ঢাকা, মঙ্গলবার   ০১ জুলাই ২০২৫

তবে কী যুক্তরাষ্ট্রেও শিকড় গাঁড়ছে ফ্যাসিবাদ? 

এডওয়ার্ড সাঈদের চিন্তার আলোকে একটি গভীর বিশ্লেষণ

সাঈফ ইবনে রফিক

প্রকাশিত : ১৫:৪৫, ৩০ জুন ২০২৫ | আপডেট: ১৫:৫০, ৩০ জুন ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

এক সময় ফ্যাসিবাদ মানেই ছিল মার্শাল বুটের বাজনা, সরাসরি সামরিক শাসন কিংবা উগ্র জাতীয়তাবাদী শ্লোগান। কিন্তু বর্তমান যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামলে ফ্যাসিবাদ যেন আরও সূক্ষ্ম ও সংস্কৃতিময় রূপে শিকড় গাঁড়ছে। ট্রাম্প যুগে আমরা দেখেছি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধ মত দমনের প্রবণতা, শিক্ষাব্যবস্থায় স্বাধীন চিন্তার উপর আক্রমণ এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে প্রশ্নহীন আনুগত্যের কারখানায় রূপান্তরের চেষ্টা। এসব প্রবণতা অনেকটা ইতিহাসের ফ্যাসিস্ট শাসকদের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। ফলে প্রশ্ন জাগে: তবে কি সত্যিই যুক্তরাষ্ট্রে ফ্যাসিবাদের শিকড় গাঁড়ছে?

কর্তৃত্ববাদী শাসন ও ভিন্নমতের দমন
ট্রাম্প প্রশাসনে বিরোধী কণ্ঠ ও প্রতিবাদ দমনে যে তৎপরতা দেখা গেছে, তা মার্কিন গণতান্ত্রিক রীতির জন্য বিপজ্জনক সঙ্কেত। সাম্প্রতিক সময়ে বিশেষ করে ফিলিস্তিনপন্থী ছাত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ট্রাম্প খোলাখুলি ঘোষণা দিয়েছেন যে বিদেশি ছাত্ররা যদি প্রতিবাদে নামে, তাহলে সাথে সাথে তাদের দেশছাড়া করবেন – “যে কোনো শিক্ষার্থী যদি বিক্ষোভ করে, আমি তাকে দেশ থেকে বের করে দেব... বিদেশি শিক্ষার্থী অনেক আছে। ওরা এ কথা শুনলেই আজ্ঞাবহ হবে” । কথা মতোই, তাঁর প্রশাসন অভিবাসন ও কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (ICE) সংস্থাকে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ফিলিস্তিনপন্থী মত প্রকাশকারীদের খুঁজে বের করে গ্রেপ্তার করার অভিযান চালিয়েছে। নিউইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র মাহমুদ খালিল কেবল ফিলিস্তিনের পক্ষের প্রতিবাদে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণেই আটক হয়েছেন; আইনের এক বিরল ধারা খাটিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্যক্তিগতভাবে তার ভিসা বাতিলের নির্দেশনায় সই করেন। এমনকি কোনো সংগঠকের ভূমিকায় ছিলেন না – শুধুমাত্র সহপাঠীদের সাথে সংহতি জানিয়ে বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন – এমন সাধারণ ছাত্রদেরও নজরদারি ও গ্রেফতারের চেষ্টা হয়েছে। টাফটস বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরাল ছাত্রী রুমাইসা ওজতুর্ক তো শুধু একটি ছাত্রসংসদের প্রস্তাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইজরায়েলি সম্পর্ক ছিন্ন করার আহ্বান জানিয়ে সহ-লেখক হওয়ার “অপরাধে” গ্রেফতার হয়েছেন। এই ঘটনাপ্রবাহ স্পষ্ট করে দেয় যে ট্রাম্প প্রশাসন রাষ্ট্রশক্তি ব্যবহার করে মতপ্রকাশের অধিকার চর্চাকে অপরাধে পরিণত করছে এবং রাজনৈতিক ভিন্নমতকে দমন করতে নির্বিচারে প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রয়োগ করছে।

বিশ্লেষকদের মতে, মতপ্রকাশের উপর ট্রাম্পের এই নির্মম হস্তক্ষেপ মার্কিন ইতিহাসে অভূতপূর্ব; এটি ম্যাকার্থিযুগের উইচহান্টকেও ছাড়িয়ে গেছে। বিরোধী কণ্ঠ রোধে শাসকের এমন কঠোর মনোভাব ঐতিহাসিক ফ্যাসিস্ট শাসনের কথাই মনে করিয়ে দেয়, যখন রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে গণতান্ত্রিক মতপ্রকাশ ও প্রতিবাদকে ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ তকমা দিয়ে চাপা দেয়া হতো। অতীতে ইউরোপের ফ্যাসিস্ট শাসকরা যেমন কর্তৃত্ব টিকিয়ে রাখতে শিক্ষিত তরুণ সমাজ ও বুদ্ধিজীবীদের কন্ঠ স্তব্ধ করেছিল, তেমনি আমেরিকাতেও আজ ট্রাম্পের নেতৃত্বে বিভিন্ন আইনি-পদ্ধতিগত ফাঁকফোকর গলিয়ে বিরোধী মতকে শাস্তি দেয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা একে আধুনিক “রাষ্ট্র সন্ত্রাস” হিসেবেও দেখছেন যেখানে দেশের ভেতরেই ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে শাসকের সমালোচনা বন্ধ করা হচ্ছে।

শিক্ষাঙ্গনে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হুমকির মুখে

ট্রাম্প ও তার মিত্ররা শিক্ষাঙ্গন ও একাডেমিক জগতের সমালোচনামূলক চিন্তাধারার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অর্থায়ন সংকুচিত করা, পাঠ্যক্রম থেকে ইতিহাসের অপ্রিয় সত্যগুলো (যেমন দাসপ্রথা, উপনিবেশবাদ বা গণহত্যার ইতিহাস) মুছে ফেলা, এবং ক্যাম্পাসে প্রতিবাদী কার্যক্রমকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করার প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে। এই উদ্যোগগুলোর নেপথ্যে লক্ষ্য একটাই: শিক্ষাব্যবস্থার মুক্ত চিন্তাশীল সত্ত্বাকে হত্যা করে তাকে শাসকগোষ্ঠীর আদর্শগত হাতিয়ারে পরিণত করা। ফলস্বরূপ, যারা মুক্ত চিন্তা চর্চা করতে চান – সত্য প্রশ্ন করতে চান – তাদের সামনে ভয়ের দেওয়াল তুলে দেওয়া হচ্ছে।

গত কয়েক দশকের মার্কিন শিক্ষাব্যবস্থা ইতোমধ্যেই কর্পোরেট ও বাজারবাদী চাপে নুয়ে পড়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় অনেকটাই বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে যেখানে শিক্ষা মানে কেবল চাকরির প্রশিক্ষণ, মানবিক ও মুক্ত চিন্তার চর্চার পরিবর্তে ফলাফলভিত্তিক সংখ্যায়ণের জোর। ট্রাম্প যুগে এ প্রবণতা আরও বিপজ্জনক রূপ নিয়েছে, শিক্ষাঙ্গনকে আদর্শগত আনুগত্যের কারখানা বানানোর হুমকি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। একজন শিক্ষাবিদ হেনরি জিরো মন্তব্য করেছেন, আমরা আজ “শিক্ষাকে শুধু প্রশিক্ষণে পর্যবসিত হতে এবং বিশ্ববিদ্যালয়কে আদর্শগত আনুগত্য ও দমন-পীড়নের স্থানে পরিণত হওয়ার বিপদ” প্রত্যক্ষ করছি। ইতিহাস থেকে দেখা যায়, কর্তৃত্ববাদী শাসনের উত্থানে সবার আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতাকেই বলি হতে হয়, আর একবার একাডেমিক মুক্তচিন্তা মরলে গণতন্ত্রেরও মৃত্যু ঘটে। ঠিক যেমন হিটলারের নাৎসি জার্মানিতে বা মুসোলিনির ইটালিতে প্রথমেই বিশ্ববিদ্যালয় ও বুদ্ধিজীবীদের উপর দমন-পীড়ন নেমে এসেছিল, আমেরিকাতেও এখন সেই বিপজ্জনক ইতিহাসের ছায়া পড়ছে।

তবে আশার বিষয় হলো, এখনো বিশ্ববিদ্যালয়সমূহই এমন কিছু স্থানের অন্যতম যেখানে সমালোচনামূলক চিন্তার চর্চা টিকে আছে এবং যা কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে ঢাল হিসেবে কাজ করতে পারে। গবেষক হেবা গোওয়ায়েদ ও জেসিকা হার্ডি লক্ষ করেছেন, সকল সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আদর্শগত বিচারে বিশ্ববিদ্যালয়ই সেই জায়গা যেখানে তরুণরা ভুল করতে করতে শেখে, নাগরিক হিসেবে সামষ্টিক শিক্ষা লাভ করে – যে কারণে ডানপন্থী ক্ষমতালিপ্সুরা সবসময় প্রথম টার্গেট করে শিক্ষাক্ষেত্রকে। হান্না আরেন্ট স্মরণ করিয়ে দেন, “মানুষকে অজ্ঞ রাখা গেলেই একনায়কতন্ত্র বা স্বৈরতন্ত্র টিকে থাকতে পারে”। তাই শিক্ষাক্ষেত্রকে নীরব করা মানেই জনগণকে অজ্ঞ রাখা, আর সেটাই স্বৈরশাসকের অভিপ্রায়।

শ্বেত জাতীয়তাবাদ ও অভিবাসন: স্টিফেন মিলারের উত্থান
ট্রাম্প প্রশাসনের আদর্শিক রূপান্তরের একটি বড় নিদর্শন হল অভিবাসন নীতি ও অভিবাসীবিরোধী বক্তৃতা, যার নেপথ্যে ছিলেন শীর্ষ উপদেষ্টা স্টিফেন মিলার। মিলার নিজেকে জাতীয়তাবাদী রক্ষণশীল বলে দাবি করলেও তাঁর নীতি ও কর্মকাণ্ডে শ্বেত জাতীয়তাবাদের ছাপ স্পষ্ট। ২০১৯ সালে ফাঁস হওয়া ইমেইলে দেখা যায়, মিলার বর্ণবাদী ষড়যন্ত্র তত্ত্ব—"শ্বেতাঙ্গ জনসংখ্যা প্রতিস্থাপন" — প্রচারে লিপ্ত ছিলেন। শতাধিক কংগ্রেস সদস্য ও অসংখ্য অধিকার সংগঠন তার পদত্যাগ চাইলেও ট্রাম্প হোয়াইট হাউস দৃঢ়ভাবে মিলারের পাশেই ছিল। ইতিহাসবিদ রুথ বেন-গিয়াত (যিনি ইউরোপীয় ফ্যাসিবাদের ওপর গবেষণা করেন) মিলারকে “নিঃশব্দ চরমপন্থী” বলে অভিহিত করেছেন, যিনি আড়ালে থেকে ট্রাম্পের মত একজন “মনোযোগকাতর” নেতার চরম ডানপন্থী অ্যাজেন্ডা সফল করতে আদর্শগত ইন্ধন জোগান। মিলার ছিলেন ট্রাম্পের বহু কুখ্যাত অভিবাসন নীতির স্থপতি – মুসলিম দেশগুলোর উপর নিষেধাজ্ঞা হঠাৎ করে কার্যকর করা থেকে শুরু করে মেক্সিকো সীমান্তে “জিরো টলারেন্স” নীতিতে পরিবার বিচ্ছিন্নকরণ – এসবের পেছনে মিলারের প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল।

স্টিফেন মিলারের মত মতাদর্শিক ব্যক্তিত্বদের উত্থান আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় ইতিহাসের আরও অন্ধকার যুগের কথা। মিলার যেভাবে জাতিগত বিশুদ্ধতা ও বহিরাগত-বিদ্বেষের কথা বলেন, তা হিটলারের নাৎসিবাদী বর্ণবাদী ভাষণকেই প্রতিধ্বনিত করে। ট্রাম্পের শিবিরে মিলার একপ্রকার আমেরিকান "গোয়েবেলস" হয়ে নীতিনির্ধারণে শ্বেত জাত্যাভিমানী ধারণা সঞ্চার করেছেন বললে অত্যুক্তি হয় না। ট্রাম্প নিজেও শরণার্থী, অভিবাসী ও সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে যেভাবে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দিয়েছেন – মেক্সিকো থেকে আসা লোকজনকে “ধর্ষক” বা “অপরাধী” বলার মত বক্তব্য – তা ফ্যাসিস্ট ঐতিহ্যের ‘অপরকে’ শত্রু বানিয়ে জনগণকে ভয় দেখানোর কৌশলের অনুরূপ। আমেরিকার শীর্ষ নেতৃত্বে যখন প্রকাশ্যে শ্বেত জাতীয়তাবাদী মতাদর্শ স্থান পায়, তখন বোঝা যায় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ কতটা ক্ষয়িষ্ণু অবস্থায় পৌঁছেছে। প্রথাগত রিপাবলিকান নেতারাও যেখানে এত কট্টর বর্ণবাদী এজেন্ডা মেনে নিতেন না, সেখানে ট্রাম্প যুগে তা স্বাভাবিক ও গ্রহণযোগ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। মিলারের মতো ব্যক্তির অবাধ পদচারণা শুধু অভিবাসন নীতিতেই নয়, জাতীয় পরিচয় ও অন্তর্ভুক্তির ধারণাকেও একধরনের ফ্যাসিবাদী চিন্তাধারার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

সংস্কৃতি যুদ্ধ ও ফ্যাসিবাদী বক্তৃতার ছক
ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু ও প্রগতিশীলদের প্রতি ট্রাম্পের শিবিরের বৈরিতা কেবল নীতিতেই নয়, সংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও পূর্ণ মাত্রায় প্রকাশ পেয়েছে। হেনরি জিরো লক্ষ করেছেন, আজকের ফ্যাসিবাদ আর বরাবরের মত সামরিক পোশাক পরে আসে না; এটি আসে সংস্কৃতির আড়ালে, সোশ্যাল মিডিয়া ও গণবিনোদনের মোহনীয় সুরে, যা নিষ্ঠুরতাকে স্বাভাবিক করে তুলছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে পপ সংস্কৃতি – সর্বত্র ডানপন্থী প্রচারণায় বিদ্বেষ ও ভ্রান্ত ধারণা ছড়িয়ে মনে ও মননে একটি ‘ভয় এবং বিভ্রম’ এর পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে। উদাহরণসরূপ, কনই ওয়েস্টের মত তারকা যখন হিটলারকে প্রশংসা করে গান প্রকাশ করেন, সেটি নিছক বিতর্ক সৃষ্টি নয়; বরং এটি সমাজকে শিক্ষাদানের একটা পদ্ধতি – ভয়ংকর বিষবৃক্ষের চারা রোপণ করার মত। এ ধরনের ঘটনা ঘৃণা ও বর্ণবাদকে সামাজিক স্বাভাবিকতায় রূপ দিতে সাহায্য করে।

এক্ষেত্রে সংস্কৃতি একটি ‘অসহিংস কল্পনাহীণতার মেশিনে’ পরিণত হয়েছে যা ইতিহাসকে মুছে দেয়, নিপীড়িতদের কণ্ঠরোধ করে এবং নিষ্ঠুরতাকে সাধারণ বোধে পরিণত করে। টিকটকের এলগরিদম হোক বা ফক্স নিউজের সম্প্রচার, ইউটিউবের চক্রবুহ্য হোক বা সামাজিক মাধ্যমে বিলিয়নেয়ারদের অপপ্রচার – সর্বত্র এক ধরনের শিক্ষাদান চলছে, যা জনগণকে ভাবতে ভুলিয়ে দিচ্ছে এবং ভিন্ন মতকে শত্রু হিসেবে চিনতে শেখাচ্ছে। অনেক উদারপন্থী ও শিক্ষাবিদ এখনো সংস্কৃতির এই ক্ষমতাকে অবমূল্যায়ন করেন; তাঁরা নীতি নিয়ে লড়তে ব্যস্ত, অথচ ডানপন্থীরা পুরো সাংস্কৃতিক ময়দান জুড়ে যুদ্ধ চালিয়ে বাস্তবতা ও ইতিহাসের ধারণা নিজেদের মত গড়ে নিচ্ছে। গ্রামশি যেমন বলেছিলেন, "সমস্ত রাজনীতিই হচ্ছে প্রকারান্তরে শিক্ষাদান", আর স্টুয়ার্ট হল বলেছিলেন আদর্শচেতনা মানুষের দৈনন্দিন জীবনে বদ্ধমূল। তাই সংস্কৃতিই হচ্ছে সেই জায়গা যেখানে রাজনৈতিক অর্থ তৈরি ও পুনর্গঠিত হয়। এ বাস্তবতা ট্রাম্পপন্থী কর্তৃত্ববাদীরা গভীরভাবে বুঝতে পেরেছে।

ট্রাম্প ও তার সহযোগীরা তাই সমালোচনামূলক সংস্কৃতি ও চিন্তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে। তারা ইতিহাস মুছে ফেলতে চায়, স্কুল-কলেজে সত্য উচ্চারণ বন্ধ করতে চায়, সংহতিকে অপরাধ হিসেবে দেগে দিতে চায়। উদারনৈতিক গণমাধ্যম ও বুদ্ধিজীবীদের 'জনশত্রু' বলে আখ্যায়িত করা, স্কুলের পাঠ্যসূচি থেকে জাতিগত বৈষম্যের আলোচনা নিষিদ্ধ করা, লাইব্রেরি থেকে বই বাতিল – এসবই একই সংস্কৃতি যুদ্ধের অংশ। এর লক্ষ্য একটাই: সংস্কৃতির মুক্তিচেতনা ও প্রতিবাদী শক্তিকে নিঃশেষ করে সেটিকে আধিপত্যের অস্ত্র বানানো। ট্রাম্প যুগে আমরা দেখেছি কীভাবে ফ্যাসিবাদ মঞ্চস্থ ও প্রচারিত হয় টেলিভিশনের পর্দায় – কখনো ট্রাম্প নিজে কনফেডারেট পতাকা জড়িয়ে বিতর্ক উসকে দিয়েছেন, কখনো টকশোতে ইলন মাস্কের মত প্রভাবশালীরা নাৎসি কায়দায় স্যালুট করছেন, আবার মিলার প্রকাশ্যে হিটলারীয় শব্দচয়নে অভিবাসীদের ‘পরিষ্কার’ করার কথা বলছেন। এমনকি ট্রাম্প এমন সব পাগলাটে প্রস্তাবও দিয়েছেন যার নজির আধুনিক বিশ্বে কম – উদাহরণসরূপ, গাজায় সম্পূর্ণ জাতিগত শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে সেটিকে নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার প্রস্তাব, যা কার্যত গণহত্যার সমতুল্য। এসব ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন বক্তব্য নয়; বরং চিন্তাপূর্বক রচিত একটি সাংস্কৃতিক চিত্রনাট্য, যা সাধারণ জনগণকে ধাপে ধাপে অগ্রহণযোগ্য বিষয়গুলো গ্রহণ করতে শেখাচ্ছে। মানুষকে ইতিহাস-বিস্মৃত ও অনুভূতিহীন করে তুলতে পারলেই যে ফ্যাসিবাদী ক্ষমতা মজবুত হয় – এই চিরন্তন সত্যটি আধুনিক স্বৈরশাসকরা হাড়েহাড়ে জানে।

এডওয়ার্ড সাঈদ: ‘জাগ্রত শিক্ষাদর্শন’ ও প্রতিরোধের দর্শন
এই আধুনিক আধিপত্যের আঁধারে প্রয়াত প্যালেস্টাইনি-মার্কিন পণ্ডিত এডওয়ার্ড সাঈদের চিন্তা আমাদের জন্য এক আলোকবর্তিকা স্বরূপ। ফিলিস্তিনি শরণার্থী পরিবারে জন্ম নিয়ে পশ্চিমে বড় হওয়া সাঈদ আজীবন সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ ও জ্ঞান-ক্ষমতার রাজনীতি তুলে ধরেছেন। একই সাথে, তিনি শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্ব সম্পর্কে গভীরভাবে ভাবতেন। সাঈদ “pedagogy of wakefulness” নামে এক শিক্ষাদর্শনের কথা বলেছেন, বাংলায় যাকে আমরা বলতে পারি ‘জাগ্রত শিক্ষাদর্শন’ বা সজাগ শিক্ষা। এর মর্মার্থ হল, শিক্ষার কাজ হলো ঘুমন্ত চেতনার চোখ খুলে দেওয়া – প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সজাগ থেকে সত্যের পক্ষে দাঁড়ানো।

সাঈদ তাঁর স্মৃতিকথা Out of Place-এ নিজের মায়ের মৃত্যুশয্যায় অনিদ্রার অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে এক গভীর রূপক তুলে ধরেন। মা অসহ্য যন্ত্রণায় ঘুমোতে না পারার কষ্টে বলতেন, “এডওয়ার্ড, আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দাও।” শেষ দিকে রোগ মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পড়ায় তিনি অবশেষে সারাক্ষণ ঘুমিয়ে থাকতেন। আর মা-কে এভাবে সবসময় ঘুমিয়ে থাকতে দেখে সাঈদের নিজের মধ্যে যেন ঘুমের প্রতি এক ধরনের বিরাগ জন্মায়। তিনি লেখেন, “আমার জন্য ঘুম হল মৃত্যু, যেমন যে কোনো সচেতনতার ক্ষয় মানেই মৃত্যু। … ঘুমহীন জাগরণ আমার কাছে এক প্রিয় অবস্থা; আমি চাই যত মূল্যে হোক জেগে থাকতে। রাতের আধোচেতনতার ছায়া কাটিয়ে ভোরের আলোয় সম্পূর্ণ জাগ্রত হতে যেমন শক্তিদায়ক কিছু নেই। আমি নিজেকে প্রায়ই নানা প্রবহমান ধারা’র সমষ্টি হিসেবে অনুভব করি – কঠিন স্থির স্বত্বার ধারণার চেয়ে এই প্রবাহমান বহুমাত্রিক সত্ত্বাকেই আমি শ্রেয় মনে করি।”* (অনুবাদিত)।

সাঈদের এই ঘুম ও জাগরণের রূপকটা ব্যক্তিগত বেদনার প্রকাশ নয় – এটি একটি দার্শনিক অবস্থান। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে চেতনার নিস্তেজ অবস্থা আসলে বেঁচে থাকার নয়, বাঁচার জন্য চাই সজাগ, তীক্ষ্ণ, প্রশ্নমুখর এক মানসিকতা। নিষ্ক্রিয়, নিরুদ্বেগ, “আরামে ঘুমিয়ে থাকা” মানসিকতা আমাদের পরিচয়কে হয়তো নিশ্চয়তা দেয়, কিন্তু সমাজের বেঠিক নিয়মগুলোকে প্রশ্ন না করে মেনে নেওয়া এক ধরনের মৃত্যুসম। এর বিপরীতে এক ধরনের সদাজাগ্রত বেকায়দা অবস্থানকে সাঈদ ভালোবাসতেন – যেখানে সবকিছু নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, ব্যক্তি নিজেকে সম্পূর্ণ সলিড না ভেবে প্রবহমান সত্ত্বা মনে করে, নানা বৈপরীত্যের মধ্য দিয়ে চিন্তাকে তীব্র রাখে। এই চাঞ্চল্য ও অস্বস্তি-উদ্দীপক জাগরণই হল সাঈদের ‘জাগ্রত শিক্ষা’র ভিত – যা যেকোনো সংস্কারের মোহ ও বানিজ্যিক লোভের হাতছানি উপেক্ষা করে চিন্তার স্বাধীনতাকে বাঁচিয়ে রাখে।

সাঈদের দর্শনে, জাগ্রত শিক্ষাদর্শন মানে এমন এক শিক্ষাপ্রক্রিয়া যা স্থানীয় সংকীর্ণতা পেরিয়ে বিশ্বমুখী (cosmopolitan) ও কল্পনাশীল হতে শেখায় এবং মানুষকে সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে জগতের অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তে উদ্বুদ্ধ করে। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে ছাত্র-শিক্ষক সবাইকে বহুস্তরের “সজাগ” নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার কথা বলা হয়, যাঁরা ইতিহাস ও সামাজিক বাস্তবতা সম্পর্কে সজ্ঞান থাকবেন এবং জ্ঞানকে সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে দেখবেন। সাঈদ জোর দিয়ে বলেন, শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্ব হল ক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা, প্রচলিত মতকে না নাড়া দিয়ে না রাখা, আর “স্বাভাবিক” বলে মেনে নেওয়া অন্যায়গুলোর নেপথ্যের নৈতিক প্রশ্নগুলোকে জনসম্মুখে তুলে ধরা। এই সক্রিয়, সংশ্লিষ্ট প্রকাশ্য বুদ্ধিজীবিতার চর্চা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসরে সম্ভব – বরং একে একাডেমিক工作的 অবিচ্ছেদ্য অংশ বলেই সাঈদ মনে করেন। তিনি নিজে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ফিলিস্তিনের অধিকারের পক্ষে, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে অকুতোভয় সোচ্চার ছিলেন; আর সেই অভিজ্ঞতা থেকেই বলতেন একাডেমিক জ্ঞান ল্যাবরেটরিতে বন্দী রাখার জিনিস নয়, তাকে জনপরিসরে এনে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে লাগাতে হবে।

সাঈদের ‘জাগ্রত শিক্ষাদর্শন’ আমাদের আজ স্পষ্ট পথ নির্দেশ করে: বিশ্ববিদ্যালয়কে পুনরায় জাগ্রত বিবেকের মঞ্চ হিসাবে ফিরিয়ে আনতে হবে, যেখানে ছাত্র-শিক্ষকরা মিলে সমাজের কঠিন প্রশ্নগুলো মোকাবিলা করবেন, উত্পীড়িতের পক্ষে দাঁড়াবেন, এবং জ্ঞানচর্চাকে স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের সেবায় নিয়োজিত করবেন। বিশ্ববিদ্যালয় যদি আবার সমাজের সমালোচনামূলক হৃদপিণ্ড হয়ে উঠতে পারে, তবেই রাষ্ট্রক্ষমতার অপব্যবহার ও ফ্যাসিস্ত প্রবণতার বিরুদ্ধে টেকসই প্রতিরোধ গড়ে তোলা যাবে।

গাজা, আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট ও যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাঃ নীতিহীনতার অভিঘাত
ট্রাম্প আমলের কর্তৃত্ববাদী মনোভাব কেবল দেশের ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; এর আন্তর্জাতিক বহিঃপ্রকাশও সমান উদ্বেগজনক। বিশেষ করে ইসরায়েলের গাজা নীতির সাথে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গতি এবং নির্বিকার সমর্থন আন্তর্জাতিক নীতি ও মানবাধিকারের মৌল নীতিগুলোকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে। ২০২৪ সালে গাজায় সংঘটিত ভয়াবহ যুদ্ধ ও মানবসঙ্কটের প্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এমন এক চাঞ্চল্যকর প্রস্তাব দিয়েছিলেন যাতে যুক্তরাষ্ট্র গাজা ভূখণ্ড “নিজ দখলে নিয়ে নেবে” এবং সেখানে থাকা সমগ্র ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীকে অন্যত্র স্থানান্তরিত করতে হবে। এই বক্তব্য কার্যত পুরো গাজা স্ট্রিপ থেকে ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক উচ্ছেদ ও জাতিগত নির্মূলের পরিকল্পনার শামিল – যার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায়। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ স্পষ্ট মন্তব্য করে যে, যদি এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয় তবে তা ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে “যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের অতি বিপজ্জনক পর্যায়ে উন্নীত হওয়া” হবে। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা স্মরণ করিয়ে দেন যে দখলকৃত ভূখণ্ডের জনগণকে স্থায়ীভাবে উচ্ছেদ করা আন্তর্জাতিক আইনের চরম লঙ্ঘন, আর এটি অপরাধমূলক অভিপ্রায়ে করলে তা যুদ্ধাপরাধের শামিল; রাষ্ট্রীয় নীতির অংশ হিসেবে ব্যাপকভাবে করলে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবেও গণ্য হবে।

ট্রাম্প এই প্রস্তাবটি করেছিলেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর পাশে দাঁড়িয়ে – সেই নেতানিয়াহু যাঁর সরকারের নীতিকে ইতোমধ্যেই ইচ্ছাকৃতভাবে গাজার অংশবিশেষকে বসবাসের অযোগ্য করে তোলার পরিকল্পনা বলে অভিযুক্ত করেছে মানবাধিকার সংস্থাগুলো। ইসরায়েলি বাহিনী অক্টোবরে যেভাবে লক্ষাধিক ফিলিস্তিনিকে গাজায় জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করেছে, খাদ্য-পানি-বিদ্যুতের মতো জীবনধারনের উপকরণ থেকেও যেভাবে বঞ্চিত করছে, তা যুদ্ধাপরাধ ও সম্ভাব্য গণহত্যার পর্যায়ে পৌঁছেছে বলেই হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অন্যান্য সংস্থা সতর্ক করেছে। এমন প্রেক্ষাপটে একজন মার্কিন প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে আরও বড় মাত্রায় উচ্ছেদ এবং সরাসরি গাজা দখলের প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি সেই নৃশংস অপরাধের অংশীদার বানানোর শামিল – যা কেবল সহায়তা বা প্রশ্রয়দানের পর্যায়ে আর থাকবে না, বরং অপরাধ সংঘটনে নেতৃত্ব দেওয়ার পর্যায়ে পৌঁছে যাবে। স্বভাবতই, ট্রাম্পের এই মন্তব্য বিশ্বজুড়ে তীব্র নিন্দার ঝড় তোলে। মিসর, জর্ডানসহ প্রতিবেশী আরব দেশগুলো থেকে শুরু করে জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, আয়ারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, ব্রাজিল, চীন, রাশিয়া – একের পর এক দেশ ট্রাম্পের প্রস্তাবকে কঠোর ভাষায় প্রত্যাখ্যান করে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয়ও এই মন্তব্যের নিন্দা জানায়।

এই ঘটনাপ্রবাহ একটি বৃহত্তর সত্য উন্মোচিত করছে: ট্রাম্পের আমেরিকা আন্তর্জাতিক নীতি ও ন্যায়বোধের ন্যূনতম মানদণ্ডকেও অগ্রাহ্য করে ফ্যাসিবাদসুলভ অবস্থান গ্রহণে পিছপা নয়। একজন বিশ্বনেতা যখন প্রকাশ্যে জাতিগত নির্মূলের মত যুদ্ধাপরাধকে সমর্থন বা প্রস্তাব করেন, তা শুধু ঐ নির্দিষ্ট ইস্যুতেই নয় – বিশ্বব্যাপী মানবাধিকারের ভবিষ্যৎ রীতিনীতি জন্যও এক অশনি সংকেত বহন করে। আমেরিকার মত ক্ষমতাধর রাষ্ট্র যদি এই ধরণের বিধ্বংসী মানদণ্ড স্থির করে, তবে অন্যান্য স্বৈরশাসকরাও উৎসাহিত হয় একই পথ অনুসরণ করতে। ট্রাম্প প্রশাসন যেমন প্যালেস্টাইনের প্রশ্নে ইসরায়েলের সকল পদক্ষেপকে সমর্থন জানিয়ে এসেছে – জেরুজালেমকে একতরফাভাবে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি, রাষ্ট্রসংঘে ফিলিস্তিন সংক্রান্ত প্রস্তাবগুলো ভেটো, শরণার্থী সাহায্য তহবিল বাতিল – এসবই যুক্তরাষ্ট্রকে ঐতিহাসিক নিরপেক্ষ মধ্যস্থতার ভূমিকা থেকে সরিয়ে একটা পক্ষপাতদুষ্ট ও নীতিহীন অবস্থানে নামিয়ে এনেছে, যা বৈশ্বিক মঞ্চে মানবাধিকার রক্ষার নিয়মগুলোর প্রতি চরম আঘাত হেনেছে।

উপসংহারঃ জাগ্রত বিবেকই প্রতিরোধের পথ
যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আমাদের ভাবতে বাধ্য করছে যে ফ্যাসিবাদ সত্যিই কি নতুন রূপে সেখানে শিকড় গাড়ছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামলের ঘটনা পরম্পরা – রাষ্ট্রদ্রোহ দমন করতে গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব, শিক্ষাঙ্গনে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উপর হামলা, প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ে শ্বেত জাতীয়তাবাদী এজেন্ডার প্রসার, এবং বৈশ্বিক মঞ্চে মানবাধিকারের প্রতি ঔদাসীন্য – এসবই ফ্যাসিবাদের প্রাথমিক লক্ষণগুলোর সাথে আতঙ্কজনক মিল প্রদর্শন করছে। ইতিহাস দেখায়, ফ্যাসিবাদ কখনো একদিনে আসে না; এটি ধীরে ধীরে গণতান্ত্রিক রীতিনীতিকে ভেতর থেকে ক্ষয় করে, ভয়ের আবহ ছড়িয়ে দেয়, সত্যের স্থান দখল করে নেয় মিথ্যা প্রচারণা, এবং সংস্কৃতিকে ব্যবহার করে জনমতকে লক্ষ্যচ্যুত করে। আজকের আমেরিকায় সেই ধরণের অনেক উপসর্গ উপস্থিত।

তবে এই অন্ধকার চিত্রের বিপরীতে আলোর রেখাও রয়েছে। এডওয়ার্ড সাঈদের ‘pedagogy of wakefulness’ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সচেতন ও জাগ্রত জনসমাজ ফ্যাসিবাদের সবচেয়ে বড় প্রতিরোধক। যখন নাগরিকেরা সজাগ থাকেন, প্রশ্ন করতে ভয় পান না, অতীতের ভুলে থেকে শিক্ষা নেন এবং নতুন প্রজন্মকে সত্য ইতিহাস ও ন্যায়বোধে দীক্ষিত করেন – তখন কোনো স্বৈরশক্তিই স্থায়ী হতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়, সংস্কৃতি ও গণমাধ্যমকে যদি সত্যিকার অর্থে মুক্ত চিন্তার প্ল্যাটফর্ম বানানো যায়, তবে সেখান থেকেই গণতন্ত্রের পুনর্জীবন সম্ভব।

সাঈদ বলেছিলেন, বুদ্ধিজীবীর কাজ হল ক্ষমতাকে অস্বস্তিতে রাখা – সেই কাজটি এখন কেবল কয়েকজন একাডেমিকের নয়, বরং গোটা সমাজেরই কর্তব্য। যুক্তরাষ্ট্রে আজ যারা রাস্তায় নেমে বা কলম হাতে এই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়ছেন, তারা আসলে সেই সাঈদের বাণীকেই বাস্তবায়িত করছেন। তাঁরা চেষ্টা করছেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পুনরায় চিন্তার মুক্ত অঞ্চলে পরিণত করতে, যেখানে ছাত্ররা নির্বিচারে “আজ্ঞাবহ” হয়ে থাকার বদলে অন্যায়ের প্রতিবাদে সোচ্চার হবে। তারা সংস্কৃতির জগতে বিকল্প কথন তৈরি করছেন যাতে ঘৃণা ও মিথ্যার বিপরীতে মানবতা ও সত্যের বার্তা ছড়ায়।

আমাদের মনে রাখতে হবে, একটি সমাজ যখন ভাবতে ভুলে যায়, অনুভব করতে ভুলে যায়, স্মৃতি হারায় – তখনই ফ্যাসিবাদ তার সুযোগ পায়। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান সংকট আমাদের জন্যও শিক্ষা বহন করে: অন্যায়ের বিরুদ্ধে সদা জাগ্রত থাকা, প্রশ্ন করা ও প্রতিবাদী সংস্কৃতি গড়ে তোলাই গণতন্ত্র রক্ষা ও পুনর্নির্মাণের একমাত্র পথ। এডওয়ার্ড সাঈদের জাগ্রত চেতনার পাঠ তাই কেবল আমেরিকার নয়, সমগ্র বিশ্বের জন্যই প্রাসঙ্গিক। ফ্যাসিবাদীরাত্রি যতই গভীর হোক, জ্ঞান ও ন্যায়বোধের দীপশিখা জ্বালিয়ে রাখলে আবার ভোর আসবেই – বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মুক্ত চিন্তার বাতিঘর হয়ে উঠলেই সত্য ও ন্যায়ের পথে সমাজকে ফিরিয়ে আনা যাবে। সেই ভোরের প্রত্যাশায় আমাদের সজাগ থাকতে হবে, কারণ সচেতনতা থেকেই আসে প্রতিরোধ, আর প্রতিরোধ থেকেই জন্ম নেয় নতুন সূর্যোদয়।

লেখক: কবি ও সাংবাদিক


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি