ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪

আজকের তরুণরাই একালের মুক্তিযোদ্ধা

স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন

প্রকাশিত : ১৭:০১, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১ | আপডেট: ১৭:০৭, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১

স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন

স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন

দেশ স্বাধীন হওয়ার বছর তিনেক পরের কথা। কমনওয়েলথের একটি কনফারেন্সে গিয়েছিলাম। ওখানে এক ভদ্রলোক আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কোত্থেকে এসেছেন? আমি বললাম, বাংলাদেশ। তিনি শুনলেন বার্বাডোজ। আমি যতই বলি ‘বাংলাদেশ’, তিনি শোনেন ‘বার্বাডোজ’! তার হয়তো কোনো দোষ ছিল না, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের নাম তিনি কখনো শোনেন নি, তাই চিনতে পারছিলেন না। কিন্তু বহির্বিশ্বে আজকের চিত্র পুরোটাই ভিন্ন।

এখন বিদেশে যত অনুষ্ঠানে যাই, বাংলাদেশকে সবাই একনামে চেনে। খেলাধুলার পাশাপাশি নানামুখী দক্ষতা, সাফল্য ও মেধার বিবেচনায় যে-কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় আমাদের ছেলেমেয়েরা বেশ ভালো করছে। তাদের কল্যাণে বাংলাদেশকে এখন বিশ্বজুড়ে সবাই চেনে।

২০১৩ সালে সারা পৃথিবীর খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্থাপত্য শিক্ষার্থীদের ডিজাইন নিয়ে একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হলো ঢাকায়। ৪৫০টি ডিজাইন জমা পড়ল। একজন বাদে বিচারকমন্ডলীর সবাই ছিলেন বিদেশি। প্রতিটি ডিজাইনে শুধু কোড নম্বর লিখে বিচারকদের দেয়া হলো, যাতে বোঝা না যায় ডিজাইনটি কোন দেশের প্রতিযোগীর। প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠত্বের তালিকায় স্থান পেল ২০টি ডিজাইন, যার পাঁচটিই ছিল বাংলাদেশের। আমাদের ভবিষ্যৎ স্থপতিদের এই অর্জনের কথা আমি সব জায়গায় গর্বভরে বলি।

বিশ্বে স্থাপত্য পুরস্কারের মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য হচ্ছে আগা খান পুরস্কার। সম্প্রতি একই বছর বাংলাদেশের দুজন স্থপতি এ পুরস্কার পেলেন, আগে কোনো দেশই এমনটা পায় নি। আমি তরুণ প্রজন্মকে নিয়ে খুব আশাবাদী।

একটা পরিসংখ্যান বলি। এখন এদেশের আবাদী জমির পরিমাণ ১৯৭১ সালের তুলনায় অর্ধেক। অন্যদিকে আমাদের বর্তমান জনসংখ্যা সে-সময়ের দ্বিগুণেরও বেশি। কিন্তু তখন আমাদের খাদ্যঘাটতি থাকলেও এখন আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূূর্ণ। এ থেকে আমরা আমাদের কৃষকদের দক্ষতা বুঝতে পারি। তাই কোনোভাবেই এই দেশ ও জাতি নিয়ে হতাশ হওয়া যাবে না।

আমরা আসলে হতাশ হই কখন? যখন মিডিয়ায় কোনো নেতিবাচক খবর শুনি। কিন্তু একবার ভেবে দেখুন তো, পত্রপত্রিকায় কোন খবরটা ছাপানো হয়? কোথায় কী খারাপটা হচ্ছে সেগুলোই বেশি। আসলে ভালো কাজ হলো মানুষের সহজাত, এগুলো হওয়ারই কথা। যেমন দিয়াশলাই আগুন জ্বালাবে, কিন্তু যদি জ্বালাতে না পারে তখন এটা হবে নিউজ। তাই নেতিবাচক খবর শুনে হতাশ হওয়া যাবে না। প্রতিদিনের ভালো কাজগুলোই হচ্ছে আমাদের প্রাপ্তি।

তবে মনে রাখতে হবে, কোনোকিছু গড়তে সময় লাগে বেশি। কিন্তু ধ্বংস করতে লাগে কয়েক মুহূর্ত। যেমন ধরুন, ৫০ জন মিলে কলা চাষ করল। ফলন হতে সময় লাগল কয়েক মাস। কিন্তু এক রাতে একজন দুষ্ট লোক করাত দিয়ে সব কলাগাছ কেটে দিল কয়েক মিনিটে। এই একজনের মন্দ কাজের তথ্যটাই কিন্তু মিডিয়ায় আমরা দেখতে পাব। কারণ এসব খবরে পত্রিকার কাটতি বাড়ে। হিসাব করলে কিন্তু সমাজে ভালো মানুষের সংখ্যাই বেশি। এই ভালো মানুষগুলো যদি সচেতন হয়ে রুখে দাঁড়াত, তাহলে ঘটনা অন্যরকম হতো। তাই আমাদের সচেতন হতে হবে আমাদের অধিকার নিয়ে।

সচেতন হতে হবে পরিবেশ নিয়েও। কারণ সমস্ত উন্নয়ন মুখ থুবড়ে পড়বে যদি তা পরিবেশবান্ধব না হয়। উন্নত দেশগুলোতে সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিদেরও প্রতিদিন অন্তত আড়াই কিলোমিটার হাঁটতে হয়। তাদের দেশের রাস্তা, ফুটপাত, পার্কিং সবকিছু ওভাবেই নকশাকৃত। কিন্তু এদেশে তা এখনো হয় নি। ইদানীং দেখা যাচ্ছে, আমরা হাঁটতে রাজি নই। সবাই শুধু ব্যক্তিগত গাড়ি চাই। গাড়ি নিয়ে ড্রইংরুম পর্যন্ত চলে যেতে পারলে আমরা বাঁচি! আর এটা বদলাতে হলে রাস্তাঘাটগুলোর স্থাপত্য-নকশায় তো বটেই, সবার আগে পরিবর্তন করতে হবে আমাদের চিন্তা, আমাদের পরিকল্পনা। দেশের যাবতীয় সব গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও অফিস-আদালত, যা আজও রাজধানীকেন্দ্রিক, এর সুষম বণ্টন ও বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে।

এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সাথে একটি ব্যক্তিগত স্মৃতি মনে পড়ে। স্বাধীনতার পর উপমহাদেশের প্রখ্যাত স্থপতি মাজহারুল ইসলাম গেলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ করতে। সাথে আমাকেও নিয়ে গেলেন। বঙ্গবন্ধুর সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এই তরুণ আর্কিটেক্ট মুক্তিযুদ্ধ করেছে। এদের দিয়ে এখন দেশের কাজ করাতে হবে।’ বঙ্গবন্ধু আমার পিঠে হাত রেখে বললেন, ‘বাবারা! শুধু ঢাকা শহর নিয়ে প্ল্যান করলে হবে না। সারা বাংলাদেশ নিয়ে প্ল্যান করতে হবে। না হলে বিপদে পড়বা।’

সেই কথাটাই আজ সত্যি হয়েছে। আসলেই আমরা এখন ঢাকা শহর নিয়ে হিমশিম খাচ্ছি। অথচ পৃথিবীতে আর কোনো রাজধানী নেই, যার চারপাশটা জড়িয়ে আছে ছোট-বড় ছয়টি নদী দিয়ে। কিন্তু আমরা এই সৌভাগ্য ধরে রাখতে পারি নি। নদীগুলোকে ক্রমান্বয়ে দূষিত করে তুলেছি।

বর্তমানে আমাদের যে রেলব্যবস্থা, তার একটু উন্নতি করলেই ঘণ্টায় ২০০ কিলোমিটার বেগে ট্রেন চলাচল সম্ভব। ফলে ঢাকা থেকে সর্বোচ্চ দূরত্বের পঞ্চগড় পর্যন্ত একজন কর্মজীবী মানুষ সহজেই প্রতিদিন আসা-যাওয়া করতে পারবে। অর্থাৎ এরকম কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলেই আমাদের যা আছে তা নিয়েই ঢাকার জনবসতি অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব।

আমার বিশ্বাস আমরা পারব। কারণ পৃথিবীর ইতিহাসে মাত্র নয় মাসে একটি দেশ স্বাধীন করার নজির কোনো জাতির নেই। দেশ গড়ার কাজটাও আমরা পারব এবং এটা আমাদের তরুণরাই করবে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরাও তরুণ ছিলাম। তখন আমরা জানতাম আমাদের শত্রুকে, কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি এবং সারাদেশের মানুষ আমাদের পাশে ছিল। কিন্তু আজকের তরুণরা জানে না তাদের শত্রুকে। চারপাশে শত্রু আছে না মিত্র! যদিও পদস্খলনের শঙ্কা সবসময়ই থাকে। তারপরও তারা তাদের মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছে। এটাই হলো মুক্তির সংগ্রাম, যা প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তের একটি চলমান প্রক্রিয়া। আর কথায় তো আছেই যে, স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন। আমি মনে করি, আজকের তরুণরাই একালের মুক্তিযোদ্ধা।

তাই আমাদের অন্যের দিকে তাকালে চলবে না। যার যার কাজটা ভালোভাবে করতে হবে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে আমরা বাড়ির নিচের অংশটুকু পরিষ্কার রাখব, জ্বালানি গ্যাসের অপচয় করব না অন্তত এভাবে শুরুটা করি। ছোটবেলায় গল্প পড়েছিলাম, এক দেশের রাজা একটি পুকুর খুঁড়তে বললেন। তারপর প্রজাদের নির্দেশ দিলেন, রাতে সবাই দুধ দিয়ে পুকুরটি পূর্ণ করবে। কিন্তু সকালে দেখা গেল পুকুরে শুধুই পানি। কারণ প্রজারা প্রত্যেকেই ভেবেছিল, সবাই তো দুধ ঢালবে আমি না হয় পানিই দেই। কিন্তু এমন প্রজা আমরা কেউই হতে চাই না।

আমার ব্যক্তিগত জীবনেও আমি নিজের কাজের প্রতি সবসময় শ্রদ্ধাশীল থাকার চেষ্টা করেছি। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার পরিবার আমাকে লন্ডনে নিয়ে যাওয়ার জন্যে জোর করেছিল। আমার মা ও ভাইয়ের ছিল লন্ডনের সিটিজেনশিপ। কিন্তু আমি দেশ ছেড়ে যেতে চাই নি। পরেও বহুবার বিদেশে স্থায়ী হওয়ার সুযোগ পেয়েছি। কিন্তু বরাবরই আমি চেয়েছি বাংলাদেশে থাকতে। কারণ আমি এখনো বিশ্বাস করি, একটু উদ্যোগী হলেই আগামী আট-নয় বছরের মধ্যে আমরা বাংলাদেশকে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ দেশে পরিণত করতে পারব। শ্রেষ্ঠ হওয়ার সমস্ত গুণ ও যোগ্যতা এদেশের মানুষের রয়েছে। 

(দেশের বিশিষ্ট স্থপতি ও নগর-বিশ্লেষক মোবাশ্বের হোসেন। কমনওয়েলথ এসোসিয়েশন অব আর্কিটেক্টস এবং বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের প্রাক্তন সভাপতি।  কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন আয়োজিত মুক্ত আলোচনায় ‘সুস্থ পরিবেশ সমৃদ্ধ জাতি’ বিষয়ে তিনি যে আলোচনা করেন, নিবন্ধটি তারই নির্বাচিত অংশের অনুলিখন।) 


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি