সুবর্ণার জন্য স্কুল
প্রকাশিত : ১৫:০৩, ১৯ জুন ২০২১
সুবর্ণার স্কুলটা ১৯৯১’র ২৯ এপ্রিল ঘূর্নিঝড়ে ভেঙে গেছে। সূবর্ণা চাকমা ডানে আটারকছড়ার শান্তিকুমার চাকমার চার সন্তানের বড় মেয়ের নাম। তার বয়স চোখের আন্দাজে ১৪/১৫ হবে।
শান্তিকুমার ষাট দশকে মেট্রিক পাশ বলে এলাকায় স্হানীয় মানদণ্ডে উচ্চ শিক্ষিত বলে মান্যগণ্য ছিলো। আর সে কারনেই সে এলাকায় ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার নির্বাচিত হয় একাধিক বার।
শান্তিকুমার ছিলেন পাহাড়ী মানুষ সম্পর্কে আমার জানার অন্যতম উৎস। আমাদের ক্যাম্পের পূর্ব- দক্ষিনে টিলার নীচে সুবর্ণার স্কুল- আটারক ছড়া জুনিয়র হাইস্কুল। একটি বিশাল বড় বট গাছের ভেঙে পড়া কান্ডের নীচে পড়ে স্কুলটি ভূপাতিত।
স্কুলটির সংস্কার না হওয়ায় সুবর্ণার মতো সবার লেখা পড়া বন্ধ। আর কোন সংস্কারের সম্ভাবনা না দেখে স্থানীয় লোকজন স্কুলটির টিনের চালা খুলে নিজেদের বসত-বাড়িতে লাগিয়েছে। কেউ টিন দিয়ে শুকরের ঘর বানিয়েছে। কেউ নিজের দোকানে লাগিয়েছে। স্কুলের চেয়ার টেবিলগুলোও স্থানীয়দের বাড়িতে ব্যাক্তিগত প্রয়োজনে ব্যবহৃত হতো।
শান্তিকুমার বহু দৌঁড়-ঝাপ করেও কোন সরকারি সাহায্য পেতে ব্যর্থ হয়। তার সাথে আমার পাহাড়ের নানা বিষয় নিয়েই প্রায় প্রতিদিনই টকশো হতো। স্বমত প্রকাশে তাকে কখনো বাঁধা দেইনি।
তার বাড়ির উঠানের বেল গাছের নীচে বসে পার্বত্য চট্টগ্রামের অনেক ইতিহাস শুনেছি। শান্তিকুমার বেশ ধনীকৃষক। তার বাড়িতে চা-পানের চল ছিল। সুবর্ণা প্রায়শই চা নিয়ে হাজির হতো।
একটি বড় হলুদ এলোমিনিয়ামের প্লেটে সাদা চীনা মাটির কাপে লাল চা।
কিশোরী কন্যার হঠাৎ উপস্থিতি হৃদয়ের সিস্টোলিক চাপকে বাড়িয়ে তুলতো। সুবর্ণা আক্ষরিক অর্থেই হুমায়ূন আহমেদের ‘একটা ছিল সোনার কন্যা মেঘবরণ কেশ’ উপমার পাহাড়ী সংস্করণ।
পিঠে থুরং ঝুলিয়ে সে যখন পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে যেত তা দেখে মনে হতো আমার ঘরের টেবিলে রাখা ফটো ফ্রেম থেকে আমার বাগদত্তা বুঝি নীচে নেমে যাচ্ছে।
শান্তিকুমার স্কুলের সংস্কারের কাজে আমাদের সাহায্য চায়। মেয়ের শিক্ষার জন্য আগ্রহ দেখে আমি ভাবতে থাকি কি করা যায় ‘ভাটির দেশের এই কন্যার জন্য’। মেয়েটা পড়া-লেখার সুযোগ না পেয়ে দিন কে দিন ‘গাবুর’ (মূর্খ) হয়ে যাচ্ছে - এটা ছিলো শান্তিকুমারের চিন্তার বিষয়।
স্কুলের সংস্কারের সাথে স্থানীয় লোকদের সম্পৃক্ত করলে সহজেই স্কুল চালু হতে পারে। এতে স্থানীয় পাড়ার লোকদের সাথে আমাদের সম্পর্ক আরো গভীর হবে। ছড়ার স্বচ্ছ জলে পা ডুবিয়ে সুবর্ণা আবার বেনী দুলিয়ে স্কুলে যাবে- এ দৃশ্য এই নিরস বনভূমিতে খুবই রোমান্টিক।
কেন নয়?
সারাদিন পুরনো খবরের কাগজ- রিডার্স ডাইজেস্ট পড়া, রেডিও তে দূরদেশের 'ফিল্মি গানা' শোনার পরও দিনের সূর্যটা পশ্চিমে হেলতে অনেক সময় নিতো।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ‘কাটে না যখন সময় আর কিছু তে’ গানের মতো বাইনোকুলের চোখ রেখে যখন জ্বালা ধরাতো, তখন সুবর্ণার হাটুঁর নীচ পর্যন্ত উন্মুক্ত ফর্সা পায়ে ছড়ার স্বচ্ছ জল ভেঙে স্কুলে যাওয়ার দৃশ্যপটে মনে নানা রংয়ের রংধনু একেঁ যেত।
অতএব মেয়েটি জানুক না জানুক তাকে স্কুলে ফিরিয়ে আনতে হবে। তাই ‘সুবর্ণা আবার স্কুলে যাবে’- এই অব্যক্ত মিশন নিয়ে কাজ শুরু করলাম।
শান্তিকুমারের সহায়তায় আশে পাশের সকল কারবারি আর নেতা মুরুব্বি-যুবকদের ক্যাম্পে আসার দাওয়াত দেয়া হলো। মিটিংয়ে শিক্ষার উপর চাকমা-বাংলা মিশিয়ে একটা আবেগময় বক্তৃতাও দিলাম।
মোদ্দা কথা- স্কুলের টিন খুটি সহ সব চেয়ার টেবিল বেঞ্চ ফেরত দিতে হবে, আর স্কুল পুনর্নির্মাণে স্বেচ্ছা শ্রম দিতে হবে।
জোন থেকে কিছু টাকা মিললো গুনা তারকাটা আর মিস্ত্রি বাবদ। অতঃপর এক শুভ দিনে ক্যাম্পের তত্ত্বাবধানে শুরু হলো মিশন- ‘সুবর্ণা আবার স্কুলে যাবে’ এর কার্যক্রম।
আমার মনের অন্তরালের এক গোপন মিশন- যদিও সুবর্ণা আমার জন্য এক নিষিদ্ধ লোবান।
সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে স্কুলটি মোটামুটি তার পূর্বের রূপ পেল। স্কুলের শিক্ষকরা আবার ফিরে আসলো।
স্কুলের কার্যক্রম পুনরায় শুরু হওয়ার পূর্বে একটা সেলিব্রেশন হওয়া উচিত- এ ধারণা থেকে গ্রামের সকলের জন্য একটা 'টিভি শো'-র ব্যবস্থা হল। এলাকার মানুষ কোন দিন টিভি দেখেনি। বিদ্যুৎ বাতি এই গহীন অরণ্যে এক অজানা অনুভূতি, সেখানে টিভি দর্শন তো চন্দ্র গমনের মতো।
তখন জোন থেকে ক্যাম্পে ক্যাম্পে ২/৩ দিনের জন্য ভাড়া করা রঙ্গিন টিভি ও ভিসিআর পাঠানো হতো বিনোদনের জন্য।
দিনের বেলায় স্কুলের লম্বা বারান্দায় কম্বল দিয়ে ঘেরাটোপের মধ্যে হোন্ডা জেনারেটরে ভটভটানির মধ্যেই চালু হলো ভিসিআর- ‘হিটস অফ মাধুরী দিক্ষিত’।
কিন্তু যার জন্য এই স্কুল মিশন সেই সুবর্ণার দেখা নেই।
পথে হলো দেরি’র মতো বেশ কিছুক্ষণ পর ছোট বোন যুবর্ণাকে সাথে নিয়ে স্কুলের আঙ্গিনায় পা রাখলো সে। পড়নে তার ফুল স্কুল ইউনিফর্ম- নীল কামিজ আর সাদা পায়জামা।
পরদিন থেকে ক্লাশ শুরু হবে। রাতেই মেসেজ পেলাম আমার নাম এসেছে চায়না কোর্সে। সকালেই নামতে হবে ক্যাম্প থেকে। উত্তেজনায় প্রায় নির্ঘুম রাত।
‘চাকরীটা আমি পেয়ে গেছি বেলা শুনছো, এখন আর বিয়েটাকে কেউ আটকাতে পারবে না’- বেলা বোসের গানের কলি মনটা উথলে উঠছে। যাক বাবা, এবার বিয়ে করার মতো অর্থের একটা সুরাহা হলো।
স্কুলের পাশ দিয়েই যেতে হয়। সকালে স্কুল শুরু হয়ে গেছে। ৫০/৬০ জন ছোট ছোট ছেলে-মেয়ের কলতানে মুখরিত 'আটারকছড়া জুনিয়র হাই স্কুল।
স্কুলের জানালার শিক ধরে বাচ্চারা আমাদের পেট্রোলের পথচলা খুব কৌতুহল ভরেই দেখছিলো। পোর্টারের কাধেঁ আমার ব্যাক্তিগত মালামালের বিরাট বোঝা। এটা স্থায়ী বদলির একটা লক্ষণ।
‘স্যার, ইদু আর ন এবে?’ (আর কি ফিরবে না)
পিছন থেকে এমন প্রশ্নে চমকে গেলাম। তাকাতেই দৃষ্টি পড়ল যুবর্ণার দিকে। জানালার ওপাশে শুধু তার মাথাটুকুই দেখা যাচ্ছে। পাশে সুবর্ণা।
পেছন ফিরে তাকাতেই সে লজ্জা পেয়ে একপাশে সরে গেল। আমার মনে হল আমার পিঠে কারো কৌতুহলী দৃষ্টি অনুসরণ করছে।
দ্রুতই পথ চলতে লাগলাম। আজ বাদে কালই দেখা হবে ইডেনের পকেট গেটে আমার অপেক্ষায় থাকা বেলা বোসের।
সুবর্ণা আবার স্কুলে এসেছে- আমার মিশন সফল।
তবে বাইনোকুলারে চোখ রেখে খালি পায়ের সুবর্ণার জল ভাঙ্গা পা আর দেখা হলো না।
মাইনী হ্রদের স্বচ্ছ জলকে দু'ভাগ করে তীব্র বেগে এগিয়ে যাচ্ছে স্পীড বোট। দু'পাশের পাহাড়ের অস্পষ্ট চূড়াগুলো ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। লেকের ঠান্ডা বাতাস আমার কপাল ছুঁয়ে যাচ্ছে। মনে মনে কল্পনা করছি এইতো আর কটা দিন বাদেই প্রিয়তমার ফর্সা হাত দুটো আমার হবে।
এসএ/