি উপাদান যথাযথ ভাবে পর্যবেক্ষণ ও প্রত্যক্ষণের ক্ষমতা যথেষ্ট মাত্রায় রয়েছে বলেই মনে হয়।

বঙ্গবন্ধু একজন বুদ্ধিমান রাজনৈতিক নেতা ছিলেন, পরিবার ও দেশের জন্য তাঁর ভালোবাসা ছিলো আবেগঘন, নিঃস্বার্থ ও আন্তরিক। বঙ্গবন্ধুর রক্তের এবং রাজনৈতিক উত্তরাধিকার হিসাবে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা উত্তরাধিকার সূত্রেই বুদ্ধিদীপ্ত ও আবেগী। তবে, নিজের এবং অন্যের আবেগ যথাযথভাবে অনুধাবন করতে পারা এবং প্রয়োজনীয় মুহূর্তে আবেগের ওপর কার্যকর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করার ক্ষমতা অর্জন করা একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। জননেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বুদ্ধিমত্তা এবং দীর্ঘ রাজনৈতিক পরিক্রমায় অম্ল-মধুর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে অর্জিত পরিপক্কতাকে কাজে লাগিয়ে প্রয়োজনীয় মুহূর্তে আবেগ নিয়ন্ত্রণ এবং আবেগকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার পারদর্শিতা দেখিয়ে চলেছেন- যা তাঁকে সাবলীল ভাবেই তুলে দিয়েছে অনন্য উচ্চতায়।

একজন ব্যক্তি, একজন প্রতিষ্ঠান প্রধান অথবা একজন রাষ্ট্রনায়কের সফলতা অনেকাংশেই নির্ভর করে কাজের ক্ষেত্রে যথাযথ পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তাঁর সততা, আন্তরিকতা, স্বচ্ছতা, সঠিক কর্মযোগ, যথাযথ মনিটরিং, প্রযোজ্য ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সর্বোপরি তাঁর মনোবলের দৃঢ়তার ওপর। চার যুগ ধরে দেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল- বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ-এর সফল নেতৃত্বদান এবং চার মেয়াদে দেশের প্রধান মন্ত্রী হিসাবে সফল ভাবে দেশ পরিচালনায় জননেত্রী শেখ হাসিনা যে সক্ষমতা ও দৃঢ়তার স্বাক্ষর রেখেছেন, পৃথিবীর ইতিহাসে তা এক বিরল ঘটনা।

ক্ষমা করা মহানুভবতার লক্ষণ। তবে কোন্ অপরাধে, কবে, কখন, কাকে, কেন ক্ষমা করেছেন তা মনে রাখা জরুরী। কারণ ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণ এবং দল ও দেশ পরিচালনার জন্য তা অতীব গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসাবে কাজ করে। বঙ্গবন্ধুর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের উত্তরাধিকারী জননেত্রী শেখ হাসিনা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নেতা-কর্মীকে দেখলেই যেমন তাদের নাম-ঠিকানা বলে দিতে পারেন; ঠিক তেমনি তাদের সাথে কবে, কোথায় সাক্ষাত হয়েছে তাও বলে দিতে পারেন অবলীলায়। কোন্ পরিস্থিতিতে, কোন্ কৌশলের অংশ হিসাবে কাকে, কখন ক্ষমা করেছেন- তাও স্মরণে রাখেন নির্ভুল ভাবে। জননেত্রী শেখ হাসিনার এটা একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য- যা তাঁকে দল ও সরকার পরিচালনায় সহায়তা করছে ভীষণভাবে।

নিজের ওপর আস্থা ও বিশ্বাস একদিকে যেমন মনোবল বৃদ্ধি করে, অন্যদিকে কাজ করার শক্তি ও সাহস অনেকগুণ বাড়িয়ে দেয়। আস্থা বাড়ানোর ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পর্যাপ্ত তথ্য রপ্ত করার কোনো বিকল্প নাই। যে কোন অফিসিয়াল বা রাজনৈতিক সভায় বা মিডিয়া সাক্ষাতকারে শেখ হাসিনার বক্তব্য শুনলে যে কেউ তাঁর তথ্যের প্রাচুর্যতা, পারদর্শিতা এবং নিজের ওপর আস্থা বিষয়ে বিমোহিত না হয়ে পারবেন না। তাঁর এই আত্মপ্রত্যয়ী বৈশিষ্ট্যের অনেকটাই নিজ গুণে ও প্রচেষ্টায় অর্জিত।

বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্যাবলী নিয়ে বিস্তারিত ও পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা এই স্বল্প পরিসরে সম্ভব নয়। তাই অতি সংক্ষেপে কিছু দিক নিয়ে আলোকপাত করা হলো। মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত জাতীয় চার মূলনীতি এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধের বাতিঘর, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাঙলা বিনির্মাণে বাঙালির আশা-আকাক্সখার ঠিকানা মহান নেত্রী বেঁচে থাকুন, সুস্থ থাকুন, দীর্ঘায়ু হোন। একটি উন্নত সমৃদ্ধ কল্যাণ রাস্ট্র বিনির্মাণে আপনার ক্লান্তিহীন প্রচেষ্টা সফল হোক। ৭৪তম জন্মদিনের শুভলগ্নে এই হোক প্রতিটি বাঙালির প্রত্যাশা ও শুভকামনা।

লেখক: অধ্যাপক, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।

এমবি//


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি