ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪

আপনি কি কম ঘুমাচ্ছেন?

পথচারী

প্রকাশিত : ১৬:১১, ১৮ আগস্ট ২০২১

হাজার হাজার বছর ধরে সূর্যের আলো দেখলে জেগে উঠতে হবে আর সূর্যাস্ত মানে আলো নিভে গেলে ঘুমিয়ে পড়তে হবে-  এর ম একটি অভ্যাসে অভ্যস্ত মানব সম্প্রদায়ের জীবনে গত ২০০ বছরে ঘটে গেছে কিছু অভূতপূর্ব পরিবর্তন।

শিল্পবিপ্লব হয়েছে। সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে অসাধারণ সব আবিষ্কারের সাথে সাথে এসেছে বৈদ্যুতিক বাতি। রাত এখন আর অন্ধকারের প্রতীক নয়। মানুষ চাইলেই কৃত্রিম আলো জ্বেলে দূর করতে পারে রাতের অন্ধকার।

আর তা করেই সে প্রথম যে প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটাল তা হচ্ছে ঘুম। কারণ আমরা তখনই ঘুমাই যখন আমাদের দেহে নিঃসরিত হয় মেলাটোনিন নামে এক বিশেষ হরমোন। আর মেলাটোনিন হরমোন নিঃসরণের জন্যে দরকার অন্ধকার। কিন্তু ঘুমের জন্যে সে অন্ধকার কই?

এর সাথে গত চার দশকে যুক্ত হলো মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, ট্যাব, প্যাড- ইত্যাদি হরেকরকম ডিভাইস যার স্ক্রিনে বিচ্ছুরিত হয় ব্লু লাইট বা নীল আলো। ঘুমের মহাশত্রু। সাথে সোশ্যাল মিডিয়া, ইন্টারনেট, টিভি আর অনলাইন গেম।

এক গবেষণায় দেখা যায়, গত ৫০ বছরে মানবজাতি তার রাতের ঘুম থেকে দেড় ঘণ্টা হারিয়েছে! আর হারিয়ে সে নিজেকেই বিপন্ন করেছে।

রোগব্যাধি নিয়ে মানুষের ওপর যত রকমের গবেষণা হয়েছে, সেখান থেকে একটা বিষয় খুব স্পষ্ট। কেউ যত কম ঘুমাবেন, তার আয়ু তত কমবে।

পৃথিবীজুড়ে ১৫৩টি গবেষণা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কম ঘুমের সাথে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ এবং মোটা হয়ে যাবার সম্পর্ক আছে। প্রায় ৫০ লাখ মানুষের উপর চালানো হয় এসব গবেষণা ।

তিন মাস কারো যদি নিয়মিত সঠিক মাত্রায় ঘুম না হয় তাহলে অকাল মৃত্যু, হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের আশঙ্কা দশ গুণ বেড়ে যায়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়, ঠাণ্ডা লাগে বেশি, টিকার কার্যকারিতা কমে যায়।

আমরা যখন ঘুমিয়ে থাকি, আমাদের মস্তিষ্ক তখন স্মৃতি ও তথ্য সংরক্ষণ করে। শরীর ক্ষতিকর উপাদানগুলো সরিয়ে ফেলে সব ঠিকঠাক করে যাতে জাগার পরে শরীর আবার ঠিকমতো কাজ করতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, যাদের ঘুম কম হয় তাদের মনোযোগ ও শর্ট টাইম মেমোরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

ঘুম কম হওয়ায় হতে পারে প্যানিক এটাক (আতঙ্কিত হওয়া), ফোবিয়া (ভীতি) ও ফ্যানটম পেইন (অকারণ অস্বস্তি) যা ডিপ্রেশন, দুশ্চিন্তা এমনকি আত্মহত্যা প্রবণতাও সৃষ্টি করতে পারে।
প্রশ্ন হলো- আমরা কম ঘুমাই কেন? বা কেন কমে যাচ্ছে আমাদের ঘুমের সময়?

প্রথমত, গুরুত্বের অভাব। ঘুমকে আমরা গুরুত্বপূর্ণ মনে করছি না। সেই সাথে বেড়েছে আমাদের ব্যস্ততা। আমাদেরকে এখন দীর্ঘসময় কাজ করতে হয়। সকাল সকাল কাজের জন্যে বেরুতে হয়। আবার ফিরতে ফিরতে দেরি হয়। আছে পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন, বন্ধুদের সঙ্গে ঘোরাঘুরি, কেনাকাটা এবং প্রযুক্তি-বিনোদন। আর এ সবকিছু করতে গিয়ে যখন সময়ের টানাটানি পড়ে, আমরা ঘুমের সময়টার ওপরই ভাগ বসাই।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অফ সার্জনস ফর স্লিপ অ্যাপনিয়ার জেনারেল সেক্রেটারি অধ্যাপক ডা. মনিলাল আইচ বলেন, “বাংলাদেশে ঘুমের সমস্যার একটি বড় কারণ হলো যথাযথ 'ঘুমের সংস্কৃতি' না থাকা। এখানে বেশিরভাগ মানুষেরই রাতের খাবার খাওয়া ও ঘুমাতে যাবার সময় মেনে চলার অভ্যাস নেই। ঘুমের সমস্যা তৈরির এটাও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ।” 

ঘুমের একটা ভাবমূর্তি সংকটও আছে। যদি আপনি কাউকে বলেন যে আপনি দিনে নয় ঘণ্টা ঘুমান, তারা আপনার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলবে, সত্যিই তাই! তাদের মাথায় হয়তো তাৎক্ষণিক এ চিন্তাটাই আসবে, লোকটা এতটা অলস!

কম ঘুমানোটা যেন এখন একটা বড়াইয়ের ব্যাপার। সফল রাজনীতিক বা ব্যবসায়ীদের প্রায়শই বলতে শোনা যায় যে তারা কত কম ঘুমিয়ে কাজ করেন!

গবেষক ড. রেবেকা রবিন্স বলেন, "দিনের পর দিন পাঁচ ঘণ্টা বা তারও কম সময় ঘুমানো যে স্বাস্থ্যের ভয়াবহ পরিণতির ঝুঁকি অনেকখানি বাড়িয়ে দেয়, তার ব্যাপক প্রমাণ আমাদের কাছে রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে হৃদযন্ত্রজনিত বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি, যেমন হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক এবং আয়ুষ্কাল কমে যাওয়া।”

আসলে একটি শিশু যখন ঘুমায়, কেউ কিন্তু বলে না যে বাচ্চাটা কি অলস। কারণ আমরা জানি যে, একজন শিশুর জন্য ঘুমটা কত জরুরি। কিন্তু বড় হতে হতে আমরা ঘুম যে জরুরি, এই ধারণাটা পরিত্যাগ করি এবং যারা বেশি ঘুমায়, তাদের গালমন্দ করি। আঁধারহীন পরিবেশ আর ব্লু লাইটের কথা তো আগেই বলা হলো।

আরেকটি বাধা হলো সভ্যতার আবিষ্কার দিয়ে আমরা গরম-ঠান্ডার প্রাকৃতিক ছন্দ থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছি। ঘুমের জন্যে দরকার শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র দিয়ে শীতল  নয়, প্রাকৃতিকভাবে শীতল ঘর যা কিনা আমাদের সহজাতভাবে ঘুমিয়ে পড়তে সাহায্য করতো।
তাহলে সমাধান কী? উত্তর দেয়ার আগে জানতে হবে-কতটা ঘুম একজন মানুষের দরকার তার সুস্বাস্থ্যের জন্যে? এর সংক্ষিপ্ত উত্তর হচ্ছে ৭ থেকে ৯ ঘণ্টা।

এবার এই সময়টাকে ঠিক রেখে আপনার বাকি কর্মঘণ্টাকে সাজান। নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমুতে যান। নির্দিষ্ট সময়ে জেগে উঠুন। ঘুমের সময়ে ভাগ বসাচ্ছে এমন সব সামাজিকতা ও বিনোদনকে ‘না’ বলুন।

ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নায়ুবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞান বিষয়ের অধ্যাপক ম্যাথিউ ওয়াকার ঘুম নিয়ে গবেষণা করেছেন। স্বাস্থ্যের ওপর ঘুমের প্রভাবকে তিনি এতটাই ইতিবাচক মনে করেন যে তিনি এখন ডাক্তারদের সঙ্গে লবি করছেন প্রেসক্রিপশনে যেন তারা রোগীদের ঘুমের পরামর্শ দেন। 

"যদি আপনার দীর্ঘ ও সুস্থ জীবনযাপন করার আগ্রহ থাকে তবে আপনাকে রাতের ভালো ঘুমের জন্য বিনিয়োগ করতে হবে"। বলেছেন প্রফেসর ওয়াকার। তার "হোয়াই উই স্লিপ" বইতে তিনি ভালো ঘুমের জন্যে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। এর সাথে দেশের কয়েকজন স্লিপ কাউন্সেলরদের সাথে আমরা কথা বলেছি। গ্রন্থনা করেছি এ টিপসগুলো -
১. প্রতিদিন একই সময়ে বিছানায় যাওয়া এবং বিছানা ছাড়া। প্রতিদিন রাতে একটি নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমুতে যেতে হবে। আবার সকালে একটি নির্দিষ্ট সময়ে বিছানা ছাড়তে হবে।

প্রতিদিন একই সময়ে ঘুম থেকে ওঠা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এর ফলে দিনের শেষে একটা নির্দিষ্ট সময়ে গিয়ে ঘুম-ভাব চলে আসবে। 
২. প্রয়োজন অন্ধকার। ঘুমের জন্যে সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে ঘুমুতে যাওয়ার এক ঘণ্টা আগে ঘরের বাতি কমিয়ে দিন।

সেই সাথে টিভি, ল্যাপটপ, মোবাইল অর্থাৎ সব ধরনের স্ক্রিন থেকেও লগ অফ করুন। ব্লু লাইটের ক্ষতি ছাড়াও এসব ডিভাইসের মাধ্যমে যেসব খবর, বিনোদন বা সোশাল মিডিয়ায় আপনি সময় কাটান, ভালো ঘুমের পথে তা বাধা।
৩. খবর কম দেখুন। করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পর লন্ডনের কিংস কলেজ একটা জরিপ চালায়। এতে দেখা যায়, দু-তৃতীয়াংশ মানুষই ঘুমের সমস্যার কথা বলছে। সারাক্ষণ টেলিভিশন আর সোশ্যাল মিডিয়ায় এ সংক্রান্ত খবর আর আতঙ্কের তথ্যগুলোই তাদের অশান্তির কারণ।

অহেতুক উদ্বেগ থেকে বাঁচতে এবং ভালো ঘুমুতে তাই স্বয়ং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রধানও তখন বলেছেন খবর কম দেখতে-

সংক্রমণ এখন কমে যাচ্ছে। করোনাভাইরাসের জায়গা এখন দখল করছে হয়তো অন্য কোনো আতঙ্কের খবর। ঘুমের সমস্যা থাকলে তাই আপনাকে অপ্রয়োজনীয় খবর দেখা সীমিত করতে হবে-আধঘণ্টা বা পারলে তারও কম।

সীমিত করতে হবে সিরিয়াল, ক্রাইম বা হরর সিরিজ দেখা। গবেষণায় দেখা গেছে, ভিডিও কনটেন্ট দেখার পরবর্তী ৮ ঘণ্টা পর্যন্ত মানুষের মস্তিষ্কে এর প্রভাব থাকে। 
৪. কফি ও কোলা বর্জন করুন। কফি এবং চিনিযুক্ত কোলা শরীরে উত্তেজক হিসেবে কাজ করে। দেখা গেছে- কফি পানের ছয় ঘণ্টা পরও রক্তে যে পরিমাণে থেকে যায় তা আধা গ্লাস এক্সপ্রেসো কফি পানের সমান। তাই কোলা বর্জন করুন। আর ঘুমানোর সময়ের অন্তত ১২ ঘণ্টা আগে কফি পান বন্ধ করুন। তার চেয়ে বরং বেশি বেশি পানি খান।  
৫. বিছানা মানেই ঘুম। বিছানায় বসে যারা পড়ালেখা বা অন্যান্য কাজ করেন, "বিছানা মানেই ঘুম"- এ বার্তাটা তাদের মস্তিষ্ক কম পায়। ফলে দেখা যায়, সহজে তাদের ঘুম আসে না।

বিছানায় বসে তাই পড়ালেখা বা ল্যাপটপে কাজ ইত্যাদি না করাই ভালো। ঘুমোতে যাবার আগে বিছানাটা ভালোভাবে পরিষ্কার করে নিন। আরামদায়ক কিছু পরুন। অভ্যাস থাকলে ঘুমের আগে গোসলও করে নিতে পারেন।

ঘরটা প্রাকৃতিকভাবে ঠান্ডা হওয়ার ব্যবস্থা থাকলে ভালো এবং এমন যাতে দিনের আলো ঢোকে এবং রাত থাকে অন্ধকার।  

স্লিপ থেরাপিস্টরা বলেন, শোবার ২০ মিনিটের মধ্যে যদি আপনার ঘুম না আসে তাহলে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ুন এবং অন্য কিছু করুন। সেটা হাঁটাহাঁটি হতে পারে বা হালকা মেজাজের কিছু পড়া হতে পারে। অর্থাৎ যতক্ষণ না আপনার শরীর-মন ঘুমের জন্য তৈরি হচ্ছে।
৬. শরীরকে ক্লান্ত হতে দিন। যারা হোম অফিস করছেন বা শিক্ষার্থীরা যারা ঘরে বসে আছেন বা যারা বাইরে বেরুচ্ছেন কম, তাদের বেশিরভাগ সময়ই কাটছে ঘরে শুয়ে-বসে। ফলে তাদের শরীর ক্লান্ত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে কম। আর শরীর ক্লান্ত না হলে ঘুম আসবে না।

তাই দিনের বেলায় বিছানায় গড়াগড়ি যত না করেন তত ভালো। ঘরে শারিরীকভাবে সক্রিয় থাকার চেষ্টা করুন। অন্তত আধঘণ্টা বাইরে সূর্যের আলোতে হাঁটুন। ইয়োগা বা ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করুন। তবে ঘুমানোর অন্তত ৪/৫ ঘণ্টার মধ্যে নয়।   
৭. কিছু খাবার যা ঘুমের জন্যে সহায়ক। পুষ্টিবিজ্ঞানীরা কিছু খাবারে এমন কিছু উপাদানের সন্ধান পেয়েছেন যা ঘুমের জন্যে সহায়ক মেলাটনিন হরমোন নিঃসরণে সহযোগিতা করে। যেমন : কাঠবাদাম ও অন্যান্য বাদাম, কলা, দুধ, ওটমিল, ফ্যাটি ফিশ ইত্যাদি।

এছাড়া পেঁয়াজ, রসুন, সয়াবিন এসবকে বলা হয় প্রিবায়োটিক বা দেহের উপকারি ব্যাকটেরিয়ার খাবার, যাকে ঘুমের জন্যে সহায়ক বলে বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

৮. দমচর্চা ও মেডিটেশন। প্রাণায়াম বা দমচর্চা দেহকে রিল্যাক্স করে। আর মেডিটেশন তো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার প্রমাণিত কার্যকর প্রক্রিয়া। গবেষণায় দেখা গেছে ইনসমনিয়ায় ভোগারা মেডিটেশন করার পর তার সমস্যা ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে ভালো হয়ে গেছে।

তবে অনিদ্রার কারণ মানসিক অসুস্থতাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে কোনো মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি