ঢাকা, শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪

উপমহাদেশের বিখ্যাত সুফীসাধক হযরত শাহজালাল (রহ.)

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১১:২৯, ২২ ডিসেম্বর ২০১৯

বাংলাদেশ আসাম তথা বৃহত্তর বঙ্গকে ইসলামের আলোকে আলোকিত করার ক্ষেত্রে যাঁর নাম সবচেয়ে উজ্জ্বল এবং এদেশের সূফি, দরবেশ, আউলিয়াগণের মাঝে যাঁর প্রভাব ও মর্যাদা সবচেয়ে বেশি তিনি হলেন হযরত মাওলানা শাহ্জালাল (রহ.)। এতদাঞ্চলে ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী নির্বিশেষে জনসাধারণের মাঝে তাঁর প্রতি ভালবাসা ও নামের মাহাত্ম ব্যাপক ও অতুলনীয়।  

সিলেটে তাঁর মাধ্যমেই ইসলামের বহুল প্রচার ঘটে। সিলেট বিজয়ের পরে শাহজালাল (রহ.) সঙ্গী অনুসারীদের মধ্য হতে অনেক পীর দরবেশ এবং তাদের পরে তাদের বংশধরগণ সিলেটসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে বসবাস করেন। শাহজালাল (রহ.) ও তাঁর সফরসঙ্গী ৩৬০ জন আউলিয়ার সিলেট আগমন ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকে সিলেটেই কবর দেয়া হয়। 

ভারতীয় উপমহাদেশের বিখ্যাত সুফি সাধক হযরত শাহজালাল (রহ.) ৬৭১ হিজরী এবং ১২৭১ খিৃস্টাব্দে তুরস্কে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পুরো নাম শায়খ শাহজালাল কুনিয়াত মুজাররদ। ৭০৩ হিজরী মোতাবেক ১৩০৩ ইংরেজী সালে ৩২ বছর বয়সে ইসলাম ধর্ম প্রচারের লক্ষ্যে বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে এসেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। সিলেট আগমনের সময়কাল নিয়ে যদিও বিভিন্ন অভিমত রয়েছে। তদুপরি শাহজালাল (রহ.)’র সমাধির খাদিমগণের প্রাপ্ত পারসী ভাষার একটি ফলকলিপি হতে উল্লেখিত সন-তারিখই সঠিক বলে ধরা হয়। পারসী ভাষায় লিখিত ফলকলিপিটি বর্তমানে ঢাকা যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।

প্রাথমিক জীবন
হিজরী ষষ্ঠ শতকের শেষাংশে মক্কার কোরাইশ বংশের কিছু লোক মক্কা শহর হতে হেজাজ ভূমির দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তে ইয়েমেন প্রদেশে গিয়ে বসবাস করেন। এদের মধ্যে মোহাম্মদ বা মাহমুদ ছিলেন শাহজালাল (রহ.) এর পিতা। মাহমুদের পিতার নাম ইব্রাহিম। ৬৭১ হিজরী - ১২৭১ খ্রিস্টাব্দে শাহজালাল (রহ.) জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর জন্মভূমি ছিল প্রাচীন আরবে আযমের হেজাজ ভূমির তৎকালীন প্রদেশ ইয়েমেন দেশের কুনিয়া নামক শহর। শাহজালাল (রহ.) যখন তিন মাসের শিশু বালক, তখনই তাঁর মাতার মৃত্যু হয়।

শাহজালাল (রহ.) শিশুকালেই মাতৃহীন হন এবং পাঁচ বছর বয়সে পিতাকে হারান। মামা আহমদ কবির তাঁকে পালক নেন। আহমদ কবির আরবী ভাষায় কোরআন হাদিস শিক্ষা দেওয়াসহ ইসলাম ধর্মের প্রাথমিক বিষয়ে (নামাজ, রোজায়) অভ্যস্ত করে তোলেন শাহজালাল (রহ.)কে। পরবর্তিতে আহমদ কবীর শাহজালাল (রহ.)কে ইয়েমেন থেকে মক্কায় নিয়ে যান। মক্কা শহরে আহমদ কবীরের একটি আস্তানা (হোজরা) ছিল। সেখানে অন্যান্য শিষ্যদের সঙ্গে শাহজালাল (রহ.)কেও উপযুক্ত শিক্ষা দিয়ে গড়ে তুলতে সচেষ্ট ছিলেন বলে জানা যায়।

আধ্যাত্মিকতা
শাহজালাল (রহ.)কে সুফি মতবাদে দীক্ষিত করাই আহমদ কবিরের মুল উদ্দেশ্য ছিল বলে জানা যায়। যে কারণে তিনি শাহ জালাল (রহ.)কে নিয়ে মক্কায় আসা। মক্কা শহরে সোহরাওয়ার্দি তরিকার প্রবর্তক সিহাবুদ্দীনের প্রতিষ্ঠিত খানকায় (মরমী স্কুল) তৎকালে আহমদ কবির ছিলেন প্রধান তত্ত্বাবধায়ক। আহমদ কবির ইসলামের শরীয়ত ও মারিফত উভয় ধারায় শিক্ষা দানে দীক্ষিত করেন শাহজালাল (রহ.)কে।

দরবেশী জীবন
জন্মগতভাবে শাহজালাল (রহ.) দরবেশ পরিবারে জন্ম নিয়েছেন। জানা যায়, তাঁর পিতা ছিলেন একজন ধর্মানুরাগী মোজাহিদ। ইয়েমেনে ধর্ম যুদ্ধে তিনি নিহত হন এবং তার মাতার দিক দিয়ে তিনি সৈয়দ বংশের প্রখ্যাত দরবেশ সৈয়দ জালাল সুরুখ বোখারীর দৌহিত্র ছিলেন। তদুপরি দরবেশ আহমদ কবির তাঁর মামা, যিনি শাহজালাল (রহ.) এর শিক্ষা গুরু ছিলেন। তিনিও তৎকালের একজন বিখ্যাত দরবেশ ছিলেন বলে জানা যায়। আহমদ কবির যখন শাহজালাল (রহ.) এর লালন পালনের ভার গ্রহণ করেন সেই ছোটবেলা থেকেই তাঁকে দরবেশী তর-তরিকায় জীবন যাপনের প্রণালী শিক্ষা দিয়েছেন বলেও পাওয়া যায়।

সিলেট আগমন পর্ব
শাহজালাল (রহ.)কে তাঁর মামা ও গুরু সৈয়দ আহমদ কবিরের আস্তানায় আরব দেশে ছিলেন। একদিন শাহজালাল (রহ.) ভারতবর্ষে ধর্ম প্রচার করছেন তা স্বপ্নে দেখলেন, এই কথা সৈয়দ আহমদ কবিরের কাছে ব্যক্ত করেন। মামা ও মুর্শিদ সৈয়দ আহমদ কবির এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিয়ে শাহজালালকে ভারতবর্ষে যাবার পরামর্শ দেন। যাত্রাকালে কবির শাহজালাল (রহ.) এর হাতে এক মুঠো মাটি তুলে দিয়ে বললেনঃ যে স্থানে এই মাটির স্বাদ, গন্ধ ও বর্ণের মিল এক হবে, সেখানেই ধর্ম প্রচারের জন্য আস্তানা গড়বে। মুর্শিদ সৈয়দ আহমদ কবির (রহ) এর দোয়া নিয়ে শাহজালাল (রহ.) ধর্ম প্রচার অভিযানে আরবের মক্কা শরিফ হতে একা একাই যাত্রা শুরু করেন।

হিন্দুস্থানে প্রবেশ
শাহজালাল (রহ.) মক্কা হতে বিদায়কালে যে কয়জন সঙ্গী তাঁর সঙ্গে যাত্রা করেন তাদের মধ্যে প্রধান ছিলেন হাজী ইউসুফ, হাজী খলিল, হাজী দরিয়া। হিন্দুস্থানে আসার পূর্ব পর্যন্ত সমরবান্দ থেকে সৈয়দ ওমর, রোম থেকে করিমদাদ, বাগদাদ থেকে নিজামুদ্দীন, ইরান, জাকারিয়া ও শাহ দাউদ এবং সৈয়দ মুহম্মদ প্রমুখ তার অনুগামী হলেন। তাদের নিয়ে তিনি হিন্দুস্থানে প্রবেশ করলেন। এরপর সুলতান থেকে আরিফ, গুজরাট থেকে জুনায়েদ, আজমীর শরীফ থেকে মুহম্মদ শরীফ, দাক্ষিণাত্য থেকে সৈয়দ কাসিম, মধ্যপ্রদেশের হেলিম উদ্দীন প্রমুখ মুরিদ হয়ে শাহজালাল (রহ.)’র সঙ্গে সঙ্গে চললেন। এভাবে দিল্লী যখন পৌঁছলেন তখন শিষ্যদের সংখা ২৪০ জন বলে ধারণা পাওয়া যায়।

নিজামুদ্দীন আউলিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ
দিল্লিতে আসার পর নিজামুদ্দিন আউলিয়ার জনৈক শিষ্য গুরুর কাছে শাহজালাল (রহ.) নামে কুত্সা প্রচার করে। সঙ্গে সঙ্গে নিজামুদ্দীন কুৎসা রটনাকারী এ শিষ্যকে উপযুক্ত শাস্তিস্বরুপ দরবার থেকে বের করে দিলেন এবং অন্য দুই শিষ্যকে ডেকে তাদের মারফতে শাহজালাল (রহ.) এর কাছে সালাম পাঠালেন। শাহজালাল (রহ.) সালামের উত্তরে উপটৌকন স্বরুপ ছোট একটি বাক্সে প্রজ্জলিত অঙ্গারের মধ্যে কিছু তুলা ভরিয়া নিজামুদ্দীন আউলিয়ার নিকট পাঠালেন। নিজামুদ্দিন আউলিয়া হযরত শাহজালাল (রহ.)’র আধ্যাত্মিক শক্তির পরিচয় পেয়ে তাঁকে সাদরে সাক্ষাতের আমন্ত্রণ জানান। বিদায়কালে প্রীতির নিদর্শন স্বরূপ নিজামুদ্দিন আউলিয়া তাঁকে এক জোড়া সুরমা রঙের কবুতর উপহার দিলেন। সিলেটে মাজার সংলগ্ন এলাকায় সুরমা রঙের যে কবুতর দেখা যায়, তা ওই কবুতরের বংশধর। যা জালালী কবুতর নামে খ্যাত।

শেখ বুরহান উদ্দীনের দেখা ও দুঃখ প্রকাশ
শ্রীহট্টে ইসলাম জ্যোতিসহ বিভিন্ন ঐতিহাসিক গ্রন্থের বর্ণনা অনুসারে তুর্কি বিজয়ের মধ্য দিয়ে শ্রীহট্টে মুসলমান জনবসতি গড়ে ওঠে। সিলেটের টুলটিকর মহল্লায় ও হবিগঞ্জের তরফে তৎকালে মুসলমানরা বসতির গড়ে ছিলেন। এ সময় শ্রীহট্টের গৌড় রাজ্যে গৌড়-গোবিন্দ নামে এক অত্যাচারি রাজা ছিল। গৌড় রাজ্যের অধিবাসী বুরহান উদ্দীন নামক জনৈক মুসলমান নিজ ছেলের জন্ম উৎসব উপলক্ষে গরু জবাই করে গৌড়ের হিন্দু রাজা গৌড় গোবিন্দের কাছে অপরাধি সাবস্ত হন। 

ফলে গোবিন্দ বুরহান উদ্দীনের শিশু ছেলেকে ধরে নিয়ে হ্ত্যা করে। বুরহান উদ্দীন বাংলার তৎকলীন রাজা শামস উদ্দীন ফিরুজ শাহের নিকট গিয়ে এই নিষ্ঠুর হ্ত্যাকাণ্ডের অভিযোগ করলে রাজা তাঁর ভাগিনা সিকান্দর গাজীকে প্রখণ্ড সৈন্য বাহিনীর সঙ্গে শ্রীহট্টের গৌড় রাজ্যে প্রেরণ করেন। শাহী সৈন্য যখন ব্রহ্মপুত্র নদী পার হতে চেষ্টা করে তখনই রাজা গোবিন্দ ভৌতিক শক্তির সাহায্যে মুসলিম সৈন্যের উপর অগ্নীবাণ নিক্ষেপ করে সমস্ত চেষ্টাকে বিফল করে দেন। গোবিন্দের ঐন্দ্রজালিক শক্তির প্রভাবে সিকান্দর গাজীর প্রতিহ্ত ও বিফল মনোরথের সংবাদ দিল্লীর সম্রাট আলাউদ্দীন খিলজীর নিকট পৌঁছলে সম্রাট এ সংবাদে মর্মাহত হন।

পরবর্তিতে সম্রাট তাঁর রাজদরবারী আলেম-উলামাসহ জ্যোতিষদের সঙ্গে আলোচনায় এই মর্মে অবহিত হন যে, সুলতানের সেনাবাহিনীতে আধ্যাতিক শক্তি সম্পন্ন এক ব্যক্তি রয়েছে, তাঁর নেতৃত্বে অভিযান প্রেরণ করা হলে গৌড়গোবিন্দের যাদু বিদ্যার মোকাবেলা করে সিলেট বা শ্রীহট্ট জয় সম্ভব হবে। জ্যোতিষরা উক্ত আধ্যাতিক শক্তি সম্পন্ন ব্যক্তির পরিচয়ের পন্থা হিসেবে এও বলেছিল, আগামী দুই/এক রাতের মধ্যে দিল্লী নগরীতে প্রচণ্ড ঝড় বৃষ্টিতে সমস্ত নগরী ভেসে যাবে, প্রতিটি ঘর বাড়ির ভীষণ ক্ষতি লক্ষিত হবে, কোথাও কোন প্রদীপ থাকবে না একটি মাত্র তাঁবু ব্যতিত। 

সম্রাট জ্যোতিষদের কথামত অনুসন্ধান করে সেই ঝড় বৃষ্টির রাতে দেখতে পেলেন একজন সাধারণ সৈনিক একটি তাঁবুতে একাগ্র মনে বসে কোরআন পড়ছেন। সম্রাট সেখানে উপস্থিত হয়ে তাঁর সব বিষয় অবগত হয়ে সিলেট অভিযানের নেতৃত্ব নেওয়ার অনুরোধ জানান। তিনি সৈয়দ নাসির উদ্দীন সম্রাটের অনুরোধে সম্মত হলে সম্রাট তাঁকে সিপাহসালার সনদ প্রদানের মাধ্যমে সিকান্দর গাজীর কাছে প্রেরণ করেন। এদিকে গাজী বুরহান উদ্দীন তখন দিল্লীতে অবস্থান করছিলেন। এ সময় শাহজালাল (রহ.)ও তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে দিল্লীতে আসেন। দিল্লীতেই বুরহান উদ্দীনের সাথে শাহ জালালের সাক্ষাৎ হয় এবং এখানেই বুরহান উদ্দীন নিজের দুঃখময় কাহিনী তাঁর নিকট বর্ণনা করেন।

সিপাহশালার নাসির উদ্দীনের দেখা
শাহজালাল (রহ.) দিল্লী হতে বুরহান উদ্দীনকেসহ ২৪০ জন সঙ্গী-সহচর নিয়ে সিলেটের উদ্দেশ্য রওয়ানা হলেন। শাহজালাল (রহ.) সাতগাঁও এসে ত্রিবেণীর কাছে দিল্লীর সম্রাট প্রেরিত অগ্রবাহিনী সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীনের সঙ্গে মিলিত হন। সৈয়দ নাসির উদ্দীন শাহজালাল (রহ.) সম্পর্কে অবগত হয়ে তদীয় শিষ্যত্ব গ্রহণের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। পথে পথে শাহজালাল (রহ.) এর শিষ্য বর্ধিত হতে লাগল। ত্রিবেনী থেকে বিহার প্রদেশে আসলে আরও কয়েকজন ধর্ম যোদ্ধা অনুসঙ্গী হলেন। যাদের মধ্যে হিসাম উদ্দীন, আবু মোজাফর উল্লেখযোগ্য। এখান থেকে সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীনের আনিত এক হাজার অশ্বারোহী ও তিন হাজার পদাতিক সৈন্য সহ শাহজালাল (রহ.) নিজ সঙ্গীদের নিয়ে সোনারগাঁ অভিমুখে সিকান্দর গাজীর সাথে মিলিত হওয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন।

সিকান্দর গাজীর দেখা ও ব্রহ্মপুত্র পার
শাহজালাল (রহ.) সোনারগাঁ আসা মাত্রই শাহ সিকান্দর গাজীর সাথে সাক্ষাৎ ঘটলো। সিকান্দর গাজী শাহজালাল (রহ.)কে সসম্মানে গ্রহণ করলেন। শাহজালাল (রহ.) তাঁর সঙ্গী অনুচর ও সৈন্যসহ শাহ সিকান্দরের শিবিরে সমাগত হয়ে সিকান্দর হতে যুদ্ধ বিষয়ে সব বিষয় অবগত হন। সিকান্দর শাহজালাল (রহ.) এর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে শিষ্য গ্রহণপূর্বক সিলেট অভিমুখে যাত্রা করলেন। এভাবে শাহ জালাল (রহ.) এর শিষ্য সংখ্যা ৩৬০ জনে পৌঁছে। এদিকে গৌড় গৌবিন্দ নিজস্ব চরদ্বারা শাহজালাল (রহ.) এর আগমনের সংবাদ পেয়ে তাঁরা যাতে ব্রহ্মপুত্র নদী পার না হতে পারেন, সে ব্যবস্থা অনুসারে নদীর সমস্ত নৌ চলা-চল বন্ধ করে দেয়। শাহজালাল (রহ.) ভক্তরা বিশ্বাস করেন যে, তিনি তাঁর শিষ্যদের নিয়ে বিনাবাধায় জায়নামাজের সাহায্যে ব্রহ্মপুত্র নদী অতিক্রম করেন।

সিলেটে প্রবেশ
খ্রিস্টিয় দশম শতকে শ্রীহট্ট ভুমী লাউড়, জয়ন্তীয়া ও গৌড় নামে তিনটি স্বাধীন রাজ্যে বিভক্ত ছিল। উক্ত রাজ্যগুলোর মধ্যে গৌড় অন্যতম রাজ্য হিসেবে বিবেচিত ছিল। এ রাজ্যে প্রাচীন সীমারেখা বর্তমান মৌলভীবাজার জেলাসহ হবিগঞ্জ জেলার কিয়দাংশ নিয়ে বিস্তৃত থাকায় গৌড় রাজ্যের দহ্মিণ সীমাভূমী নবীগঞ্জের দিনারপুর পরগণার পাশে রাজা গোবিন্দের চৌকি ছিল। শাহজালাল (রহ.) তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদী পার হয়ে প্রথমত সেখানে অবস্থান করেন। এখানে গৌড়ের সীমান্ত রক্ষীরা অগ্নীবাণ প্রয়োগ করে তাদেরকে প্রতিহত করতে চায়। কিন্তু মুসলমান সৈন্যের কোন ক্ষতি করতে পারেনি। রাজা গোবিন্দ সমস্ত বিষয় অবগত হয়ে উপায়ন্তর না পেয়ে বরাক নদীতে নৌকা চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। শাহজালাল (রহ.) পুর্বের মত জায়নামাজের সাহায্যে  বরাক নদী পার হন। বরাক নদী পারাপারে বাহাদুরপুর হয়ে বর্তমান সিলেট জেলার বালাগঞ্জ উপজেলায় ফতেহপুর নামক স্থানে রাত্রি যাপন করেন। উল্লেখিত তথ্য সম্মেলিত প্রাচীন গ্রন্থ তোয়ারিখে জালালীতে উল্লেখ আছে।

সর্ব প্রকার কলাকৌশল অবলম্বন করে রাজা গৌড় গোবিন্দ যখন দেখলেন সকল প্রয়াসই বিফল হচ্ছে, তখন শেষ চেষ্টা করার লক্ষে যাদুমন্ত্র সহ এক প্রকাণ্ড লৌহ ধনুক শাহজালাল (রহ.) এর কাছে প্রেরণ করেন। যার শর্ত ছিল যদি কেহ একা উক্ত ধনুকের জ্যা ছিন্ন করতে পারলে গোবিন্দ রাজ্য ছেড়ে চলে যাবে। শাহজালাল (রহ.) তাঁর দলের লোকদের ডেকে বললেন, যে ব্যক্তির সমস্ত জীবনে কখনও ফজরের নামাজ কাজা হয় নাই বা বাদ পরে নাই একমাত্র সেই পারবে গোবিন্দের লৌহ ধনুকের জ্যা ছিন্ন করতে। অতপর মুসলিম সৈন্য দলের ভেতর অনুসন্ধান করে সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীনকে পাওয়া গেল এবং তিনিই ধনুকের জ্যা ছিন্ন করলেন।

সুরমা নদী পারাপার
উত্তর-পূর্ব ভারতের বরাক নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করার সময় সুরমা ও কুশিয়ারা নদীতে বিভক্ত হয়ে যায়। সিলেট বিভাগের বেষ্টনী হিসেবে এ নদীগুলো প্রাচীনকালে প্রবল স্রোতে প্রবাহিত হত। বর্ষাকালের দৃশ্য প্রায় সাগরের মত দেখাত। ঐতিহাসিক পর্যটক ইবনে বতুতা সুরমা নদীকে ‘নহরি আজরফ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। শাহজালাল (রহ.) ফতেপুর হতে যাত্রা করে যখন সুরমা তীরে অবস্থান নিলেন। এ নদী পার হয়েই গৌড়ের রাজধানী। তখন শাহজালাল (রহ.) আউলিয়ার কেরামতি ও আলৌকিক বিভিন্ন ঘটনায় রাজা গোবিন্দ বীতশ্রদ্ধ হন। গোবিন্দ শক্রবাহিনীকে কিছু সময় ঠেকিয়ে রাখার জন্য সুরমা নদীতে নৌকা চলাচল নিষিদ্ধ করেন। তা সত্ত্বেও শাহজালাল (রহ.) নদী পার হলেন। শাহ্জালাল (রহ.) বিসমিল্লাহ বলে সকল মুরিদকে নিয়ে জায়নামাজে করে অনায়াসে চলে গেলেন নদীর ওপারে।

সিলেট প্রথম আজান ধ্বনি
সিলেট শহরে সর্বপ্রথম হযরত শাহজালাল (রহ.) এর আদেশে সৈয়দ নাসিরুদ্দিন সিপাহসালার আজান দেন।

গৌড় গোবিন্দের আত্মগোপন
রাজা গোবিন্দ গড়দুয়ারস্থিত রাজবাড়ি পরিত্যাগ করে পেচাগড়ের গুপ্ত গিরি দুর্গে আত্মগোপন করেন। এরপর থেকে তার আর কোন হদিস মেলেনি। শাহজালাল (রহ.) তিন দিন সিলেটে অবস্থান করার পর মিনারের টিলায় অবস্থিত রাজবাড়ি প্রথমে দখল নিলেন।
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া

এএইচ/


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি