ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪

অবশেষে স্বীকৃতি পেলেন মিনার মনসুর

প্রকাশিত : ১১:৫১, ৮ মে ২০১৯ | আপডেট: ১৭:০১, ৯ মে ২০১৯

জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক হিসেবে যোগ দিয়েছেন কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক মিনার মনসুর। কবি হিসেবে অধিক সমাদৃত মিনার মনসুর কবিতায় নিজস্ব ভাষা সৃষ্টি করে গড়ে তুলেছেন স্বীয় সত্তা। তার কবিতাগুলোয় রয়েছে প্রেম ও দ্রোহের সম্মিলন। প্রবন্ধে তিনি দেশীয় ঐতিহ্যনির্ভর বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিসত্তার প্রতিনিধিত্বশীল কণ্ঠস্বর। সত্তর-পরবর্তী রাজনীতিসচেতন, নিভৃতচারী কবি হিসেবে খ্যাত গুণী এই সাহিত্যিক নিজেকে শুধুমাত্র কবি পরিচয়ে আটকে রাখেননি, সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় বিচরণ করেছেন আপন প্রতিভায়।

পঁচাত্তর পরবর্তীকালে অনন্য সাহসী ভূমিকা পালনকারী প্রতিবাদী ও নীতিনিষ্ঠ এই কবি সম্প্রতি মুখোমুখি হয়েছেন একুশে টিভি অনলাইনের। সাক্ষাতকার নিয়েছেন তানভীরুল ইসলাম।

নতুন দায়িত্ব গ্রহণের অনুভূতি:

পঁচাত্তরপরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমার যত কাজ, সবই করেছি আমার চেতনা, আবেগ, ভালবাসা আর আমার বিবেক থেকে। এটাই আমার প্রথম সরকারি দায়িত্ব। কেউ যদি বলেন, বঙ্গবন্ধুর জন্য আমি সারাজীবন লড়েছি, মুক্তিযুদ্ধ করেছি, তার মানে এই না যে, আমাকে সুযোগ-সুবিধা নিতে হবে। আমি এটা পছন্দ করি না। কিছু কিছু প্রেম আছে যার কোনো বিনিময় হয় না। এটা আমার কর্তব্য, এটা আমার ভালবাসার জায়গা, আমার বিবেকের জায়গা। তবুও আমাদের স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মশালবাহী এই সরকার আমাকে গুরুত্বপূর্ণ একটি দায়িত্ব দিয়েছেন, সরকার মনে করেছেন যে আমি এটা পারবো, সেজন্যে গভীর কৃতজ্ঞতা জানাই। আমাকে অবশ্যই এই আস্থার যথাযোগ্য প্রতিদান দিতে হবে।

পঁচাত্তরের নজিরবিহীন নৃশংসতার স্মৃতি:

আমি আসলে খুবই একজন সাধারণ মানুষ। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের সেই নজিরবিহীন নৃশংসতা যখন সংঘটিত হয় সেই সময়ে এসএসসি পাশ করে আমি মাত্র কলেজে ভর্তি হয়েছি। দেশের যিনি স্থপতি ও রাষ্ট্রপতি তার বাসভবনে ঢুকে নিরস্ত্র মানুষগুলোকে যারা হত্যা করলো তাদের বেশিরভাগই ছিল রাষ্ট্রের বেতনভুক্ত লোকজন। তারা কেবল শপথ ভঙ্গই করেনি, মুক্তিযুদ্ধের মূল আদর্শকে বদলে দিতে চেয়েছিল। দেশটাকে পরিণত করতে চেয়েছিল মিনি পাকিস্তানে। আমি কখনোই এটা মেনে নিতে পারিনি। সে মুহূর্তে আমার মনে হয়েছিল, আমার উচিত তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নেওয়া। আবার যুদ্ধে যাওয়া।

প্রসঙ্গত বলি, ঠিক সেই সময়ে ফিদেল কাস্ট্রোর অসামান্য একটি বক্তব্য পাঠের সুযোগ আমার হয়েছিল যতদূর মনে পড়ে পুস্তিকাটির শিরোনাম ছিলো “ইতিহাস সাক্ষ্য দিবে আমার ভূমিকা সঠিক ছিল”। তিনি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কেন অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন, আদালতের সামনে তিনি তার সপক্ষে অকাট্য যুক্তি তুলে ধরেছিলেন তার এই বক্তব্যে। আমারও মনে হয়েছিল যে, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিরুদ্ধে আমাদেরও হাতে অস্ত্র তুলে নেয়া দরকার। কিন্তু আমরা সেটা পারিনি। তবে আমরা সেদিন কলমকেই যুদ্ধের হাতিয়ারে পরিণত করেছিলাম।

কলম যখন যুদ্ধের হাতিয়ার:

পঁচাত্তরপরবর্তীকালে আমরা চট্টগ্রাম থেকে বেশকিছু প্রকাশনা করি। তার মধ্যে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় ‘শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ’ -এর নাম। এটি আমরা প্রকাশ করি ১৯৭৯ সালের সেপ্টেম্বরে। আমাদের জানা মতে, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত এটিই প্রথম সংকলন। এর আগে ১৯৭৮ সালের ১৫ আগস্ট আমরা প্রকাশ ‘এপিটাফ’ -যার প্রচ্ছদজুড়ে ছিল বঙ্গবন্ধুর ছবি। এই প্রকাশনাগুলো সেই সময়ে অত্যন্ত আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল সারাদেশে। তখনও কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যার আসল বেনিফিসিয়ারি জিয়াউর রহমান ক্ষমতায়, খুনিরা ক্ষমতায়। এর একবছর পরে আমরা প্রকাশ করলাম ‘আবার যুদ্ধে যাবো’ নামের একটা বুলেটিন। সেখানে দেশের যারা বিবেক লেখক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিকসহ প্রায় ২০ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির বক্তব্য নিয়ে আমরা এই সংকলনটা বের করি। তখন আমাদের মানসিকতাটা ছিল যে, বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদে প্রয়োজনে আমাদের আরেকটা যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হবে।

১৯৮২ সালে আমরা প্রকাশ করি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবি মহাদেব সাহার কাব্যগ্রন্থ ‘তোমার পায়ের শব্দ’। সেই সময়ে ঢাকার কোনো প্রকাশনা সংস্থা এই বই প্রকাশ করতে সাহস পাচ্ছিল না। সেই বই প্রকাশ করার জন্য আমরা ‘এপিটাপ প্রকাশনী’ নামে একটা প্রকাশনা সংস্থা প্রতিষ্ঠা করি। তারপর ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত হয় আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘এই অবরুদ্ধ মানচিত্রে’। আরেক সামরিক স্বৈরশাসক লে. জে. এরশাদ তখন ক্ষমতায় এসেছে। এই বই এতোটাই আলোড়ন তৈরি করে যে, এরশাদ ঐ বইটা বাজেয়াপ্ত করে দিয়েছিল। ফেব্রুয়ারিতে বইটা বের হয়, তারপর মার্চেই বইটা বাজেয়াপ্ত হয়। বঙ্গবন্ধুহত্যার পর এটাই সম্ভবত প্রথম কবিতার বই যা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। তারপর লম্বা রাস্তা হেঁটেছি। পার করেছি অনেক কঠিন সময়।

লক্ষ্য উদ্দেশ্য ও করণীয়:

আমি মনে করি, নতুন এই দায়িত্বে আমার অনেক কিছুই করার আছে। দুটি বিষয় আমি স্পষ্ট করে বলি, এক. জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল হয় যে বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে, সেটা আমাদের বাস্তবায়ন করতে হবে। দুই. মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবায়ন। যে চেতনা বা মূলনীতির ভিত্তিতে এই বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেটাই হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। সেই চেতনাটা বাস্তবায়ন করার জন্য সবচেয়ে ভালো মাধ্যম হচ্ছে, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, বই। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে আমাদের যত আন্দোলন, স্বাধীনতা সবকিছুতেই এই সাহিত্য সংস্কৃতিই কিন্তু মূল ভূমিকা পালন করেছে। সে সময়ে অনেক পাঠাগার ছিল, অনেক পাঠচক্র ছিল, সেখান থেকে বহু তরুণ বেরিয়ে এসেছে। তারাই নেতৃত্ব দিয়েছে নানা ক্ষেত্রে। এগুলোকে আমি বাতিঘর বলি। কিন্তু এখন সে জায়গা দখল করে নিয়েছে স্মার্টফোন ও মাদকের মতো বিপজ্জনক সব আসক্তি। আমরা যেমন সমাজ ও অর্থনীতির নানা ক্ষেত্রে বিস্ময়কর উন্নতি করেছি, তেমনি আমাদের সামনে অনেক বড় বড় বিপদও ওত পেতে আছে। তার মধ্যে একটা বিপদ হলো, মাদকের বিপদ। দ্বিতীয়টি হলো সামাজিক মাধ্যমে আসক্তি। বিপদ আরো আছে। সারা পৃথিবীজুড়ে জঙ্গিবাদের যে বিপদ, সেই বিপদটাও কিন্তু কোনো অংশে কম মারাত্মক নয়।

আমরা পড়াশুনার পাশাপাশি খেলতাম, বই পড়তাম, আত্মীয়-স্বজনের বাসায় বেড়াতাম, বন্ধুদের সঙ্গে মিশতাম, সংগঠন করতাম, গ্রামে যেতাম ছুটির দিনগুলোতে -এগুলোই ছিল আমাদের আনন্দের উৎস। এভাবেই আমরা বড় হয়েছি। কিন্তু এখনকার তরুণদের দিকে খেয়াল করুন, তাদের সময় কাটে স্মার্টফোনে, ট্যাবে, কম্পিউটারে। এদিকে আমাদের বিশেষ নজর দিতে হবে। আমি মনে করি, এই কাজগুলো আমার সবার আগে করা দরকার।

তরুণ সমাজ নিয়ে ভাবনা:

আমি মনে করি, বই পড়ার আন্দোলন, পাঠাগারর আন্দোলনসহ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের যে ঐতিহ্য আমাদের আছে, সেটা সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টাটা করতে হবে। মুক্তবুদ্ধির চর্চার যে আন্দোলন, যেটা আমাদের দেশে বহু আগে থেকেই ছিল, এই আন্দোলনটা ছড়িয়ে দিতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, এইসব আন্দোলনেরই ফসল আমাদের মুক্তিযুদ্ধ।

দেশের জন্য ভাবনা:

২০২০ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পূর্ণ হবে। অতএব, এই বছরটা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বইয়ের আন্দোলনের সঙ্গে  বঙ্গবন্ধুকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে যুক্ত করতে হবে। ২০২১ সালে আমাদের স্বাধীনতারও ৫০ বছর পূর্তি হবে। এটাও আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ সময়। এগুলোকে সামনে রেখে আমার কিছু চিন্তা রয়েছে। বিশেষ করে তরুণ ও কিশোরদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু চর্চার প্রসার ঘটানোটা খুবই জরুরি বলে আমি মনে করি। কিশোর-তরুণরা সব সময় অনুসরণ করার মতো উদাহরণ খোঁজে। তাদের জীবন গঠনের জন্য বঙ্গবন্ধুর চেয়ে উৎকৃষ্ট উদাহরণ আর কী হতে পারে!

আরেকটা কাজ হলো, স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিকে সামনে রেখে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে প্রসারিত করা। আমি কতটা পারব জানি না, কিন্তু স্বপ্ন দেখতে তো দোষ নেই। আমরা আগামী প্রজন্মের জন্য বিশাল একটা স্বপ্নের বীজ বুনে দিয়ে যেতে চাই, যেমন আমাদের পূর্ববতী প্রজন্ম আমাদেরকে একটা দেশ দিয়ে গেছেন। রেখে গেছেন সোনার বাংলার স্বপ্ন।

যা কিছু প্রিয়:

প্রিয় লেখক: প্রিয় অনেকেই। তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জীবনানন্দ দাস অন্যতম।

প্রিয় বই: নিকোলাই অস্ত্রভস্কির ‘ইস্পাত’। সিকদার আমিনুল হকের ‘সতত ডানার মানুষ’।

প্রিয় মানুষ: অবশ্যই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমার একটি গ্রন্থের নাম ‘আমার পিতা নয়, পিতার অধিক’।

প্রিয় খাবার: আলু ভর্তা, ডাল আর ডিম ভাজি।

পরিবারে আছেন: স্ত্রী তাহমিন আরা। দুই সন্তান আলোকিতা আর অদম্য।

উল্লেখ্য, মিনার মনসুরের জন্ম ২০ জুলাই ১৯৬০ সালে, চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার বরলিয়া গ্রামে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগ থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। উভয় পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেণিতে প্রথম হয়েছেন। তিনি এর আগে ইত্তেফাকে কর্মরত ছিলেন সম্পাদকীয় বিভাগের প্রধান হিসেবে। তার একাধিক কাব্যগ্রন্থ, জীবনীগ্রন্থ, গবেষণাগ্রন্থ, প্রবন্ধগ্রন্থ এবং সম্পাদিত গ্রন্থ রয়েছে।

এসি

 


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি