ঢাকা, সোমবার   ০৭ অক্টোবর ২০২৪

ধূমপান: নীরবে বাড়িয়ে চলে হৃদরোগের ঝুঁকি

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৪:৫১, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

বলা হয়ে থাকে, একটি সিগারেটের একপ্রান্তে থাকে আগুন আর অন্যপ্রান্তে থাকে একজন আহাম্মক। যদিও ধূমপান নিয়ে এটি নিছকই একটি কৌতুক, কিন্তু জেনে রাখুন, ধূমপান নীরবে বাড়িয়ে চলেছে আপনার করোনারি হৃদরোগের ঝুঁকি। বিষয়টি যখন আপনার কাছে আরো দৃশ্যমান আর স্পষ্ট হয়ে উঠবে, ততদিনে হয়তো অনেক দেরি হয়ে যেতে পারে। সচেতন হওয়ার সময় আপনি আর না-ও পেতে পারেন।

ধূমপানকে একসময় পৌরুষের প্রতীক মনে করা হলেও, গত শতাব্দীতে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা এবং বাংলাদেশে প্রখ্যাত চিকিৎসাবিজ্ঞানী জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে ধূমপানবিরোধী আন্দোলন ‘আধূনিক’ শুরু হওয়ার পর থেকে ধূমপায়ীকে মনে করা হয় সমাজের একজন অসচেতন ব্যক্তি। পৌরুষ তো নয়ই, বরং ধূমপানকে এখন একটি গর্হিত কাজ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। 

সিগারেটে ‘সুখটান’ দেয়া ধূমপায়ীরা কি জানেন, তারা কী পান করছেন? ধূমপানের সঙ্গে তারা প্রায় ৭,০০০ ধরনের রাসায়নিক পদার্থ নিজের ভেতরে টেনে নিচ্ছেন, যার সবই শরীরের জন্যে বিষ।

এসব বিষের একটি হলো নিকোটিন। সবচেয়ে ভয়ের কথাটি হলো, এই নিকোটিন হৃৎপিন্ডের  করোনারি ধমনীর দেয়ালে অযাচিত সংকোচন ঘটায় (Coronary artery spasm) ফলে ধমনী-পথে রক্ত চলাচল ব্যাহত হয় এবং স্বাভাবিকভাবেই বাড়ে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি। গবেষণায় দেখা গেছে, অন্য যে-কারো চেয়ে একজন ধূমপায়ীর হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা ছয় গুণেরও বেশি!

ইতোমধ্যে করোনারি হৃদরোগে ভুগছেন যারা, তাদের জন্যে অনেক সময় একটি সিগারেটও হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুর কারণ হতে পারে। হয়তো অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো ঘটনায় আপনি এমনিতেই ভেঙে পড়েছেন, মুষড়ে পড়েছেন, ভুগছেন মারাত্মক দুশ্চিন্তা ও স্ট্রেসে। আমরা আগেই জেনেছি, স্ট্রেস হৃৎপিন্ডের করোনারি ধমনীকে সংকুচিত করে। উপরন্তু আপনি টেনশন মুক্তির তথাকথিত উপায় হিসেবে সিগারেট ফুঁকছেন আর পায়চারি করছেন। এদিকে দুয়ে মিলে ধমনীর সংকোচন হঠাৎ আরো বেড়ে যেতে পারে এবং যে-কোনো সময় ঘটে যেতে পারে হার্ট অ্যাটাকের মতো দুর্ঘটনা।

শুধু তা-ই নয়, ধূমপান নানাভাবে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। যেমন, ধূমপানের ফলে শরীরের জন্যে উপকারী কোলেস্টেরল এইচডিএলের পরিমাণ কমে যায় এবং বাড়ে ক্ষতিকর এলডিএল কোলেস্টেরলের পরিমাণ।

এ-ছাড়াও ধূমপান যে ক্যান্সারের কারণ, এটি এখন আর কারো অজানা নয়। সেইসাথে অন্যান্য রোগঝুঁকি তো আছেই। গবেষণায় দেখা গেছে, সাধারণভাবে ধূমপায়ীরা অধূমপায়ীদের চেয়ে ২২ বছর আগে মারা যেতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পৃথিবীতে প্রতিবছর প্রায় ৫০ লক্ষ প্রাণহানি ঘটে কেবল ধূমপানজনিত রোগের কারণেই।

একজন ধূমপায়ী শুধু যে নিজের ক্ষতিই করেন তা নয়; চরম অসচেতনতার পরিচয় দিয়ে তিনি নির্বিকারে তার চারপাশের মানুষ ও পরিবেশের ক্ষতিও করে যাচ্ছেন। বলা হয়, প্রত্যক্ষ ধূমপানের চেয়ে পরোক্ষ ধূমপান (Passive smoking) কোনো অংশে কম ক্ষতিকর নয়। অর্থাৎ একজন ধূমপায়ীর সিগারেটের ধোঁয়া থেকে তার স্বামী-স্ত্রী সন্তানসহ পরিবারের সদস্য এবং সহকর্মী প্রিয়জন কেউই ঝুঁকিমুক্ত নন।

তাই হৃদযন্ত্রের সুস্থতা তো বটেই, সেইসাথে নিজের ও প্রিয়জনদের সার্বিক সুস্থতা এবং সুস্বাস্থ্যের জন্যই প্রয়োজন ধূমপানমুক্ত সুস্থ সুন্দর পরিবেশ গড়ে তোলা।

ধূমপান বর্জনের উপায়

ধূমপান বর্জনের জন্য আপনি একটি কার্যকর পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারেন। গত তিন দশকে অসংখ্য মানুষ এ পদ্ধতিটি অনুসরণ করে এ বদভ্যাস থেকে পুরোপুরি মুক্ত হয়েছেন।

> ধূমপান ছাড়ার জন্যে বাস্তবে কোনো দৃঢ় প্রতিজ্ঞার প্রয়োজন নেই। এজন্যে নিজের ইচ্ছা আর সিদ্ধান্তটাই যথেষ্ট।

> অনেকেই সিগারেট ছাড়ার কথা ভেবে পকেটে সিগারেট রাখেন না। ভাবেন, পকেটে থাকলেই খেতে ইচ্ছে করবে। তারা বুঝতে পারেন না যে, সাথে না থাকলে ধূমপানের ইচ্ছেটা আরো বেশি হবে। পকেটে সিগারেট না রাখলে দেখা যাবে, আপনি অন্যের কাছ থেকে সিগারেট চেয়ে নিচ্ছেন। তাই সিগারেট ও ম্যাচ পকেটেই রাখুন।

> আপনি শুধু খেয়াল রাখুন, কখন আপনি সিগারেট ধরান। ধূমপানের ইচ্ছা একেকজনের মধ্যে একেক সময়ে জাগে। কেউ টেলিফোনে আলাপ করতে করতে, কেউ কোনো আলোচনার শুরুতে, কেউ টিভি দেখার সময়, কেউ খাবারের পর পর, কেউ-বা আবার চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে সিগারেট ধরান। এ সময়গুলোতে তিনি অনেকটা নিজের অজান্তেই সিগারেট ধরিয়ে ফেলেন।

আজ থেকে আপনি শুধু অন্য কাজ করার সময় ধূমপান করা থেকে বিরত থাকুন। যদি সিগারেট ধরিয়ে ফেলার পর খেয়াল হয় যে, আপনি সিগারেট ধরিয়ে ফেলেছেন, তাহলে নিজেকে জিজ্ঞেস করুন, আপনি এখন সত্যি সত্যি ধূমপান করতে চান কিনা।

> যদি সত্যি সত্যিই সিগারেট খাওয়ার ইচ্ছা হয়, তাহলে অন্য সব কাজ বাদ দিয়ে আরাম করে বসুন। চুপচাপ বসে সিগারেট খান। মনোযোগ দিয়ে সিগারেট খান।

> সিগারেট খাওয়ার সময় শরীরের প্রতি মনোযোগ দিন। চোখ বন্ধ করে সিগারেটে টান দিয়ে অবলোকন করুন, সিগারেটের ধোঁয়া নাক দিয়ে ভেতরে যাচ্ছে। যেতে যেতে তা একটা গোখরা সাপের আকার ধারণ করছে। ফুসফুসে গিয়েই ফণা তুলে ছোবল মারছে। ঢেলে দিচ্ছে নিকোটিন নামের বিষ। বিষাক্ত সাপ ছোবল মারলে আপনার দেহ-মনে যে অনুভূতি সৃষ্টি হতো, ক্ষণিকের জন্যে সে অনুভূতি সৃষ্টি করুন। স্বতঃস্ফূর্তভাবে সে অনুভূতি না এলে সে অনুভূতির অভিনয় করুন। (মনে করুন, মঞ্চে নাটক করছেন। আপনাকে অভিনয় করতে হচ্ছে সাপে আক্রান্ত পথিকের ভূমিকায়। সত্যি সত্যি সাপের ছোবলে আপনার যে মনোদৈহিক প্রতিক্রিয়া হতো, তা-ই করুন।) মনের চোখে আপনার নাক মুখ গলা হৃৎপিন্ড পাকস্থলীর প্রতিক্রিয়া অবলোকন করুন।

> পুনরায় সিগারেটে টান দিন। অবলোকন করুন, আরেকটা গোখরা সাপ ফুসফুসের দিকে যাচ্ছে। পূর্বের প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি করুন।

> এ পদ্ধতিতে পুরো সিগারেট শেষ করুন। এই পুরো প্রক্রিয়ায় আপনার যে অনুভূতি হলো তা একটি কাগজ বা ডায়েরিতে লিখে রাখুন।

> শুধু মনে রাখুন, অন্যের সামনে বা অন্য কোনো কাজ করতে করতে সিগারেট খাবেন না। যখন সিগারেট খেতে ইচ্ছে করবে অন্য সবকিছু বাদ দিয়ে নিরিবিলি বসে এ প্রক্রিয়ায় সিগারেট খাবেন।

এ প্রক্রিয়া কয়েকদিন অব্যাহত রাখলে অচিরেই দেখবেন, আপনার দেহ-মন নিজ থেকেই সিগারেট প্রত্যাখ্যান করছে। সিগারেটে টান দিতেই কাশি চলে আসছে। বিস্বাদ লাগছে। সিগারেটের ধোঁয়া গন্ধ লাগতে শুরু করেছে। এভাবে খুব সহজেই ধূমপানের বদভ্যাস থেকে আপনি পুরোপুরি মুক্ত হতে পারবেন।

লেখাটি ডা. মনিরুজ্জামান ও ডা. আতাউর রহমান এর লেখা এনজিওপ্লাস্টি ও বাইপাস সার্জারি ছাড়াই ‘হৃদরোগ নিরাময় ও প্রতিরোধ’ শীর্ষক বই থেকে নেয়া। 

এমএম/
 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি