দু’গ্রামের রক্তক্ষয়ী বিরোধ মিটলো ব্যতিক্রমী সালিশে

সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুরে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দফায়-দফায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে বেতিল-খামারগ্রাম নামক দুটি গ্রামের মানুষ। মাসখানেক আগের এ ঘটনায় আহত হয় অনেকে, ভাংচুর করা হয় ঘর-বাড়ি ও বাজারের বেশ কিছু দোকান-পাট। উভয় পক্ষের দায়ের করা মামলায় আসামি করা হয় হাজারো মানুষকে। গ্রেফতার এড়াতে ও পুলিশী অভিযানে অনেকেই ছিল ঘরছাড়া। টানা এক সপ্তাহ ছিল পুরো সদিয়াচাঁদপুর ইউনিয়ন জুড়ে এক ভীতিকর অবস্থা। 

বিষয়টি ছিল পুরো এনায়েতপুর, বেলকুচি ও চৌহালী থানা জুড়ে টক অব দ্য টাউন। এমনই এক বিরোধ মেটাতে উদ্যোগী হবার সাহস পায়নি কেউই। অবশেষে সাবেক মন্ত্রী লতিফ বিশ্বাসের উদ্যোগে ব্যতিক্রমী এক সালিশ বৈঠকে হয়েছে শান্তিপূর্ণ সমাধান। 

শনিবার সকালে কয়েক হাজার মানুষের উপস্থিতিতে গ্রাম্য এ সালিশে দেশে প্রথমবারের মতো ব্যবহার করা হয় মাইক। সাবেক মন্ত্রীর উদ্যোগে এ সালিশ মিমাংসায় সহযোগীতা করেন উপজেলা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, বর্তমান ও সাবেক ১০ জন ইউপি চেয়ারম্যানসহ অন্তত ৩০ গ্রামের মাতব্বর।

এনায়েতপুর থানার ওসি মাহবুবুল আলম জানান, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বেতিল ও চাঁদপুর এলাকার দ্বন্দ্ব নিরসনে গত ১৯ সেপ্টেম্বর সদিয়াচাঁদপুর ইউনিয়ন পরিষদে উভয় পক্ষের লোকজন নিয়ে সালিশ বৈঠক হয়। সেখানে চাঁদপুর চরের পক্ষে ব্যাপক লোকজনের সমাগম হলে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে ঘন্টাব্যাপী হামলা-পাল্টা হামলাসহ দফায়-দফায় সংঘর্ষ হয়। এতে বেতিলের পক্ষের ১০টি দোকান, ঘরবাড়ি ভাংচুরসহ উভয় পক্ষের ২০ জন আহত হয়। এরপর আরও কয়েক দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটলে পুলিশ ব্যবস্থা নেয়। টানা ৯ দিন মোতায়েন রাখা হয় পুলিশ। বন্ধ থাকে বেতিল বাজার। 

তিনি আরও বলেন, বিষয়টি নিরসনের লক্ষে এলাকার সর্বজন শ্রদ্ধেয় সাবেক মন্ত্রী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ বিশ্বাস উদ্যোগ নিয়ে উভয় পক্ষকে শনিবার সকালে বেতিল বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে সালিশ বৈঠকে সমবেত হতে বলেন। এতে উভয় পক্ষের অন্তত ৩ হাজার মানুষ উপস্থিত হন। পাশাপাশি কিছু সময়ের জন্য উপস্থিত থাকেন স্থানীয় এমপি আব্দুল মমিন মন্ডল। 

এছাড়া আশপাশের তিন থানার উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউপি চেয়ারম্যান-মেম্বরসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত হন। উভয় পক্ষের কথা সবাই শুনতে পাবেনা বিধায় সালিশ বৈঠকে প্রথমবারের মতো ব্যবহার করা হয় মাইক। 

স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান রাশেদুল ইসলাম সিরাজের সভাপতিত্বে এ সালিশ শুরু হতেই সমঝোতার উদ্যোক্তা লতিফ বিশ্বাস উভয় পক্ষকে নমনীয় হয়ে সকলকে সম্মান দিয়ে একে অপরের অভিযোগের কথা উল্লেখ করতে বলেন। 

এরপর শুরু হয় মূল সালিশ। তখন বেতিলের পক্ষে মনিরুজ্জামান মনি, হারেজ আলী, মহিড় উদ্দিন, শাহা বুদ্দিন, আব্দুর রাজ্জাক, হাফিজুর রহমান এবং চাঁদপুরের পক্ষে শেখ হাফিজ, রমজান আলী, রুহুল হোসেন তাদের নিজ নিজ পক্ষে ঘটনা উপস্থাপন করেন। 

উভয় পক্ষের বর্ননা শুনে ১৫ সদস্যের জুড়ি বোর্ডকে পাঠানো হয় ক্ষতিপূরণ জরিপ করতে। তারা এসে সিদ্ধান্তের কথা জানালে সালিশের উদ্যোক্তা লতিফ বিশ্বাস বেতিল গ্রামের পক্ষকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা চাঁদপুরকে দিতে এবং চাঁদপুর পক্ষকে ৩ লাখ টাকা জরিমানা করা হয় বেতিল পক্ষকে দিতে। এরপর উভয় পক্ষকে বুক মিলিয়ে কোলাকুলি করিয়ে দেয়া হয়। তখন পুরো মাঠ জুড়ে করতালীতে মুখোরিত হয় পুরো এলাকা। 

এ বিষয়ে সাবেক মন্ত্রী লতিফ বিশ্বাস বলেন, আমাদের এলাকা শান্তিপ্রিয়। হঠাৎ করেই দ্বন্দ্ব হওয়ায় ওই দু'পক্ষের চেয়ে ব্যথিত ছিলাম আমিই বেশি। এ কারণে সকল কাজ ফেলে দুই এলাকায় অন্তত ১৫ হাজার মানুষকে আবারও ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করে দিয়েছি। 

বিরোধ নিরসনে শান্তিপূর্ণ মীমাংসায় স্বস্তি প্রকাশ করেছে উভয় পক্ষ। এ ব্যাপারে বেতিল পক্ষের মনিরুজ্জামান মনি, আতাউর রহমান আতা, হারেজ আলী মেম্বর এবং চাঁদপুর পক্ষের শেখ হাফিজ, রুহুল আমীন ও রমজান আলী জানান, আমরা চিন্তা করিনি যে এতবড় দ্বন্দ্ব সহসাই নিরসন হবে। লতিফ বিশ্বাস যদি উদ্যোগী না হতেন তাহলে সহজে আমরা উভয় পক্ষ এক হতে পারতাম না। তাই তার প্রতি কৃতজ্ঞ। 

এদিকে সালিশে উপস্থিত থাকা চৌহালী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ফারুক সরকার, ইউপি চেয়ারম্যান মুল্লুক চাঁদ মিয়া, হাজী সুলতান মাহমুদ এবং বেতিল উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ আখতারুজ্জামান বাবু জানান, এ সালিশ বৈঠক আমাদের জেলায় ইতিহাস হয়ে থাকবে। কারণ এতো মানুষ গ্রাম্য সালিশে উপস্থিত হবার যেমন নজির নেই, তেমনি কোন সালিশে মাইক ব্যবহারও হয়নি এর আগে। আর এরকম শান্তিপূর্ণ সমাধান কেবল মানবতাবাদী লতিফ বিশ্বাসই পারেন, তারই অনন্য নজির হলো আরেকবার। 
 
এনএস/