ঢাকা, বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪

১৫ আগস্ট: মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিনাসের দিন

মমতাজউদিন পাটোয়ারী

প্রকাশিত : ০০:০২, ২৭ জুন ২০২০ | আপডেট: ০৮:১৩, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট প্রত্যুষে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রতি, দেশটির স্থপতি এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। তার দুই নিকটাত্মীয়কেও সপরিবারে হত্যা করা হলো। রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা অবস্থায় একজন রাষ্ট্রপতি এবং দেশটির স্থপতিকে এভাবে হত্যা করার ঘটনা শুধু পৃথিবীতেই বিরল নয়, এর মধ্যে হিংস্রতা, বর্বরতা, নিষ্ঠুরতাও যে-কোনো সভ্য মানুষের কল্পনার সীমানাকে ছাড়িয়ে গিয়েছে।

সেই হত্যাকাণ্ডের বীভৎসতার কথা ভাবতে যে-কোনো মানুষের মন বিষণ্ণতায় ছেয়ে যায়, এমনকি শরীর শিউরে ওঠে। কিন্তু এ মাটির কিছু নষ্ট মানুষ এমন একটি হত্যাকাণ্ড ঠিকই সংঘটিত করতে পেরেছে, তাতে তাদের হাত হয়তো কাঁপেনি, হৃদয় কাঁদার কথা ভাবাই যায় না। এ হত্যাকারীরা এতগুলো মানুষকে হত্যা করে বীরদর্পে ঘুরে বেড়িয়েছে, দেশে-বিদেশে দীর্ঘদিন গুরুত্বপূর্ণ পদে কেউ কেউ অবস্থানও করেছে, কেউ কেউ প্রভূত বিত্তের মালিক হয়ে বিদেশে দীর্ঘদিন নিরাপদ জীবনযাপনও করেছে। কীভাবে তা সম্ভব হলো?

হ্যাঁ, সব সম্ভবের এই বাংলাদেশে এমনটি ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত নিরবিচ্ছিন্নভাবেই সম্ভব হয়েছিল। কেননা, ১৯৭৫ সালেই ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে বাংলাদেশ রাষ্ট্রব্যবস্থা এসব খুনিচক্রের বিচারক্রম নিষিদ্ধ করে রেখেছিল। কারা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এবং ৩ নভেম্বর জেলের অভ্যন্তরে ৪ জন জাতীয় নেতাকে হত্যা করে খুনি হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে দোষী হয় না? কারা তাদেরকে দেশে-বিদেশে পুরস্কৃত করেছিল?

কেন করেছিল? কারণ, এ খুনিদের এতগুলো হত্যাকাণ্ডের ফলেই সব হয়েছিল একটি গোষ্ঠীর ক্ষমতায় আরোহণ, ক্ষমতার মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চরিত্রটিকেই বদলিয়ে ফেলা, যারা মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ চায়নি, যারা চেয়েছিল বড়জোর দ্বিতীয় আর একটি পাকিস্তান; তারাই ঐ ঘাতক, খুনিচক্রকে নানাভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে, হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে এবং অবশেষে তাদেরকে রাষ্ট্রীয় বড় দায়িত্ব দিয়েছে। কিন্তু এই শক্তিকে আগে তেমন চেনা যায়নি, বোঝাও যায়নি। বর্ণচোরা এই শক্তি সর্বত্র লুকিয়ে ছিল, তাদের ষড়যন্ত্রের হাত, বিত্ত ও ক্ষমতাকে ব্যবহার করে ১৫ আগস্টের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত করেছিল। সুতরাং ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড শুধু ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার মতো ঘটনার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। এটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বাংলাদেশ থেকে গোটা দেশ এবং জাতিকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার এক গভীর ষড়যন্ত্র, নীল নকশার বাস্তবায়নের যাত্রা। 

বাঙালি জীবনে ১৭৫৭ সালেও একটি বড় ধরনের দুর্যোগ নেমে এসেছিল। সেখানেও দেশীয় ক্ষমতার অংশীদার কিছু মন্ত্রী, রাজপারিষদ, বিদেশী ইংরেজ গোষ্ঠীর সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল, রাষ্ট্রক্ষমতা ও সম্পদ লাভের লোভে তারা নিজেদের নবাবকে প্রথমে ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধে ছলে-কৌশলে হারিয়ে দিল। অবশেষে ৩ জুলাই নবাব সিরাজউদ্দৌলা নিহত হলেন। ক্ষমতা ও ধনসম্পদলোভী তৎকালীণ নবাবের কয়েকজন বিশ্বস্ত পারিষদের ষড়যন্ত্রের কারণে বাংলার মসনদ হারাতে হলো আমাদেরকে। ২০০ বছরের কিছু বেশি সময় আমাদের ইংরেজ এবং পাকিস্তানিদের অধীন থাকতে হলো।

যে সময় আমরা স্বাধীনতা হারিয়েছিলাম তখন আধুনিক রাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের পূর্বপুরুষদের পরিচিতি ছিল না, সামন্ত রাষ্ট্রে রাজনীতির সঙ্গে সাধারণ মানুষের যোগাযোগ খুব একটা ঘটেনি। তাই তখনকার ষড়যন্ত্রের ধরন-ধারণ, জনগণের জীবনব্যবস্থায় এর প্রভাব যেভাবে পড়েছিল, আধুনিক যুগের রাষ্ট্রব্যবস্থার বিষয়গুলো অনেক বেশি ভিন্নতর। আধুনিক যুগে রাষ্ট্র-রাজনীতির বাইরে মানুষের অবস্থান খুব একটা থাকে না। এখন যড়যন্ত্র এবং বর্বর হত্যাকাণ্ডের ঘটনা, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া অনেক বেশি ক্রিয়াশীল হওয়ার কথা; মানুষ দ্রুত এর বিষয়-আশয় ধরে ফেলতে পারার কথা কিন্তু আমাদের জন্য অভিজ্ঞতাটা খুবই কষ্টের এবং বেদনাদার। 

আমরা ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধ, মীরজাফরসহ অন্যদের ষড়যন্ত্র, নবাব-হত্যা নিয়ে এখন যতটা আবেগ এবং সংবেদনশীল। ১৯৭৫ সালের আগস্ট-নভেম্বরের রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ফলে আমাদের রাষ্ট্র-রাজনীতি-অর্থনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতিতে বিপর্যয়ের স্বরূপটি কোনো কোনো মহলে সেভাবে লক্ষ্য করা যায় না; সেভাবে নির্ণয় করতে দেখা যায় না। আমাদের দীর্ঘ সময় লেগেছিল বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডটির পেছনে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারী শক্তির গভীর, সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক স্বার্থ ও উচ্চাভিলাষে বাংলাদেশটাকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে নয়, বরং পাকিস্তানের আদলেই আর একটি রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা এবং টিকিয়ে রাখার পরিকল্পনা থেকে করা হয়েছিল এই সত্যটুকু বুঝতে।

আমাদের এখানে দীর্ঘদিন বই-পুস্তক, প্রচারমাধ্যম এবং রাজনীতির অঙ্গনে ১৯৭৫ সালের সকল রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডকে আড়াল করে শুধু ‘রাজনৈতিক পটপরিবর্তন’ নামে একটি ধারণার ব্যবহার করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনটি ছিল ‘ইতিহাসের অনিবার্য পরিণতি’। কেন ইতিহাসের অনিবার্য পরিণতি? কারণ, তাদের ভাষায় ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষ এবং ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের বাকশাল ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে জনমনে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছিল। সেই ক্ষোভ থেকেই ১৫ আগস্টের দুঃখজনক ঘটনা। যারা এমন বক্তব্য ও ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেন তাদের মধ্যে ১৯৭১-এর কিছু মুক্তিযোদ্ধা, রাজাকার, এককালের কিছু বামপন্থী এবং শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীও রয়েছেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী দেশের পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার পেছনের কার্যকারণ, দেশীয়-আন্তর্জাতিক বাস্তবতাসহ অনেক কিছুই গম্ভীরভাবে বিচারবিশ্লেষণ করে ধারণাগুলো প্রতিষ্ঠিত করা হলে এমন সরলীকৃত সিদ্ধান্ত টানা কোনো বিবেকবান যুক্তিবাদী ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব হত না। আমরা বলব না সেই সময়ে। বঙ্গবন্ধু-সরকারের কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি-দুর্বলতা ছিল না। কোনো সরকারই ত্রুটিবিচ্যুতি বা দুর্বলতার ঊর্ধ্বে নয়। তবে বুঝতে হবে সেই সময়ের সমস্যার বিস্তৃতি, গভীরতা, জটিলতা মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে সেই সরকারের আন্তরিকতা কতোখানি ছিল। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে সমস্যার যে পাহাড় সৃষ্টি হয়েছিল তা সাড়ে তিন বছরে সমাধান দেওয়ার মতো সম্পদ, অভিজ্ঞতা, দেশী-বিদেশী সমর্থন সেই সরকারের ছিল না। সেইসব বিস্তৃত আলোচনায় যাওয়া এই নিবন্ধে সম্ভব নয়। তারপরও যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের ধকলটি বঙ্গবন্ধুর সরকার নানা প্রতিকূলতার মধ্যে থেকে যতটুকু সামলিয়ে উঠেছিলেন তাকে বুঝতে চেষ্টা না করলে আমার মনে হয় তাঁর প্রতি ভীষণভাবে অবিচার করা হবে।

বঙ্গবন্ধু একটি সময়ে এ উপলব্ধি করলেন যে, স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এর মৌল নীতিসমূহের বাস্তবায়ন তাঁর জন্য বেশ জরুরি এবং অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। অথচ তাঁকে তখন বিপ্লববাদে বিশ্বাসী নানা গোষ্ঠী অধিকতর সমাজতন্ত্রে ধাবিত করার জন্য, কেউবা সন্ত্রাসবাদী ধারায়, কেউবা রাতারাতি জাতীয়করণ, কেউবা চৈনিক পথে, কেউ মস্কোর পথে যেতে চাপাচাপি করছিলেন। আসলে ১৯৭০-এর দশকের বিশ্ব বাস্তবতায় সমাজতন্ত্রের প্রভাব, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে বিপুল আত্মদানের মতো বিষয়। এর ফলে এখানকার সমাজ-রাজনীতিতে যে রূপান্তর ঘটেছিল তাতে দ্রুত সমাজতন্ত্রে উত্তরণের স্পৃহা উদীয়মান রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে বেগবান হয়ে ওঠে, যা এই রাষ্ট্রের বাস্তবতার সঙ্গে মোটেও সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। যে তরুণসমাজ মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে এসেছে তারা সমাজতন্ত্রকে কল্পনায় যতটা বুঝেছে, তত্ত্ব ও বাস্তবতায় এর কিছুই শেখেনি, উপলব্ধি করতে পারারও কথা নয়। দ্রুত দাবি থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা হিসেবে সমাজতন্ত্র তখন ছিল একমাত্র মহৌষধ। কিন্তু এটিতে উত্তরণের যে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ভিত্তির অপরিহার্যতা জরুরি ছিল তা কেউ তলিয়ে দেখতে চায়নি। ফলে সর্বত্র নানা ডান-বামের বিচ্যুতি ঘটতে থাকে। সমাজে অস্থিরতা, রাজনীতিতে সহিংসতা, অর্থনীতিতে যুদ্ধবিধ্বস্ততা, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নানা সংকট বৈরিতা বঙ্গবন্ধুর সরকারকে কতটা টালমাটাল অবস্থায় ফেলে দিয়েছিল, অনেকটা বিবেচনায় নিতে চায় না।

সেই অবস্থায় একজন জাতীয়তাবাদী নেতা হয়েও বঙ্গবন্ধু সমাজবাদী চিন্তাধারায় প্রভাবিত হয়ে যে পথে অগ্রসর হতে চেয়েছিলেন তা তিনি, সোভিয়েত বা অন্য কোনো দেশের মঞ্চেল নয়, বরং তিনি নিজস্ব একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য জাতীয় সংসদে অনুমতি চাইলেন, সেই অনুমতি তিনি লাভও করেছিলেন। তিনি একটা নিরীক্ষাধর্মী পথেই অগ্রসর হতে চাইলেন। জনগণের মধ্যে তার বাকশাল পদ্ধতির নিরীক্ষার প্রতি গভীর আগ্রহ তৈরি হয়েছিল, কিন্তু সংশয় থাকার পরও মানুষ পারিবৰ্তনটাকে সাদরে গ্রহণও করছিলেন। সেই পরিবর্তন বিদেশী কোনো কোনো মহলের মোটেও পছন্দের ছিল না। তারা এখানে মীর জাফর, মীর কাশেম, উমিচাঁদ, রায়দুর্লভ, জগৎশেঠ, স্বরূপচাঁদদের সংগ্রহ কয়েছে। গোপনে তারা মিলিত হয়েছে, প্রস্তুতি নিয়েছে, যড়যন্ত্রের জাল সেনাবাহিনীর ভেতরেও কারো কারো সঙ্গে বিস্তৃত করেছে। কেননা, বঙ্গবন্ধুর মতো এত বড় নেতাকে কামান ট্যাংক বন্দুক ছাড়া এমনি এমনি হত্যা করতে যাওয়া ষড়যন্ত্রকারীদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তা বুঝেশুনেই তাদের। দেশী-বিদেশী পরামর্শদাতারা অন্যদের জাল বিস্তার করেছে।

অবশেষে অকস্মাৎ ১৫ আগস্ট ট্যাংক-বন্দুকের বহর নিয়ে ষড়যন্ত্রকারীরা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করতে সক্ষম হয়। ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা, নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করাকে কেউ যদি ‘অনিবার্য পরিণতি’ বলে ইতিহাসের ওপর দায় চাপিয়ে দেয় তাহলে সেই দোষ নিশ্চয়ই ইতিহাসের নয়। বলা হলো, ১৯৭৫ সালের পর বাংলাদেশ বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রত্যাবর্তন করলো, দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলো ইত্যাদি অনেক কিছুই দাবি করা হয়েছে, এখনো হচ্ছে। কিন্তু গত ৩২ বছরে বাংলাদেশে গণতন্ত্র কতখানি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা সকলেই হাড়ে হাড়ে এখন টের পাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার করার ৩২ বছর পরও বাংলাদেশে ২৯ জানুয়ারির মতো একপক্ষীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের চরিত্র কোনো সরকার, প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগের একটি অংশ যদি দেখাতে পারে, তাহলে বুঝতে হবে আমাদের গণতন্ত্র কতটা মেকি অবস্থার ভেতর দিয়ে এত বছর চলেছে। 

আমরা দেখেছি, এই ৩২ বছরে পাকিস্তানের প্রেতাত্মা আবার কীভাবে রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হয়েছে। গোলাম আযম-নিজামীরা বিএনপির সহযোগী হয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সাম্প্রদায়িক সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে, জঙ্গিবাদী ধ্যানধারণার বিস্তার ঘটেছে, তালেবান রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি দুর্বলতা গোপন বিষয় নয়। গোটা দেশের রাষ্ট্র, রাজনীতি, শিক্ষাসংস্কৃতিতে এখন পাকিস্তানের মতো ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে যে বিভাজন সৃষ্টি করা হয়েছে, তা মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের সঙ্গে মোটেও সঙ্গতিপূর্ণ নয়, বরং এর সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক আদর্শের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। পাকিস্তানের রেখে যাওয়া, ১৯৭১ সালে আমাদের ত্যাগ করা সেই ধ্যান ধারণা আর বিশ্বাসে আমাদেরকে আবার ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছিল ১৯৭৫ সাল থেকে, বঙ্গবন্ধু এবং তার অনুসারীদের হত্যা করার পর থেকে যারা এমন ধরনের গণতন্ত্র নিয়ে গর্ব করেন তারা গণতন্ত্রের মর্মকে ধারণ করেন না, মানুষকে শুধু প্রতারণা করতে পারেন।

দীর্ঘদিন বঙ্গবন্ধুর নামই তো এদেশে উচ্চারণ করা যেত না, নিষিদ্ধ ছিল তাঁর নাম, তার শাসনকাল। মুক্তিযুদ্ধে তার ভূমিকা সম্পর্কে নানা মিথ্যা রটনা, বিকৃত ইতিহাস প্রচারমাধ্যম, পাঠ্যপুস্তক ও বাজনৈতিক অঙ্গনে প্রচার করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুহত্যার বিচারের কাজও নিষিদ্ধ ছিল। বেগম জিয়ার জন্মদিনও ১৫ আগষ্ট পালন করার রাজনীতি চালু করা হয়েছে। সত্যিই এই বাংলাদেশকে আমরা অনেকদিন চিনতে পারিনি। ১৯৭১-এর বাংলাদেশের মিল খুঁজে পাওয়া সম্ভব ছিল না। অবশেষে ১৯৯৭ সাল থেকে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারকাজ শুরু হলে কিছুটা পরিবর্তনের হাওয়া লাগে। কিন্তু ২০০২ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সময় বিচারকের স্বল্পতার দোহাই দিয়ে মামলাটি ঝুলিয়ে রাখা হয়।  

অবশেষে সুপ্রিমকোর্ট বিচারের কাজ আবার শুরু করে। খুনিদের কয়েকজন জেলে আছে। কয়েকজন বিদেশে পলাতক অবস্থায় আছে। ঘাতকরা দীর্ঘদিন বীরদর্পে ঘুরে বেড়ালেও এখন তারা আদালতে বিচারের সম্মুখীন। তবে জনগণের আদালতে তাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা, ক্ষোভ এবং রায় অনেক আগেই হয়ে আছে। সেই রায়ও আদালত ইতিমধ্যে দিয়েছে। আশা করা যায় অদূর ভবিষ্যতে বঙ্গবন্ধু, তার পরিবারের সদস্য, নিকটাত্মীয় এবং চার জাতীয় নেতাকে হত্যার সঙ্গে জড়িত খুনিদের বিচার একে একে সম্পন্ন হবে।

এসব মানবতাবিরোধী হত্যাকাণ্ডের বিচার যেদিন সম্পন্ন হবে সেদিন থেকে ১৫ আগস্ট ঘুরে এলে বাংলাদেশের জনগণের আর কোনো গ্লানি বা পাপবোধ হয়তো থাকবে না। ১৯৭৫-এর হত্যাকাণ্ড নিয়ে জাতীয়ভাবে কষ্ট ও শোক কোনোকালেই শেষ হবে না, তবে রায় কার্যকর হলে সান্ত্বনা একটা খুঁজে পাওয়া যাবে। এই রাষ্ট্রের পিতাকে তাঁর পরিবারের সদস্য, নিকটাত্মীয়দের ঘনিষ্ঠজনদের হত্যা করেও ইতিহাস থেকে, মানুষের মন থেকে নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি বরং ঘাতকরাই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে সকল বিচারের রায়ে এমনটি সকলে আশা করে। তাহলেই বাংলাদেশ তার আপন জায়গায় আবার ফিরে আসতে পারবে। 


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি