ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪

সত্য ঘটনা অবলম্বনে

কিশোরী আজিজুনের হতভাগ্য সন্তান

মানিক শিকদার

প্রকাশিত : ১৯:৩১, ৮ অক্টোবর ২০২০ | আপডেট: ২০:১৫, ৮ অক্টোবর ২০২০

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

এসএসসি পরীক্ষা শেষ হতে না হতেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হলো কিশোরী আজিজুনকে। যদিও ১৮ বছর হয়নি, বাবা আর কাজীর কারসাজিতে ১৮’র বেশি হিসেবে প্রমাণ করার জন্য প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র যোগাড় হয়ে গেছে। আজিজুনের বাবার ৪ কন্যা। স্বাভাবিকভাবেই তিনি উদ্বিগ্ন এই কন্যাদের নিয়ে, তার উপর আজিজুন সবার বড়। তাই আজিজুন অনেকটা বাধ্য হয়েই বাবার সিদ্বান্তে নিজেকে সপে দিলো সামাজিক সংসারে! সঙ্গে নিয়ে গেলো বাবার পরিবার থেকে যৌতুকের বহর।

আজিজুনের স্বামী মোহন অটো চালায়। আয়-রোজগার খুব একটা খারাপ না। দেখতে শুনতে ভালোই। সব মিলিয়ে বিয়ের প্রথম ছ’মাস ভালই কাটছিল। এরইমধ্যে নতুন অতিথীর সংবাদে খুশি শ্বশুর বাড়ীর সবাই। গর্ভবতী হওয়ার তিন মাস পর থেকে আজিজুনের আচার-আচরণ আর বাহ্যিক অবস্থাকে তার শাশুড়ি বাঁকা দৃষ্টিতে খেয়াল করে। যতই সময় গড়ায় তার সন্দেহ বাড়তে থাকে। একসময় নিজের অভিজ্ঞতার ওপর ভর করে নিশ্চিত হলেন- আজিজুনের গর্ভে যে সন্তান সেটা একটি কন্যা শিশু।

কিছুতেই মানতে পারছেন না তিনি। এ শিশু এলে যে সংসারে অভাব দেখা দেবে! খরচের পর খরচ। ছেলেকে বিয়ে করিয়ে যে যৌতুক পেয়েছেন, মেয়েকে বিয়ে দিতে তো সেই রকম বা তারও বেশি কিছু যৌতুক দিতে হবে। এ তো বিশাল লোকশান! সেইসঙ্গে দুশ্চিন্তার অভাব নেই- আজকাল দু’মাসের শিশুও ধর্ষণের শিকার হয়। জন্মের পর থেকে নিয়ে সেই বিয়ে পর্যন্ত এই মেয়েকে নিয়ে তো মহাচিন্তায় থাকতে হবে! এতো দুশ্চিন্তা কি করা যায়? 

উপায় খুঁজতে থাকে আজিজুনের শ্বাশুড়ি। ছেলে মোহনকে আড়ালে নিয়ে সব খুলে বলে। মোহনও বাস্তবতা উপলব্ধি করে- এই মেয়ে যখন বড় হবে স্কুলে যাবে বখাটেরা রাস্তায় এই মেয়েকে নানা রকম নিপীড়ন নির্যাতন করবে! মোহনের মনে পড়ে যায়, সেও তো এমনি করে কয়েকজন মেয়েকে উত্যক্ত করতো। একবার তো এক মেয়েকে তিন-চার বন্ধু মিলে...! 

না, আর ভাবতে পারছে না মোহন। নিজের অজান্তেই চিৎকার ওঠে- না......! সঙ্গে সঙ্গে মোহনের মাও বলে- তাইতো বলছি রে বাবা, এই মেয়ে দুনিয়ায় আসার চেয়ে না আসাই ভালো। মোহন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে- কিন্তু মা, কিভাবে কি করবে? 
-তুই ভাবিস না, আমি ব্যবস্থা করতেছি।

যে আজিজুনকে গত ছয় মাস ধরে অনেক যত্নে রাখলো শ্বাশুড়ি, হঠাৎ সেই অন্তঃসত্ত্বা বউকেই সংসারের সব কাজ করতে বাধ্য করা হলো। পরদিন সকালে উঠে নদী থেকে কলশি করে পানি আনতে বলায় রীতিমত অবাক আজিজুন।
-মা, কি বলছেন? আমি এই অবস্থায় নদীতে যাবো জল আনতে?
-এতো চেটাং চেটাং কথা কও ক্যান। যা কইছি তাই করো। পানি আইনা পুরা বাড়ি ঝাড়ু দিবা। তুমি কোন নবাবের বেটি, তোমারে বসাইয়া বসাইয়া খাওয়ামু!

এভাবে প্রতিদিনই কাজের চাপ বাড়তে থাকে। আর কমতে থাকে খাওয়ার পরিমাণ। উদ্বিগ্ন আজিজুন, কেন এমন করছে মায়ের মতো শাশুড়ি। শেষ ভরসাস্থল স্বামী মোহনের কাছে একদিন মুখ ফুটেই বলে ফেলল- জানো, মা যেন কেমন করছে। সারাদিন আমাকে দিয়ে এতো এতো কাজ করায়। 
মোহনের চোখে মুখে রাগের লাভা- কি, মায়ের বিরুদ্ধে নালিশ? তোমার এতো বড় সাহস? মায়ের কথা শুনলে থাকবা না থাকলে চইলা যাও।

প্রিয় স্বামী মোহনের মুখে এমন কথা? নিজের কানকে যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না আজিজুন। চোখ দিয়ে নিরবে জল গড়িয়ে পড়লো। অস্ফুট স্বরে বলল- আমিতো আমার জন্য বলছি না, আমাদের বাচ্চাটা! মোহন আরো ক্ষেপে গেল- ‘কি এমন বাচ্চা রে? চাইনা এমন বাচ্চা’। এই বলে দ্রুত গতিতে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেল মোহন।

এদিকে সময় গড়িয়ে যাচ্ছে, কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। আর এক মাস পর জন্মাবে একটি কন্যা শিশু। আজিজুনের শ্বাশুড়ির দুশ্চিন্তা চরমে। দ্রুত কিছু একটা যে করতে হবে। আট মাসের গর্ভবতী আজিজুন সংসারের কাজ করতে করতে ক্লান্ত! একটু বিশ্রামের প্রয়োজন। নিজের ঘরে শুয়েছে একটু। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। আজিজুন ঘুমে। হঠাৎ বিকট শব্দে ঘুম ভাঙ্গে আজিজুনের। চোখের সামনে শাশুড়ী ও স্বামীর রুদ্রমূর্তি। 

শাশুড়ি- অ্যাই নবাবের বেটি। সারাদিন আমি খাইট্যা মরুম আর তুই শুইয়া আরাম করবি। উঠ। ছেলের দিকে তাকিয়ে- কি হইলো কিছু কস না কেন? বলেই আজিজুনের তল পেটে লাথি মারে শাশুড়ি। ব্যাথায় আর্তনাদ করে ওঠে আজিজুন। এরই মধ্যে আরো কয়েকটি লাথি মারে মোহন। জ্ঞান হারায় আজিজুন।

চোখ মেলে যখন তাকায় নিজেকে হাসপাতালের বেডে আবিষ্কার করে আজিজুন। বেডের পাশে আজিজুনের মা আর ছোট বোনেরা। আজিজুনের মা কাঁদতে কাঁদতে বলে তোর গর্ভের সন্তানটি মেয়ে ছিল না। ওইডা পোলা আছিল। ওরা ভুল ভাবছিল। (ছদ্মনাম ব্যবহৃত হয়েছে)।

এনএস/


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি