ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪

সমৃদ্ধ মানবিক সমাজ গড়ে তুলতে যা করণীয়

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ২০:২৩, ১১ এপ্রিল ২০২০ | আপডেট: ১৬:৩৫, ১২ এপ্রিল ২০২০

ইসলাম মানবকল্যাণ, ত্যাগ ও পরোপকারের ধর্ম। এ ধর্ম কখনো অন্যের চিন্তা বাদ দিয়ে শুধু নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকা সমর্থন করে না। ইসলাম চায় একে অন্যের সাহায্য-সহযোগিতার মধ্য দিয়ে গড়ে তুলতে একটি সমৃদ্ধ সমাজ। এজন্য এখানে রয়েছে ধনী-গরিবের জন্য নানা দায়িত্ব ও কর্তব্য। 

পবিত্র কুরআনুল কারিমের সুরা আল-ইমরানের ৯২নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তোমরা কখনোই কল্যাণ লাভ করতে পারবে না, যদি তোমাদের প্রিয় বস্তু থেকে তোমরা ব্যয় না করো। আর তোমরা যা কিছু ব্যয় করবে আল্লাহ তা জানেন।’ 

সূরা বালাদের ১০-১৯ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘ধর্মের দুর্গ হচ্ছে- দাসমুক্তি, দুর্ভিক্ষের দিনে অন্নদান, নিকটবর্তী এতিম বা ধূলিমলিন মিসকিন-অসহায়কে লালন ও বিশ্বাসীদের সাথে সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে পরস্পরকে সবর ও বিশ্বজনীন মমতায় উদ্বুদ্ধ করা। এরাই সফলকাম। আর যারা এ নির্দেশ অস্বীকার করে তারাই ব্যর্থ।’

উপরের উদ্ধৃতি থেকে দেখা যায়, এখানে বেশি করে দানের উপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। আসমানী বাণী শোনার পর প্রিয় বস্তু ব্যয় করার জন্য রাসূল (সা:)-এর সাহাবীরা ছিলেন উন্মুখ, উদ্বেল। তারা রীতিমতো ব্যস্ত হয়ে পড়তেন নিজেদের প্রিয়তম বস্তুটি খুঁজে বের করার জন্য। এরপর তা আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করার মানসে নবী (সা:)-এর খেদমতে হাজির হতেন। 

এ প্রেক্ষিতে একটা ঘটনা বলা যেতে পারে- মদিনার আনসারদের মধ্যে সর্বপেক্ষা ধনী ছিলেন সাহাবী আবু তালহা (রা:)। নবীজীর মসজিদসংলগ্ন বিপরীত দিকে তার বাগানে একটি মূল্যবান কূপ ছিল। অন্য দশজনের মতো মহানবী (সা:)ও মাঝে মধ্যে এ কূপের ধারে যেতেন এবং পানি পান করে মরু হাওয়ায় বিদগ্ধ ও তৃষ্ণার্ত প্রাণ শীতল করতেন। আজ দেড় হাজার বছরের ব্যবধানেও তা স্বনামে বিদ্যমান আছে। হজরত আবু তালহা (রা:)-এর এ বাগান ও কূপ অত্যন্ত উর্বর ও মূল্যবান। আর এটা ছিল তার সর্বাপেক্ষা প্রিয় সম্পত্তি। তিনি তা হুজুর (সা:)-এর দরবারে এসে জনসাধারণের জন্য উৎসর্গের ঘোষণা দেন (বুখারি, মুসিলম)। এতে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা:) সন্তোষ প্রকাশ করেন, শুকরিয়া করেন এবং তার জন্য প্রাণ খুলে দোয়া করেন।

ইসলাম ধর্মে গোপন দান, গোপন ইবাদত-বন্দেগিই অধিক পছন্দনীয় এবং আল্লাহ তায়ালার কাছে তা-ই কবুল হয়, যদি তা ব্যাপক মানবকল্যাণ ও মানবসেবার জন্য হয়ে থাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে দানের জন্য বলা হয়েছে এ জন্য যে, যার দেখাদেখি অন্যরা উৎসাহিত ও উদ্বুদ্ধ হয়। 

এ প্রসঙ্গে বুখারি ও মুসলিম-এ মহানবী (সা:)-এর উদ্ধৃতি দিয়ে একটি সুন্দর হাদিসও বর্ণিত হয়েছে- দু’ব্যক্তির কাজেই শুধু ঈর্ষা করা যায়। একজন ওই ব্যক্তি- যাকে আল্লাহ তায়ালা সম্পদ দান করেছেন। আর তাকে তা সৎ পথে ব্যয় করার সামর্থ্য দিয়েছেন। অপরজন হলেন- তিনি, যাকে আল্লাহ তায়ালা জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দান করেছেন এবং তিনি সে অনুযায়ী উদ্ভূত বিষয়াদির মীমাংসা করেন। আর এ জ্ঞান অন্যকে শিক্ষা দেন।

অর্থাৎ পরোপকারী ধনী ও জ্ঞানী ব্যক্তিকে হাদিসে ঈর্ষার পাত্ররূপে বর্ণনা করে তাদের আদর্শের অনুসরণে প্রত্যেককে ন্যায়বান, ধনী ও বিজ্ঞ হওয়ার জন্য উৎসাহিত করা হয়েছে। এছাড়া জ্ঞানার্জন ও ধনোপার্জনের উদ্দেশ্য ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি নয়, বরং জনগণ ও সমাজের কল্যাণ সাধন করা। 

আজ বিশ্বের চতুর্দিকে তাকালে যে নয়নাভিরাম কল্যাণধর্মী স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠান আমরা দেখি, তা তো কোনো না কোনো মানবদরদি মহানুভব ব্যক্তির মাধ্যমে সৃষ্ট। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর ফারুক (রা:) অসংখ্য মসজিদ, হাসপাতাল, সড়ক, সেতু ও বিদ্যালয় নির্মাণ করেন এবং সেচ সুবিধা, পানীয়জলের জন্য খাল খনন করেন। উমর (রা:) ও পরবর্তী ন্যায়পরায়ণ মুসলিম শাসকদের মতো আজো যদি আমাদের মধ্যে নিঃস্বার্থ জনসেবার অনুভূতি জাগ্রত হয় তাহলে গরিব, দুঃখী, অভাবী মানুষের দুঃখকষ্ট অনেকাংশে লাঘব হতে পারে। 

একদা মদিনায় পানিস্বল্পতার কারণে মুসলমানদের বেশ কষ্ট হয়। সেখানে রুমা নামে একটি কূপ ছিল, যা এক ইহুদির মালিকানায়। সে ব্যক্তি খুব চড়া দামে পানি বিক্রি করত। খলিফা ওসমান (রা:) কূপটি পঁয়ত্রিশ হাজার দিরহামে কিনে সকল মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দেন।

স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, মানবকল্যাণে পুরুষদের পাশাপাশি মুসলিম নারীদেরও অবদান রয়েছে। ইতিহাস থেকে আমরা জেনেছি, খলিফা হারুনুর রশীদের সহধর্মিণী সম্রাজ্ঞী মহীয়সী জুবায়দা হজব্রত পালনে মক্কায় আগত মুসলমানদের কষ্ট দূর করতে একটি খাল খনন করে পবিত্র মক্কা নগরী, মিনা ও আরাফাতে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করেন। এই খাল আজো ‘নহরে জুবায়দা’ নামে প্রসিদ্ধ। আমাদের এই বাংলায় হাজী মুহাম্মদ মুহসীন, নবাব ফয়জুননেসা ও বেগম রোকেয়ার ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও প্রাতিষ্ঠানিক জনহিতকর কাজ ও অবদান চিরভাস্বর হয়ে থাকবে।

আমরা দেখি যে, সাধারণত পরোপকার দু’ভাবে করা যায়। ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও প্রাতিষ্ঠানিক। জনকল্যাণে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কোনো কিছু করতে পারাই বড় কথা। যেমন- কেউ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করল, আর কেউ শুধু একজন রোগীকে সেবাদান করল। হাসপাতাল গড়াই শ্রেষ্ঠ, একজন রোগীর চিকিৎসার সাথে তার তুলনাই হয় না।

শরিয়তের পরিভাষায় এ ধরনের সাধারণ দানকে সদকায়ে জারিয়া বলা হয়। রাসূল (সা:) এরশাদ করেছেন- দু’টি জিনিস মানুষের উন্নতির উপকরণ। একটি হচ্ছে ‘উত্তম সন্তান’, অপরটি ‘সদকায়ে জারিয়া’।
তিনি আরো বলেন, যখন কোনো মানুষ মারা যায় তখন তার কাছে পূণ্য বা নেকী পৌঁছানোর সব মাধ্যম বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। শুধু তিনটি পথ তার জন্য খোলা থাকে। ১. সদকায়ে জারিয়া; ২. সত্যিকার জ্ঞানার্জনের কোনো প্রদীপ প্রজ্বলিত করে যাওয়া; ৩. অথবা কোনো নেক সন্তান তৈরি করে যাওয়া।

সুরা বাকারার ২৬৭ নং আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনগন! তোমরা যা অর্জন কর এবং জমিন তোমাদের জন্য যা উৎপাদন করে তা থেকে উৎকৃষ্ট কিছু সম্পদ দান কর। চোখ বন্ধ করে না থাকলে তোমরা নিজেরা গ্রহণ করতে না এমন মন্দ জিনিস দান করো না। জেনে রেখো, আল্লাহ অভাবমুক্ত ও পরম প্রশংসিত।’

তাই দানের ক্ষেত্রে অবশ্যই উৎকৃষ্ট এবং নিজের পছন্দের বস্তুটিই দান করতে হবে। নিজের জন্য যে বস্তুটি পছন্দ করবে সেটাই দানের জন্য পছন্দ করা চাই। নিকৃষ্ট বস্তু কীভাবে আল্লহর সামনে পেশ করবে? যা নিজেরই পছন্দ না সেটা আল্লহর জন্য পছন্দ করা কি শোভা পায়? তাই সম্পদের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট বস্তুটিই দানের জন্য পৃথক করা উচিৎ। তবেই সেটা হবে উত্তম দান। এবং আল্লাহ তায়ালার নিকট পছন্দনীয় দান। নয়ত দানের প্রকৃত নেকি অর্জন করা সম্ভব হবে কখনোই।

হাদিসে বলা হয়েছে, ‘মানুষের জন্য তুমি তা-ই পছন্দ করো, যা তুমি নিজের জন্য পছন্দ করে থাকো।’

এনএস/


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি