ঢাকা, শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪

বুক রিভিউ

‘আড়াল’ থেকে আলোয় আসার গল্প

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৬:০১, ৭ মে ২০১৮

 

অফলাইন-অনলাইন বিশেষত ফেসবুকে প্রতিদিন তো কত শত সহস্র, অযুত গল্প-কবিতা লেখা হচ্ছে। কিন্তু সেসবের ঠিক কতসংখ্যক লেখা হয়ে উঠছে-এ প্রশ্নটা থেকেই যায়। যে লেখার মিষ্টত্ব চুইংগাম চিবোনোর মতো লেখা পাঠ শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে ফুরিয়ে যায় সেগুলোর স্বাদ মনে-মুখে কতটুকুই বা লেগে রয়। তবুও তো দলেবলে অনেকেই ক্রমশ লেখক হয়ে উঠছি। তবে মন্দের ভালো এই যে, আজকাল ফেসবুকে পাঠ প্রতিক্রিয়া জানাতে রঙিন সব ইমো আছে, নতুবা পাঠকের মতো বিপদগ্রস্ত ব্যক্তি হালে আর কেউ থাকতো না। কিন্তু এটাও অস্বীকার করা যাবে না যে, ফেসবুককেন্দ্রিক সাহিত্য গ্রুপগুলো সৃজনশীল মানুষদের জন্য বিশাল এক উন্মুক্ত প্রান্তর তৈরি করেছে।

তেমনই এক প্লাটফরম ‘পেন্সিল’ সাহিত্য গ্রুপ যার পেন্সিল-জাগৃতি প্রতিভা-অন্বেষণ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ২০১৮ সালের অমর একুশে বইমেলাতে আড়াল থেকে আলোয় এসেছেন নবীন গল্পকার ‘দেবদ্যুতি রায়।’ দেবদ্যুতি রায়ের গল্প বলার ধরনটি বেশ সাবলীল আর আড়ম্বরহীন। এই বইয়ের গল্পগুলোতে তিনি তুখোড় সন্ধানীর মতো আড়াল থেকে সামনে নিয়ে এসেছেন নরনারীর সম্পর্কের টানাপোড়েন ও নানান সামাজিক অসঙ্গতি। সেই সঙ্গে শহর আর গ্রামের পথেঘাটে, দোকানে, রেঁস্তোরায়, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মুখগুলোর কষ্ট, আনন্দ, ভালবাসা, বিশ্বাসঘাতকতা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির সহজ সরল গল্পগুলোই দেবদ্যুতি রায়ের গল্পগ্রন্থ ‘আড়াল’ এ স্থান পেয়েছে। জীবনের যেই গল্পগুলো কখনো পুরনো হয় না, বার বার সত্যি হয়ে বাস্তবতার অনুষঙ্গ হয়ে থাকে সেসব গল্পই সংকলিত হয়েছে এই গল্পগ্রন্থে।

যেহেতু প্রতিযোগিতামূলকভাবে পাণ্ডুলিপি নির্বাচিত মাধ্যমে এই লেখকের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে সেহেতু নিশ্চিতভাবে বলা যায় গল্পকার তার লেখা সেরা গল্পগুলোই এই বইয়ের অন্তর্ভূক্ত করেছেন। এবার বইটির কিছু গল্পের পাঠ অনুভূতি পাঠকদের সঙ্গে ভাগাভাগি করবো। এই বইয়ে সংকলিত ‘নূপুর’ গল্পটির আঞ্চলিক ভাষার সংলাপ আমার খুব ভালো লেগেছে যদিও গল্পটি পাঠের শেষে নাহারের আপাত সুখী জীবনের তোরঙ্গ খুলে বেরিয়ে আসা নির্মমতা আমাকে কষ্ট দিয়েছে। আসন্ন শীতের হালকা হিম হিম সন্ধ্যায় অনাগত সন্তানের জন্য সুখস্বপ্নে বিভোর থাকার বদলে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে কেন আনমনা হয় তপা? `মাকড়সা` গল্পের তপার বুক হু হু করে উঠে শৈশবের কোন স্মৃতি মনে পড়ে? দুঃসহ স্মৃতিকাতরতার গল্প `মাকড়সা` পড়ে আত্মজার ভবিষ্যতের কথা ভেবে কাতর হয়েছি। ‘ভেংচি’ গল্পটির বর্ণনাভঙ্গি বেশ সাবলীল ও মায়াময়। যেই মুহুনি বুড়ির বিড়বিড় করে বলা খোনা কথা আর কাশির খুকখুক শব্দ ছাড়া জগতসংসারের কারো কাছে বুড়ির উপস্থিতি টের পাবার অন্য কোনো উপায় ছিল না সেই বুড়ির মৃত্যুর পর তার লাশটিই যেন স্বজনদের কান্নায় নতুন জীবন পায়। `দাম` ও ` সম্বল` গল্পদুটো অচেনা ছকের না হলেও বর্ণনাশৈলীর দক্ষতায় মনে আঁচড় কেটেছে। জীবনের কত সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম বিষয় একজন লেখকের চোখে ধরা পড়ে যায়, ভাবতে অবাক লাগে। এই বইয়ের তেমনই একটি গল্প ‘আড়াল।’ মাঝে মাঝে কিছু আড়াল খুব প্রয়োজন।

জীবনের কঠিনতম কিছু সত্য থেকে নিজেকে আড়াল করে না রাখতে পারলে নিজের তুচ্ছতা অন্যের কাছে ধরা পড়ে যাবার ভয়টা গভীর থেকে গভীর হয়। সেই নিগুঢ় সত্যিটা পিউ জানে বলেই হয়তো ‘আড়াল’ গল্পে বান্ধবী কেয়ার চোখে চোখ রেখে মুখোমুখি বসে থাকার পরও একবাটি স্যুপের ধোঁয়াওঠা বাষ্পে নিজের অনুভূতিটুকু গোপন করতে চায়। ‘আড়াল’ গ্রন্থের ‘চোর-পুলিশ খেলা গল্পটির আসল মজা গল্পের একেবারে শেষের টুইস্টে। পাঠক যখন ভাবছেন চেইনটি কে নিলো, কে নিলো.. তখন পাঠকের চোখকে ফাঁকি দিয়ে গল্পকার এমন একটি আবহ তৈরি করেন যে গল্প শেষ হবার মিনিটখানেক পর পাঠক টের পান একজনের দিকে চোখ রাখতে রাখতে আরেকজন এসে চেইনটি নিয়ে গেছে। `একটি প্রীতি ফুটবল ম্যাচ এবং` গল্পটি ফুটবল ম্যাচকে কেন্দ্র করে লেখা মজার একটি গল্প। `নিশুতি’ গল্পটি পড়ে মন ভরেনি। গল্পটি এই বইয়ের দারুণ একটি শক্তিশালী গল্প হয়ে ওঠার আভাস দিয়ে ঠিক যেই মুহূর্তে ডালপালা ছড়াতে শুরু করেছে তখনই লেখক গল্পটির সমাপ্তি টেনে দিয়েছেন। `আড়াল` গ্রন্থের ক্ষত, দা, তত্ত্ব এবং একটি কাল্পনিক ঘটনা এই গল্পগুলো পড়তে পড়তে বুঝেছি লেখকের হাতে গল্প আছে প্রচুর। শ্বাসরুদ্ধকর টুইস্ট দিয়ে গল্পের পরিসমাপ্তি ঘটানো, শব্দের কোমলতার নিপুণ ব্যবহার আর নির্লিপ্তভাবে গল্প বলে যাবার দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে লেখক পাঠকদের আরও সমৃদ্ধ সব লেখা উপহার দিবেন সেই প্রত্যাশা রইল।

এসএইচ/


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি